ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন দৌড়ে হেরে গেছেন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। গত ৭ জুন ক্যালিফোর্নিয়া ও নিউজার্সিসহ ছয়টি রাজ্যে প্রাইমারি নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর মনোনয়ন যুদ্ধে এগিয়ে থাকা হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। পার্টির প্রার্থী নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন এ পর্যন্ত পেয়েছেন ২,২০৩ ডেলিগেট এবং বার্নি স্যান্ডার্স পেয়েছেন ১,৮২৮ ডেলিগেট। প্রাইমারী নির্বাচন বাকি আছে শুধু একটি রাজ্যে, ডিসট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া। এ রাজ্যে ডেলিগেটের সংখ্যা ৪৫। এর সব কয়টি পেলেও প্রাইমারি ডেলিগেটদের ভোটে মনোনয়ন পাওয়ার সুযোগ নেই স্যান্ডার্সের। ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন শুধু সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত ডেলিগেটের সংখ্যার উপরেই নির্ভর করে না। এখানে পার্টির মনোনীত এবং নির্বাচিত সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, গভর্নর, মেয়র এবং দলীয় নেতৃবৃন্দের (সুপারডেলিগেট) ভোট দানের সুযোগ আছে। সুপারডেলিগেটের সংখ্যা ৭১৪। এদের মধ্যে ইতোমধ্যে ৫৭৭ জন হিলারির পক্ষে এবং ৪৮ জন স্যান্ডার্সের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হবে আগামী ২৫-২৭ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য ডেমোক্রেটিক কনভেনশনে। সেদিন সুপারডেলিগেটরা হিলারিকে ভোট না দিয়ে তাদের মতামত পরিবর্তন করে স্যান্ডার্সকে মনোনীত করতে পারেন। যদিও সে সম্ভাবনা প্রায় শূন্য তবুও, সুযোগ রয়েছে।
মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে প্রায় অচেনা এক স্বতন্ত্র সিনেটর যিনি নিজের প্রার্থিতা ঘোষণার ঠিক আগে ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে বহিরাগত এবং সমাজতন্ত্র যে দেশে মৌলবাদের সঙ্গে তুলনীয় সে দেশে আত্মস্বীকৃত সমাজতন্ত্রী স্যান্ডার্স ৩০ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে যখন প্রার্থিতা ঘোষণা করেন তখন তার জনসমর্থন ছিল ৫.৬%, বিপরীতে হিলারির ৬২.২%। সেই স্যান্ডার্স চ্যালেঞ্জ করেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক যন্ত্রকে যে যন্ত্র নির্ধারণ করে কবে কোথায় যুদ্ধ বাঁধাতে হবে; কোন দেশের সরকার ফেলে দিতে হবে; কোন দেশের রাষ্ট্র নায়ককে চির বিদায় দিতে হবে; কোন দেশের খনিজ সম্পদ কোন দেশ কত দামে কিনতে পারবে; সামরিক সরবরাহ, ইনস্যুরেন্স, ব্যাংক, তেল, গ্যাসের ব্যবসা কে করবে। বার্নি স্যান্ডার্স চ্যালেঞ্জ করেছেন পুঁজিবাদী আমেরিকার পুঁজিপতিদের মুখপাত্র হিলারি ক্লিনটনকে। হিলারির নির্বাচনী ব্যয়ের সবটাই দিচ্ছেন বৃহৎ পুঁজিপতিরা। শুধু নির্বাচনের ব্যয়ই নয় তাকে প্রার্থী হিসেবে স্থাপন করার জন্য যেসব প্রস্তুতি নিতে হয়েছে তার খরচও দিয়েছে এইসব পুঁজিপতিরা। ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়নের জন্য নিজের প্রার্থীতা ঘোষণার আগের দুই বছরের মধ্যে হিলারি ক্লিনটন বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে গ্রহণ করেন ২ কোটি ১ লক্ষ ডলার।
