শুক্রবার পবিত্র জুমার দিনে এহরাম (হজযাত্রীদের সাদা পোশাক) পরে বাংলাদেশের পতাকা খচিত লাগেজ নিয়ে বিমানবন্দরে যাওয়ার বাসের অপেক্ষায় হজযাত্রীরা। হজযাত্রীদের জন্য ফ্রি বাস সার্ভিসের বাসগুলো আসছে। বাসে ওঠার আগে পবিত্র কাবা শরীফের দিকে যাত্রা করা প্রিয়জনকে স্বজনরা বিদায় জানাচ্ছেন কান্না ভরা চোখে। পরম চাওয়া এই মহানযাত্রা শুরু করা বৃদ্ধ বাবা-মা কে জড়িয়ে ধরছে সন্তানরা। এমন আবেগের জবাবে স্বজনদের মাথায় হাত বুলিয়ে,বুকে জড়িয়ে শুধু ‘দোয়া করো’ বলে বিদায় নিচ্ছেন তারা। তবে সবাই এই বাবা-মায়েদের মতো সৌভাগ্যবান নন। হজ এজেন্সির গাফিলতি, ভিসা জটিলতা এবং ফ্লাইট অনিশ্চয়তায় অনেকের হজ যাত্রাই এখনো অনিশ্চিত।
তবুও হজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন ই-হজ ব্যবস্থা চালু হওয়ায় অন্যান্যবারের চেয়ে এবার হজ যাত্রা সহজ হয়েছে। কিন্তু ভিসা জটিলতায় শুরুর দিকের ফ্লাইট বাতিলের চাপ সামলানোই এইবারের মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ উড়োজাহাজে ওঠার অপেক্ষায় থাকা প্রায় ৫২ হাজার হজযাত্রীকে সময়মত সৌদি আরবে পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ বিমান এবং সৌদি এয়ারলাইন্সকে দিনে পনেরোটির বেশি ফ্লাইট পরিচালনা করতে হবে।
সব মিলিয়ে রাজধানীর আশকোনায় হজ ক্যাম্পে সৌভাগ্যবান হজযাত্রী এবং হজে যাওয়া অনিশ্চিতদের ভীড়। ক্যাম্পে দুপুরের একটু আগে সার্বিক অবস্থা দেখতে আসেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির শীর্ষ ব্যক্তিরা। হজ পরিচালনা কার্যালয়ের ভেতরে যখন তারা কথা বলছেন তখন এর ঠিক বাইরেই চলছে হজে যাওয়ার আবেদনকরা ব্যক্তি ও একটি এজেন্সির কর্মকর্তার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। টিয়া রঙের জোব্বা পরা একজনের সঙ্গে বেশ ক্ষুব্ধভঙ্গিতে কথা বলছেন এক তরুণ।
আতিকুর রহমান নামের এই তরুণ চ্যানেল আই অনলাইনকে জানান এজেন্টের গাফিলতিতে বাবা-মায়ের হজযাত্রা এখন অনিশ্চিত। তিনি বলেন,‘আমার বাবা-মা নূরে এবার হজে যেতে নূরে মদিনা (লাইসেন্স নম্বর:০৯৩৩) নামের একটি হজ এজেন্সিকে টাকা দিয়েছিলেন। টাকা পাওয়ার পর আম্মা-আব্বাকে সব হজ ট্রেনিং এবং ব্যাগসহ সবই দেয় এজেন্সি। কিন্তু আমার মায়ের ভিসা হয়ে গেলেও এজেন্সি সিরিয়াল দিতে দেরী করায় বাবার ভিসা হয়নি। আমরা বলেছিলাম দুজনের ভিসা না এবার নয় বরং আগামীবার যাবেন তারা। অথচ এজেন্সি থেকে বলা হয় দুজনকেই হজে এবার পাঠানো হবে, এ বিষয়ে তারা শতভাগ নিশ্চিত। এই কথা বলে আমাদের বাবা-মাকে ঢাকায় আসতে বলা হয়।’
অথচ লক্ষ্মীপুরে সরকারি চাকুরি করা আলমগীর বাবুল ও ওয়ালিদা বেগম ঢাকায় এসে জানতে পারেন এখনো তাদের হজে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থাই হয়নি।
