জন্মিলে মরিতে হবে-এ কথা যেমন অমোঘ সত্য, ঠিক তেমনি প্রত্যেকটি মৃত্যুই আমাদের ব্যাথাতুর করে তোলে, বিশেষ করে নিজের পরিবার পরিজন ও আত্নীয় স্বজনদের মৃত্যু আজীবন আমাদের শোকার্ত করে রাখে। স্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নিতেই আমাদের কষ্ট হয়, সেখানে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ভার যে কতটা অসহনীয় তা ভুক্তভোগীই মাত্র অনুধাবন করতে পারেন। অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিষয়টি আমাদের বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্বাভাবিক মৃত্যুর উদাহরণ হিসেবে সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের জন্য মারত্মক পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে প্রতিনিয়ত। প্রতিদিনই গণমাধ্যমে দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদে হতাহত হওয়ার সংবাদ পরিবেশিত হয়। আবার অনেক সময় সব মৃত্যু তথা দুর্ঘটনার খবর পত্রিকায় পাতায় আসে না, থেকে যায় অন্ধকারে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, রাস্তায় চলাচলে আমরা কেউই নিরাপদ নই। নিরাপদ নয় আমাদের আত্নীয় স্বজন ও রাষ্ট্রের জনগণ।
সারাদেশে সড়ক দু্র্ঘটনার বিরুদ্ধে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের যে যুগপৎ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ আন্দোলন দেখা যাচ্ছে তা আমাদেরকে আশান্বিত করে তুলেছে। সচেতন পাঠক মাত্রই শিক্ষার্থীদের এই যৌক্তিক আন্দোলনে সমর্থন জানিয়েছে, যুগিয়েছে উৎসাহ। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনা ও যানজট নিরসনে আমাদের কী করতে হবে। আসলে এ রকম একটা আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল, কারণ দিনের পর দিন সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থায় যে অব্যবস্থাপনা চলে আসছে তা থেকে পরিত্রাণের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের প্রদত্ত দাবিগুলো যুতসই মনে হয়েছে। আবারও এও জানা গেছে, আমাদের শিক্ষার্থীরা সঠিক জায়গায় আছে অর্থাৎ অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আয়োজনে একাত্মতা এবং সমস্যা সমাধানের কৌশলও দেখিয়ে দিয়েছে প্রয়োগের মাধ্যমে। এ বয়সে স্কুল শিক্ষার্থীরা যতটুকু সাহসিকতা দেখিয়েছে তাতে আমরা আশান্বিত। এই ছেলে-মেয়েরাই একদিন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসবে এবং রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চলমান রাখতে পারবে বলেই বিশ্বাস রাখি।
আমাদের একজন শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির খাতা নিজে পূরণ না করে ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে পূরণ করাতেন। স্যার উপস্থিতির শিট সহসাই নিরীক্ষণ করতেন না, এ সুযোগে কয়েকজন সুযোগের অপব্যবহার করতেন প্রায়শই। একদিন স্যার উপস্থিতির শিট নিরীক্ষণ করে আমাদের কয়েকজনের অপকর্মের বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত হন। পরবর্তীতে স্যার প্রচণ্ড আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন, সামান্য উপস্থিতি নিয়ে তোমরা যা করেছে তাতে আমি খুবই মর্মাহত। সেদিন তিনি আরো বলেছিলেন, তোমাদের হাতে যদি দেশের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তোমরা তো তাহলে দেশের বারোটা বাজিয়ে ফেলবে। স্যারের কথার বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ কিছুই বলতে পারিনি। কারণ, আমাদের মধ্যে ২-১ জন এ গর্হিত কাজটি করেছিলো। তবে আজ বলতে ইচ্ছে করছে, আমাদের বর্তমান স্কুলগামী ছেলে-মেয়েরা সঠিক পথেই আছে। তারা যখন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আসবে, আমি হলফ করে বলতে পারি এই ছেলে-মেয়েগুলো কোন ধরনের অন্যায় অনিয়মকে প্রশ্রয় দিবে না। তাদের হাতে নিরাপদ থাকবে বহু কষ্টে অর্জিত আমাদের এ স্বদেশ, প্রিয় বাংলাদেশ।