জনমানুষের নিত্যদিনের প্রয়োজনের বিষয়গুলো নির্বাচনী আলোচনায় নিয়ে এসে শিক্ষিত এবং সচেতন মানুষের মন জয় করেন ওয়াশিংটন ভিত্তিক রাজনৈতিক যন্ত্রের বাইরে থাকা স্যান্ডার্স। তিনি তার নির্বাচনী প্রচারণাকে রাজনৈতিক বিপ্লব হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তার কথায়, তার কাজে ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্তি পাগল মানুষ যোগ দিয়েছে এই বিপ্লবে। তিনি ২২টি রাজ্যের নির্বাচনে হিলারিকে হারিয়েছেন। যেসব রাজ্যে হেরেছেন সেখানেও হিলারির সঙ্গে ব্যবধান বেশি নয়। তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যেসব কথা রাজনীতির আলোচনায় নিয়ে আসেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সর্বনিম্ন মজুরি ১৫ ডলার নির্ধারণ করা, সবার জন্য চিকিৎসা সুবিধার ব্যবস্থা করা, সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা ব্যবস্থা করা; ফাটকাকারবারির উপর। তিনি বক্তৃতায় ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলেন। কি প্রক্রিয়ায় বৃহৎ পুঁজিপতিরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে অর্থনীতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন।
এসব বক্তৃতা শুনে শিক্ষিত এবং সচেতন মানুষেরা রাজনীতি এবং অর্থনীতির জটিল অংকগুলো অনুধাবন করেন। এর ফলে দলে দলে মানুষ স্যান্ডার্স শিবিরে যোগদান করে। স্যান্ডার্স সমর্থকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে কম বয়সের মানুষেরা। তিনি ৩০ বছরের কম বয়স্ক মানুষদের যে পরিমাণ ভোট পান তার সংখ্যা হিলারি এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের যৌথ ভোটের বেশি। ৪৫ বছর বা তার কম বয়স্ক ভোটারদের ভোট তিনি পেয়েছেন সবচেয়ে বেশি। এই ভোটারেরা শুধু স্যান্ডার্সের কথাতেই আস্থা রাখেননি। তারা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি কাজের মূল্যায়ন করেছেন। ছাত্র রাজনীতিতে, মেয়র হিসেবে, কংগ্রেসম্যান হিসেবে, সিনেটর হিসেবে বিভিন্ন সময়ে তিনি যেসব বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে ছিলেন তার সবই ছিল মানবতা এবং শান্তির পক্ষে। আজন্ম যুদ্ধ বিরোধী স্যান্ডার্স ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন; সবসময় সোচ্চার ছিলেন প্রকৃতি রক্ষায়। এ রকম উদাহরণ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ভুরি ভুরি।
তিনি সাধারণ মানুষের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন পুঁজিবাদী শোষণ প্রক্রিয়া। তিনি বৃহৎ ব্যাংকগুলোকে ভেঙ্গে ফেলার কথা বলেছেন, পুঁজিবাদের ভিত্তিমূল ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলেছেন। এতে তিনি বিরাগভাজন হয়েছেন পুঁজিপতিদের তথা তাদের নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রচারযন্ত্রের। স্যান্ডার্স রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক যন্ত্রগুলোকে সাধারণ মানুষের সমর্থনের জোড়ে পরাস্থ করতে পেরেছেন বেশ ভালোভাবেই। তিনি পারেননি কর্পোরেট মিডিয়াকে পরাস্থ করতে। কর্পোরেট মিডিয়া নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই তার বিরুদ্ধে কথাবার্তা চালিয়েছে; তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে; তার জয়ের সম্ভবনা শূণ্য শতাংশ বলে প্রচারণা চালিয়েছে। সর্বশেষে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এপি ক্যালিফোর্নিয়া নির্বাচনের একদিন আগে কোনো রকম যুক্তি-তর্ক-উপাত্ত ছাড়া হিলারি ক্লিনটনকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিয়েছে। অন্যান্য কর্পোরেট মিডিয়া এপির পালে হাওয়া দিয়ে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যে দুর্বল মনস্তত্বের ভোটাররা স্যান্ডার্সকে ভোট দেয়ার আগ্রহ হারিয়েছে। এই প্রচারণা নির্বাচনের ফলাফলের উপর বিরাট ভূমিকা রেখেছে; ডেলিগেট প্রাপ্তির অংকে স্যান্ডার্সকে পেছনে ফেলে দিয়েছে।
