“মালাউন” শব্দটি প্রথম শুনি হরেণ কাকুর মুখে। শব্দটির আভিধানিক অর্থ নিরীহ হলেও এর প্রয়োগিক অর্থ অতীব আপত্তিকর ও সাম্প্রদায়িক। তবে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম সেদিন আপত্তিকর মনে হয়নি, কারণ বক্তার বলবার ধরণটি ছিল রসাত্মক এবং বক্তা নিজেই নিজেকে ‘মালাউন’ বলছিলেন। সেই দেশ স্বাধীনের পরের বছরের কথা বলছি। আমার মেজচাচি সকালের খাবার বেড়েছেন; বাড়ির গোমস্তা সে সুসংবাদটি সব ঘরের দরজায় দরজায় গিয়ে ঘোষণা করে ফিরছে। এতক্ষণে পড়ার টেবিল থেকে উঠে পড়বার যথোপযুক্ত একটা কারণ পাওয়া গেল। সাকুল্যে বারো-পনেরজন হবো, পিঠাপিঠি ভাইবোন আমরা (চাচাতো-ফুফাতো মিলিয়ে); দক্ষিণঘর, উত্তরঘর, পুবেরঘরগুলো থেকে একযোগে দৌড়ে বেরিয়ে পশ্চিম ঘরের বারান্দায় গিয়ে আছড়ে পড়লাম।
শীতকালের সকালের নাস্তা খাওয়ার আয়োজনটি মেজচাচি ঐ বারান্দাতেই করে থাকেন। ওভার সাইজ্ড লম্বা বারান্দায় সারি সারি করে মাদুর পাতা হয়েছে। আমরা গিয়ে আসনগোঁড়া দিয়ে বসে পড়লাম। সকালের সোনামাখা রোদটুকু সবার গায়ে যেন পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে! চাচা-ফুফারাও বসেছেন বারান্দার অন্য পাশটিতে, তাদের মাদুর আলাদা। ঐ বারান্দা সংলগ্ন ভেতর বাড়ির উঠোনেই জলচকিতে বসে দাদি রোদ পোহাচ্ছেন। আর নাতি-পোতাদের শান্ত রাখার জন্য দরকারমত স্নেহ-ধমক দিচ্ছেন!
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ভেতর বাড়ির প্রবেশদ্বার ঠেলে হরেণ কাকু ঢুকলেন। হাতে তাঁর সেই প্রাগৈতিহাসিক ডাক্তারি ব্যাগটি! দাদির বাড়ির ভেতরের উঠোনটি বেশ বড়সড়, বর্গাকার। লম্বা এবং চওড়ায় উভয়দিকে শতফুটের বেশি হবে। কাকুর গন্তব্য ব্রেকফাষ্ট এরিয়ার দিকে, অর্থাৎ খেতে বসার মাদুরের দিকে। উঠোন মাড়াতে মাড়াতে দাদিকে প্রণাম করলেন, বড়আম্মা আদাব! কাকু মেজচাচিকে উদ্দেশ্যে করে তার হেঁড়ে গলায় বললেন, মেজবৌমা মালাউনরে চাইডা খাওন দেও দেহি। চাচি মাথায় ঘোমটা টেনে শ্রদ্ধাবনত হয়ে বললেন, দাদা বসে পড়েন খাবার দেয়া।
চাচি বলার আগেই হরেণ কাকু চাচাদের মাদুরে গিয়ে বসে পড়েছেন। আমরা ভাইবোনেরা খাওয়া ফেলে এক ঝটকায় উঠে গিয়ে হরেণ কাকুকে ঘিরে ধরলাম। বদরাগি নোয়াচাচা মারমুখি হয়ে উঠলো! কিরে তোরা খাওয়া রেখে দাদাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিস কেন? ওনাকে খেতে দে! আর তোরাও খাওয়া শেষ কর, বান্দরগুলো কোথাকার! পরম মমতায় কাকু বললেন, সৈয়েদ তুই চুপ যা, আমি দ্যেখতাছি ওগোরে। আমাদের সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে খানিকটা কৌতুকমাখা ইঙ্গিত করে তার ব্যাগটি দেখিয়ে বললেন, বাজানরা খাওয়াডা শ্যাষ করো, তোমাগো মিষ্টি বড়ি ব্যাগের মইদ্যে আছে, দিমুনে।
ডা: হরেণ্দ্রনাথ মণ্ডল, আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম জিকাবাড়িতে তার নিবাস। ৫৫ থেকে ৬০ এর মধ্যে বয়স হবে। পাঁচফুট দশ ইঞ্চির মত লম্বা, দোহারা গড়ন। শরীরের মধ্যাংশ খানিটা স্ফীত, গায়ের রং কুঁচকুঁচে কালো। মাথায় কাজী নজরুল মার্কা বাবরী চুল। ডাক্তার হিসেবে এলাকায় তার হাতযশ একেবারে কিংবদন্তির মত! দশ-বিশ গ্রামের মধ্যে হরেণ কাকুই একমাত্র ডাক্তার। মানুষের যে কোন ধরণের রোগ বালাই হরেণ ডাক্তার ‘ছুঁয়ে’ দিলেই ভাল হয়ে যায়– এমনটাই লোকের বিশ্বাস!