এজেন্সির কারণে বাবা-মায়ের এই ভোগান্তির জন্য ক্ষুব্ধ আতিকুর বলেন,“গত সপ্তাহে আমাদের জানানো হয় ভিসা হয়ে গেছে। ১৯ তারিখ ফ্লাইট, এজন্য ঢাকায় আসতে বলা হয়। অনিশ্চয়তা থাকায় আমার বাবা-মা আগামীবার হজে যেতে চাইলেও এবারই তারা যেতে পারবেন এব্যাপারে নাকি ১০০ পার্সেন্ট নিশ্চিত ওই এজেন্সি। এরপর আমার বাবা-মা ঢাকায় আসেন। কিন্তু আসার পর থেকেই আজ না কাল এরকমভাবে তাদের ঘোরানো হচ্ছে। ১০ তারিখ ছিলো রিপ্লেসমেন্টের শেষ দিন। আমি হজ অফিসে আসি ১৩ তারিখে। এখানে আইটি সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে এজেন্সিকে ফোন করেছিলাম। তখনও তারা বলেছিলো হজ অফিসারের টেবিলে ভিসার কাগজ আছে,সাইন হলেই বাবার ভিসা হয়ে যাবে। অথচ হজ অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম রিপ্লেসের জন্য কোনো আবেদনই করেনি ওই এজেন্সি! এরপর থেকে আমরা গত দুইদিন ধরে ঘুরছি। আজ সকালে এসে জানতে পেরেছি আমার বাবা ছাড়া ১১ হাজির রিপ্লেসমেন্ট ভিসা হয়ে গেছে। আসলে ওই এজেন্সি আবেদনই করেনি।”
আলমগীর-ওয়ালিদা দম্পতির ছেলের চাপে আজ দুপুরে ভিসা জটিলতা নিয়ে কথা বলতে ওই এজেন্সির এজেন্ট নূর ইসলাম জিহাদি হজ পরিচালকের কার্যালয়ে ঢোকেন।
ততোক্ষণে এবারের হজ ব্যবস্থাপনা-অব্যবস্থাপনা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বিএইচ হারুন।
তিনি বলেন,‘এখানে হজ পরিচালক ও অন্যান্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। ১ লাখ ২৬ হাজার ২৭৯ জনের হজে যাওয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ মাত্র ৯’শ ১৯ জনের ভিসার কাজ হয়নি। আশা করছি বিমানে এবং সৌদি এয়ারলাইন্সে সব হজযাত্রী সহজেই হজে যেতে পারবেন।’
বিমানের ফ্লাইট বাতিল হচ্ছে না বরং রদবদল করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন,‘অনেকেই বলছেন বিমানের ফ্লাইট বাতিল করা হচ্ছে। আসলে ফ্লাইট বাতিল নয় রিশিডিউল হচ্ছে। আমাদের বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয় সৌদির বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আশা করছি সৌদি বিমান ২৮ তারিখ পর্যন্ত হজযাত্রী পরিবহন করবে। দোহা সহ বিভিন্ন রুটে যে ফ্লাইটগুলো ছিলো সেগুলো নিয়ে আসা হয়েছে হজযাত্রীদের জন্য।’
প্রতিবারের মতো এবারও হজ এজেন্সিগুলোর জন্য নানা ভোগান্তির মুখে পড়েছেন হজযাত্রীরা। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে লাইসেন্স বাতিল সহ জরিমানার ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন হারুন।
তিনি বলেন,‘কিছু সংখ্যক এজেন্সির ওপর আমরা অত্যন্ত বিরক্ত। তারা যে নাটকগুলো করে সেজন্য মন্ত্রণালয় তাদের ক্ষমা করবে না।’
মাত্র আর ৮-১০ দিন বাকী আছে। এই কয়েকদিনে পরিবহন করতে হবে ভিসা পাওয়া অবশিষ্ট প্রায় ৫২ হাজার হজ যাত্রীকে। এবছর হজে যাওয়ার জন্য নাম নিবন্ধন করেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ হজ যাত্রী।