সাধারণ মানুষের সাধারণ চাওয়া পাওয়ার কথা বলতে বলতে স্যান্ডার্স আজ সারা বিশ্বে আলোচিত। সমগ্র পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ আজ সান্ডার্সের রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত। বিশ্ব মানবতা স্যান্ডার্সের মধ্যে যুদ্ধ, ধ্বংস, শোষণের প্রতিবাদে মুক্তির আলো দেখতে পেয়েছে। ১% পুঁজিপতি কিভাবে নিজেদের সম্পদের পাহাড় আরও বিশাল, বিপুল করার জন্য, ভোগ বিলাসে মত্ত থাকার জন্য যুদ্ধ, সংঘাত লাগিয়ে নিজেদের পকেট ভর্তি করে তা দুনিয়ার সকল প্রান্তের সচেতন মানুষ স্যান্ডার্সের কারণে আজ আরও ভালো করে বুঝতে শিখেছে। কিছুদিন আগে বৃটেনের লেবার পার্টির নেতা নির্বাচনে পেছনের সারি থেকে সাধারণ মানুষের প্রাণের কথা বলে উঠে এসেছেন জেরেমি করবিন। করবিনের জিতে যাওয়ায় সারা দুনিয়ার প্রগতিশীল লোকেরা স্যান্ডার্সের মনোনয়ন বিজয়ে আশাবাদী হয়েছে। তবে দুজনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, শ্রেণী বৈষম্য, আয় ও সম্পদ বৈষম্য, সর্বোপরি সামাজিক সচেতনতার পরিস্থিতিও দুই দেশে এক নয়। আমেরিকায় শত শত ডেমোগ্রাফিক বিভাজন। সেখানের দরিদ্র মানুষেরা, শ্রমিকেরা একেবারেই রাজনীতি সচেতন নয়। দীর্ঘ দিনের অপপ্রচারে মার্কিন শিক্ষিত সমাজ রাজনীতি বিমুখ যা বাংলাদেশেও কিছু শিক্ষিত মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। নিউ ইয়র্ক নির্বাচনের সামান্য ব্যবধানে হেরে যাবার পর স্যান্ডার্স বলেছিলেন, ‘দরিদ্র মানুষেরা ভোট দেননা বলে তিনি জিততে পারেননি। ভোটার উপস্থিতি ৭৫% হলে এ দেশ মূলগতভাবে বদলে যাবে।’
দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য কথা বলেও দরিদ্র মানুষের ভোট তিনি যথেষ্ট পরিমাণে পাননি। যেমনটা দেখা দিয়েছিল বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকদের ক্ষেত্রে। নিজের সময়কালে অনেকেই যথেষ্ট জনসমর্থন অর্জন করতে পারেননি। পরবর্তীকালে তাদের কথা, কাজ মানুষ গ্রহণ করেছে। যারা মহামানবের জন্য কাজ করেন তারাইতো মহামানব। স্যান্ডার্স ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পাবেন না। কিন্তু স্যান্ডার্স বিপ্লব তাতে শেষ হয়ে যাবে না। তার দেয়া রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলো আগামী দিনেও আলোচিত হতে থাকবে। এর অনেক কিছুই ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন হবে। স্যান্ডার্স বিপ্লব সাধারণ মানুষকে রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করে তুলছে, বেশি বেশি মানুষকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করছে, তরুণদের সংগঠিত করছে। এই শিক্ষা, এই সংযুক্তি, এই সংগঠন, নবলব্ধ রাজনৈতিক চেতনা, শক্তি ধরে রাখার জন্য, এগিয়ে নেবার জন্য তার কাছে দুইটি উপায় আছে। সামাজিক সাম্য অর্জনের জন্য পুঁজিবাদীদের কবল থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি নতুন একটা দল গঠন করতে পারেন অথবা ডেমোক্রেটিক দলের ভেতরে থেকে তিনি এবং তার সমর্থকেরা এই শক্তিকে চর্চার মাধ্যমে ধরে রাখতে পারেন, এগিয়ে নিতে পারেন। উপায় দুটির একটিও সহজসাধ্য নয়। স্যান্ডার্স কোন পথে চলেন তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)