হরেণ কাকু অ্যালোপ্যাথি নাকি হোমিওপ্যাথি ডাক্তার, এ নিয়ে এলাকার যুবকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। আর তর্ক থাকা খুবই স্বাভাবিক, কারণ তার ডাক্তারি ব্যাগের মধ্যে দুই ধরণের ঔষধই মজুত থাকে। এলাকায় এমন উদাহরণও ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে যে, একই রোগীকে একই রোগের জন্য তিনি একই সাথে দুই পদ্ধতিতেই চিকিৎসা করেছেন। অনেকটা ‘যেটা লাইগ্যা যায়’ অবস্থা! রোগীকে অ্যালোপ্যাথির ট্যাবলেট ও হোমিওপ্যাথির পুরিয়া, দুটোই যুগপৎ খাইয়েছেন তিনি! তাতে করে ফললাভও হয়েছে বেশ!
অনুমান চল্লিশ বছরের মত হবে তিনি ডাক্তারি করছেন। কিন্তু হরেণ “ডাক্তার” হয়ে উঠলো কিভাবে, সেটা জানা যায় না। অঞ্চলের প্রাজ্ঞজনদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক মতান্তর আছে। কারো মতে হরেণের অ্যালোপ্যাথি ও হোমিওপ্যাথি ডাক্তারি শিক্ষার দুখানা চটি বই আছে, গভীর রাতে সেগুলো পড়ে, আর দিনে ডাক্তারি করে। আবার ভিন্ন মতাবলম্বীরা মনে করে, হরেণ হয়তো ছোটবেলায় শহরের বড় কোন ডাক্তারের সাথে ছ’মাস-একবছর কম্পাউন্ডারী করে গ্রাম্য ডাক্তারিটা রপ্ত করেছে। আর তার হাতযশটা হলো সৃষ্টিকর্তার রহমত! তবে যুবক এবং গুরুজনদের মধ্যে তার ডাক্তারি জ্ঞান-শিক্ষা নিয়ে যত মতভিন্নতাই থাকুক না কেন, তাঁর হাতযশ নিয়ে কোন মতান্তর নেই!
দাদির বাড়িটি হিন্দু প্রধান এলাকায়। ১৯৭১ এ এখানকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠেছিলো। শত সহস্র হিন্দু জনগোষ্ঠি নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে জীবন বাঁচাতে ভারতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছিলো। বস্তুত এলাকার শতভাগ হিন্দুই দেশ ছেড়েছিলো। দেশ ছাড়েনি শুধু হরেণ ডাক্তার! তো যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে একদিন আমাদের বাহির বাড়ির উঠোনে স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির মিটিং চলছিলো। ঐ মিটিংয়ের একমাত্র হিন্দু সদস্য হরেন্দ্রনাথ মন্ডল, হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে তাঁর বাবরী চুল মৃদু নাচাচ্ছিলেন।
প্রকাশ্য সভার মধ্যেই আব্বা অনুনয় করে বললেন, হরেণদা তুমি ইন্ডিয়া চলে যাও, আমি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করো, এই খবর রাজাকারদের কানে পৌঁছে গেছে। নিজেদের জানই বাঁচাতে পারছি না! দেশের অবস্থা খুব খারাপ, তোমাকে রক্ষা করার ক্ষমতা আমার আর নাই। হরেণ কাকু আব্বা কাকুকে জড়িয়ে ধরলেন, হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠলেন! চেয়ারম্যান, তুই কস্ কি? তরে ফালাইয়া, তগোরে ফালাইয়া, আমি কই যামু? ফ্যাডে অসুক অইলে, জ্বর-টাইফ্যাড অইলে, তগোরে দ্যাখবো ক্যাডায়? ওসুদ পাবি কই? আমি কি তগো মাইরা নিজে বাঁচুম রে? হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলো কাকু! তো এই হলো আমাদের হরেণ ডাক্তার!