শিক্ষার্থীদের এই যুগপৎ আন্দোলনে শহরবাসীরও নৈতিক সমর্থন ছিলো। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকেরা আন্দোলনের সমর্থনে রাস্তায় নেমে আসেন। কারণ, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে পাঠিয়ে অভিভাবকেরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন। তাছাড়া, আন্দোলন চলাকালীন যাত্রাবাড়িতে শিক্ষার্থীদের উপর গাড়ি উঠিয়ে দেওয়ার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ঢাকা শহরে স্বাভাবিকভাবে জ্যাম লেগে থাকে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম দিনে গাড়ি চলাচল অনেকটা স্থিমিত হয়ে পড়ে, এতে নগরবাসী বেকায়দায় পড়েন। তবে কারোর চোখে-মুখে কোন অভিযোগ ছিল না, ছিল না কোন অনুযোগ। সবাই বিষয়টিকে নিজেদের ব্যক্তিক দাবি মেনে নিয়ে কষ্ট সহ্য করে চলাচল করছেন। তারা মনে করছেন, নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার দাবিতে একটি সুষ্ঠু ও স্থায়ী সমাধান হওয়া বাঞ্জনীয়। যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দেওয়া যায় না। বিদ্যমান সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে। কারণ, অভিভাবকেরা ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তারা কি সুস্থভাবে বাসায় ফিরে আসবে? রাস্তাঘাটে যেভাবে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটে সেখানে কারোর জীবন নিরাপদ নয়। কাজেই, অভিভাবকদের ভাবনা কোন অর্থেই অমূলক নয়।
শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সংবাদ বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমেও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে শোকার্ত পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ হয়েছে। সরকার প্রধান শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছেন, আশ্বস্ত করেছেন ভিক্টিম হওয়া পরিবার দুটিকে। যেকোন মূল্যে দোষীদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। এখন সে দাবিগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের পরম আকাঙ্খিত নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার স্বপ্ন পূরণ হবে। শিক্ষার্থীরা সড়কে গাড়ির লাইসেন্স পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গাড়ির ছাড়পত্র দেওয়ার যে ইঙ্গিত দিয়েছে তাতে এ সংক্রান্তে সকলেই সাবধান হয়ে গাড়ি রাস্তায় নামাচ্ছেন। এ সংস্কৃতিটা দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলকে যথাযথভাবে পালন করতে পারলে রাস্তাঘাটে জ্যাম, দুর্ঘটনা কমে আসবে নিমিষেই।
বৃহস্পতিবার স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল ড্রেস পড়ে রাস্তায় ছিলো এবং রাস্তাঘাটে গাড়ির সংখ্যাও কম ছিলো। যাদের কাগজপত্র সংক্রান্ত ত্রুটি রয়েছে তারা কেউই রাস্তায় গাড়ি নামানোর সাহস করেনি। এমনকি পুলিশের গাড়ির ড্রাইভারেরও লাইসেন্সবিহীন হলে গাড়ি আটকিয়ে রাখার নজির স্থাপন করেছে শিক্ষার্থীরা। বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবেই দেখা উচিত। কারণ আইন সবার জন্য সমান। এ বিষয়গুলো বজায় রাখতে হবে, তাহলে ওভারটেকিং, দ্রুত চালানোর প্রতিযোগিতা, অবৈধ অস্ত্র/মাদক পরিবহন ইত্যাদি সংক্রান্ত ঝামেলা কমে আসবে সহসাই।
পরিশেষে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্য শুভকামনা জানাই। আশা রাখবো, সামাজিক যেকোন ইস্যুতে বিশেষ করে সামাজিক অনাচার, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, সহিংস অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে ঐক্যমতের ভিত্তিতে আন্দোলন সংগ্রামে সকলেই সততার পরিচয় দিবে। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে, এ সব আন্দোলনের সময়ে দেশবিরোধী কিছু চক্র সর্বদাই ফায়দা লোটার চেষ্টা করে থাকে। তাদের থেকে সাবধান থাকতে হবে, চিহ্নিত করতে হবে অপপ্রচারকারীদের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানা যায়, আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য পুলিশ সদস্য কর্তৃক স্কুলগামী ছেলেকে নির্যাতনের দৃশ্য ফেসবুকে ভাইরাল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে একটি বিশেষ মহল। অথচ ছবিটি ২০১৩ সালের এবং ঐ পুলিশ সদস্য বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে বর্তমানে চাকুরিচ্যুত। কাজেই অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)