সর্বগ্রাসী আগুনের লেলিহান শিখায় প্রথমে পুড়ে মারা গেল চার বছরের ছোট্ট শিশু রুশদি। তিনদিন তীব্র যন্ত্রণা আর একমাত্র ছেলেকে শেষবার দেখতে না পাওয়ার আফসোস নিয়ে চলে গেলেন রুশদির মা জান্নাতুল ফেরদৌস (জান্নাত)। প্রিয় পুত্র-স্ত্রীকে হারানোর শোক খুব বেশি সময় সহ্য করতে হয়নি শহীদুল কিরমানীকে। স্ত্রীর মৃত্যুর পরের দিনই মৃত্যু হয় তারও।
এ যেন যোগীন্দ্রনাথ সরকারের বিখ্যাত কবিতা ‘হারাধনের দশটি ছেলে’র শেষ পরিণতির গল্প। যে কবিতার শুরু হয় ‘‘হারাধনের দশটি ছেলে, ঘোরে পাড়াময়…’’ আর ও শেষটা এভাবে ‘‘… রইল না আর কেউ।’’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত শহীদুল-জান্নাত দম্পতির ছোট্ট সংসারের কানায় কানায় ভরা ছিল সুখ আর আনন্দে। তাদের সেই সুখ-আনন্দের কেন্দ্রে ছিল রুশদি। পুরো বাসাজুড়ে ছিল তার চঞ্চলতায় ভরা উচ্ছ্বল বিচরণ।
গত বৃহস্পতিবার ভোররাতের এক আগুন রুশদি আর তার বাবা-মায়ের সেই স্বপ্ন-সুখের পৃথিবীকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। রাজধানীর দিলু রোডের যে পাঁচতলা ভবনে রুশদিরা থাকতো তার গ্যারেজে আগুন লাগে। পরে তা ছড়িয়ে পরে পুরো ভবনে। ফায়ার সার্ভিস কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও ঘটনাস্থলেই রুশদিসহ তিনজন মারা যায়।
নরসিংদীর মনোহরদীতে শহীদুল কিরমানীর বাড়ি। রুশদির মৃত্যুর পর সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। তিনদিন পর তার কবরের এক পাশেই হয় মায়ের ঠিকানা। একদিন পর রুশদির অন্য পাশের কবরে শোয়ানো তার বাবাকেও। এখন পাশাপাশি তিনটি কবরে যেন হাতে হাত রেখে শুয়ে আছেন তারা। ঠিক বেঁচে থাকার দিনগুলোতে যেমন করে থাকতেন!
এমন একটি পরিবার এক মুহূর্তেই পুড়ে খাক হয়ে গেল। এমন ঘটনার আমাদের কাছে নতুন নয়। বলতে গেলে সুপরিচিত। এদেশে প্রতিবছর অসংখ্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যের ভুল বা লোভের মাশুল গুনতে হয় রুশদিদের মতো নিরীহ মানুষদের। চকবাজারের চুড়িহাট্টা, নিমতলী, বনানীর এফআর টাওয়ার, কেরানীগঞ্জের প্লাস্টিক কারখানা কিংবা আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস বা টঙ্গীর টাম্পাকো ফয়েলের অগ্নিকাণ্ডেও এমনই দেখেছি আমরা।
সবচেয়ে প্রহসনটা তখনই ঘটে, যখন দেখা যায় প্রায় একই ধরণের কারণে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তা থেকে আমরা শিক্ষা লাভ করি না। আমরা দেখেছি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিটিগুলোর প্রতিবেদনে আগুন নির্বাপণে সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি উঠে আসে ভবন নির্মাণে ত্রুটির কথা, পর্যাপ্ত পানির উৎস না থাকা।
এসবের আড়ালে শেষ পর্যন্ত প্রকৃত যারা দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। নানান ফাঁক-ফোকর গলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। শুধু জীবনভর কাঁদতে হয় রুশদির স্বজনদের মতো হাজারো স্বজনকে। আমরা মনে করি, এই সংস্কৃতি থেকে জাতিকে বের করে না আনতে পারলে, যুগের পর যুগ ধরে নিষ্পাপ রুশদিরা হারিয়েই যাবে। আজ রুশদি পরশু অন্য কেউ।