বেলা উঠার আগেই প্রাতঃক্রিয়া এবং স্নান সেরে চিরকুমার হরেণ ডাক্তার তাঁর অফিসে বসে যান। অফিস মানে তাঁর কুড়েঘরের বারান্দায় রাখা জরাজীর্ণ টেবিলখানি, নিজের বসবার একখানা চেয়ার আর রোগীদের জন্য ঐ একখানা টুল। টেবিলের উপর নূহুনবীর আমলের তাঁর সেই পুরোনো ডাক্তারি ব্যাগটি রাখা। ব্যাগটি সাইজে বড়সড়, নানা রকমের ঔষধে ঠাসা। ওটিই তার ডিসপেনসারি বা ঔষধের দোকান।
শেষরাত থেকে রোগীরা এসে উঠোনে লাইন দিয়ে বসে যায়। একেকজন করে রোগী ডেকে ডাক্তার জেনে নেন কার কি অসুবিধা। পেটের পীড়া নিয়ে যে এসেছে, তার পেট টিপে দেখেন। জ্বর যার, তার কপালে হাত দিয়ে উত্তাপ মাপেন। খুবই জটিল রোগী যে, অনেক ব্যথা বা যন্ত্রণা অনুভুত হচ্ছে; কিন্তু সমস্যাটা গুছিয়ে বলতে পারছে না। এমন রোগীকে হরেণ ডাক্তার স্টেথিসকোপ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন। লোকের ধারণা রোগীর অবস্থা “এখন-তখন” না হলে হরেণ ডাক্তারের স্টেথিসকোপ দিয়ে পরীক্ষা করার দরকার পড়ে না!
ঔষধ কিনতে হলে সেই গঞ্জে যেতে হয়। কারণ আশেপাশের পাঁচ-দশ গ্রামে কোন ঔষধের দোকান নাই। সংগত কারণেই হরেণ ডাক্তারকে প্রেসক্রিপশন লিখে রোগী বিদায় করলে চলে না। ঔষধগুলিও রোগীদের জন্য ব্যবস্থা করতে হয়। অর্থাৎ তাঁর ঐ ব্যাগের মধ্যেই সব ধরণের ঔষধপত্র তাকে রাখতে হয়। হরেণ ডাক্তারকে ফি দিতে হবে, এমন চিন্তা কোন রোগীই করে না! ডাক্তারেরও ফি আদায়ের কোন চেষ্টাই নেই। ফি’র ব্যাপারটা মীমাংসিত।
কিন্তু ঔষধের খরিদমূল্যতো দেওয়া চাই! নইলে এই গরীব ডাক্তারের ফার্মেসিটা চলবে কিভাবে? রোগীদের মধ্যে বারোআনিরই টাকা দেবার সামর্থ্য নেই। তারা ঔষধের বিনিময়-মূল্য হিসেবে গাছের কঁদু, কলা, খেতের মুলো, বেগুন, একহাঁড়ি তাল রস বা পাটালীগুড় অথবা এককুড়ি কইমাছ নিয়ে হাজির! কিন্তু এসব সামগ্রী দিয়ে উদর পূর্তি করা চলে, ঔষধের দোকানতো চালানো যায় না!
একদিন ভর দুপুরে হাঁকডাক ছাড়তে ছাড়তে হরেণ কাকু আমাদের পূবের পোতার ঘরে এসে ঢুকলেন। এই ঘরেরই একপাশে আম্মার শোবার ঘর। বড়বৌমা আছো নাকি, চেয়ারম্যান কোনখানে? আব্বা বোধকরি খবরের কাগজ বা কোন বইটই কিছু একটা পড়ছিলেন। বললেন, আরে হরেণদা তুমি কোথা থেকে? আসো বসো। বসতে বসতেই বললেন, না বমু না চেয়ারম্যান কিছু ট্যাকা দেও, গোপালগঞ্জ যাচ্ছি, ওষুধপত্তর আনোন লাগবো। কবে যাবা দাদা? আরে কয় কি, রওনা অইছি তো! ও আচ্ছা, দেখছি। পাশে দণ্ডায়মান আম্মার দিকে তাকিয়ে আব্বা বললেন, বাদলের মা, ঘরে দেখ টাকাপয়সা যা আছে দাদাকে দাওতো!
খানিকক্ষণ এ আলাপ সে আলাপের পরে আব্বা বললেন, দাদা রোগীদের থেকে ঔষধের দামপত্তর নিও! তুমি এ রকমের দরাজ দিলের হলে ঔষধের দোকান কতদিন চালাতে পারবা? খানিকক্ষণ চুপ থেকে কাকু বললেন, তুই যতদিন বাইচ্যা আছোস, আর আমি যতদিন আছি, -ততদিন চইলবো! বলেই আব্বার কাঁধে তাঁর ডান হাতখানা রেখে চুপ করে বসে থাকলেন। আম্মা বলে উঠলেন, দাদা ওখানে ঘটিতে পানি দিছি, চোখে-মুখে পানি দেন, মেজবৌ খাবার নিয়ে আসতেছে। না-না বড়বৌমা খাওন দিও না, পশ্চিম পাড়ার শেখেগো বাড়িতে খাইছি। অহন আর খাইতে পারুম না।
আব্বার দিকে ফিরে কাকু বললেন, চেয়ারম্যান ছতু শেখের বউডার কালাজ্বর হইছে! হ্যার ডাক্তারি করা আমার কাম না। তারে আমি সাথে কইরা গঞ্জে লইয়া যাইতাছি, পাশ দেওয়া ডাক্তার দেহানো লাগবো। ছতু মারা যাওনের পর হ্যার ছাওয়ালডা আরো খাটাশ হইয়ে উইঠছে। মাডা আইজ একমাস ওইলো জ্বরে কাঁতরাইত্যাছে, পোলাডা এক গেলাশ জলও আগাইয়া দেয়না! এক্কেবারে আলেমের ঘরে জালেম!
আমাদের এলাকার জনগোষ্ঠির শতকরা সত্তরভাগই হিন্দু। আর্থিকভাবেও তারা সচ্ছল। জমিজাতি, ব্যবসা বাণিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সেই সময়টিতে হিন্দুরা এগিয়ে ছিলো। ওদের একটি বিশেষ মহল হরেণ ডাক্তারকে সুনজরে দেখতো না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে নাকি মুসলমানদের ডাক্তার! হিন্দু রোগীদের বসিয়ে রাখে, আর মুসলমান রোগীদের আগে দেখে। মুসলমানদের থেকে ঔষধের টাকাও নেয় না, ইত্যাদি গুরুতর (!) সব অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। একবারতো জিকাবাড়ি গ্রামের কতিপয় হিন্দু সমাজপতি হরেণ ডাক্তারকে নানা অভিযোগে সমাজচ্যুত করার উদ্যোগই নিয়েছিলো। অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে উঠেছিলো যে, ডাক্তারের সমাজচ্যুতি ঠেকাতে আমাদের পরিবারের ঐ ঘটনায় নাক গলাতে হয়েছিলো।
একদিন সাতসকালে বাড়িতে খবর এলো যে, হরেণ ডাক্তার কোন রোগী দেখছে না! ঘরের দরজা আটকে বসে আছে, বাইরেও বেরুচ্ছে না। শতাধিক রোগী তার উঠোনে বসে কাঁতরাচ্ছে। সংবাদ আনয়নকারীকে আব্বা জিজ্ঞাসা করলেন, দাদার কি শরীর খারাপ? না চেয়ারম্যান খুড়ো, অইন্য গুমোর আছে! আব্বা খানিকটা ধমকের সুরেই বললেন, তো গুমোরটা বলো শুনি! সংবাদ আনয়নকারী এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বললো, ওই পশ্চিম পাড়ার ছতু শেখের ছাওয়াল বিল্লাল ভাদাইম্যা ডাক্তার জ্যাডারে ‘মালাউন’ কইছে! হেইর লেইগ্যেই জ্যাডা ফুলছে! এ কথা শুনে আব্বার চোয়াল যেন শক্ত হয়ে গেল, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি! মনে হলো তাঁর মাথায় যেন বজ্রপাত হয়েছে! হুঙ্কার ছেড়ে দফাদার ভাই আর দুজন গোমস্তাকে বললেন, এক্ষুণি ওই শুয়োরটাকে ধরে নিয়ে আয়! হারামজাদা, মানুষের জাত তুলে কথা বলে! তাও আবার হরেণদার মত দেবতুল্যকে নিয়ে! আব্বার অমন অগ্নিমূর্তি জীবনে দ্বিতীয়বার দেখিনি!
গোমস্তা বিল্লাকে পিঠ মোড়া দিয়ে বেঁধে নিয়ে এলো। আব্বা বললেন, বেঁধে এনেছিস কেন, বাঁধন খুলে দে। খুব ছাডাছাডি কইরছিলো হারামজাদাডা, না বাইন্দা ওরে আননই জাইচ্ছিলো না, গোমস্তা বললো। বাঁধন খোলার সাথে সাথে বিল্লাল ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে একহাত দিয়ে আরেক হাতের শক্ত বাঁধনের দাগ পড়া জায়গাগুলো ডলছিলো। আব্বা গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, হরেণদাকে অসম্মান করেছিস কেন? তিনি না এই সেদিন তোর মাকে গঞ্জে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আনলেন?
বিল্লাল যেন ভ্রুক্ষেপই করলো না! আরেক দিকে তাকিয়ে বললো, মালাউনের আবার মান-অপমান কি? হ্যার জন্যইতো বুড়িডা বাইচ্যা উঠলো! সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে আব্বা থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন বিল্লালের চোয়ালে! সাথে সাথেই গোমস্তা আর দফাদারভাই মিলে ওকে বেধড়ক পেটাতে শুরু করলো! আব্বা হাত উঁচু করে ওদের মারতে বারণ করে বললেন, হারামজাদাটাকে গোয়ালে নিয়ে গরুর পাশে বেঁধে রাখ। আর এক্ষুণি ঢোল-সহরত করে এ খবর গ্রামবাসীকে জানিয়ে দে, লোকে জানুক ওর পরিণতি! অতঃপর আব্বা রওনা হলেন হরেণ কাকুর বাড়ির দিকে। যথারীতি তাঁকে অনুসরণ করলো তাঁর সার্বক্ষণিক সাথীরা এবং অঘোষিত নিরাপত্তা দলের দু-তিনজন।
হরেণ কাকুর বাড়িতে পৌঁছুতে বেলা দ্বিপ্রহর হলো। তখনও রোগীদের ভিড় উঠোনে। ডাক্তারের দেখা পাবে, এই আশায় বসে আছে অসহায় মানুষগুলো। বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে আব্বা উচ্চ কন্ঠে ডাকলেন, দাদা দরজা খোল, আমি আইছি। কন্ঠস্বরে ঠিক বোঝা গেল না সেটা অনুনয়, অনুরোধ নাকি আদেশ। কিন্তু দরজা খুলে গেল, অনেকটা যেন দৌড়ে বেরিয়ে এলেন হরেণ কাকু। দণ্ডায়মান আব্বাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলেন। তাঁর কান্নার প্রকাশ-অভিব্যক্তিতে লজ্জা-অপমান-ক্লেশ-ক্রোধ মাখানো। কিছু একটা বলতে চাচ্ছেন কাকু, কিন্তু কান্নার বেগে তা কন্ঠ দিয়ে বেরুচ্ছে না।
আব্বা আর কাকু পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরা। কাকুর বাবরী চুলে আঙ্গুল ঢুকিয়ে বিলি কেটে সান্তনা দিচ্ছেন তিনি। বেশ খানিকক্ষণ পরে একটু থিতু হয়ে কাকু আধো কান্না, আধো কথা মিলিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বললেন, তুই হুনছোস; আমি নাকি ‘মালাউন’? এবার আমারে ভারত ফাডাইয়া দে, অনেক ওইছে, আর না! আবার সে হামলে কাঁদতে শুরু করলো। সে কান্নার বিচ্ছুরণে কোন কষ্ট বা ব্যথার প্রকাশ নয়, শুধু লজ্জা, অপমান ও অসহায়ত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।
আব্বা তার বুক থেকে কাকুর মুখখানা তুলে নিয়ে দুহাত দিয়ে চোখের জল মোছাতে মোছাতে বললেন, দাদা তুমি এমন অবুঝের মত করছো কেন? কোথাকার কোন জাতগোত্রহীন কে তোমায় কি বললো, আর তুমি ঘরের দরজা লাগিয়ে দিলে? চেয়ে দেখোতো দাদা উঠোনের দিকে, এতগুলো অসুস্থ মানুষ সেই ফজরের ওয়াক্ত থেকে তোমার মত একজন পবিত্র ‘মালাউনে’র হাতের ছোঁয়া পাবার জন্য অপেক্ষা করছে!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)