আমাদের কৈশোরে এখনকার মতো বিনোদনের এত সমাহার ছিল না। সিনেমা হলে গিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখা, আর বহু কাঠখড় পুড়িয়ে বড়লোক বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে একটু টেলিভিশন দেখা। এর বাইরে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়-ঝাঁপ। এইতো বিনোদন।
আমি যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সম্ভবত তখন প্রথম টেলিভিশনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখন পুরো এলাকায় টেলিভিশন ছিল হাতে গোণা কয়েকজনের বাসায়। এই টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখার জন্য কতো সাধ্যসাধনা করতে হতো। সব টেলিভিশনওয়ালা বাসায় প্রবেশাধিকার ছিল না। টেলিভিশন দেখার অনুমতিও ছিল না। সব বাধা অতিক্রম করে কোনো বাসায় গিয়ে আসন পাওয়াটাও কঠিন হতো। কেননা তখন টেলিভিশনওয়ালা বাসাগুলোতে দর্শকদের ব্যাপক সমারোহ ঘটতো। গুরুত্বপূর্ণ ও জ্যেষ্ঠ দর্শকদের অতিক্রম করে নিজের জায়গা পাওয়াটা জাতীয় ক্রিকেট দলে স্থান পাওয়ার মতোই কঠিন ছিল। যদিওবা বেড়ালের মতো ঘরের এক কোণায় একটু স্থান জুটতো এর মধ্যে হঠাৎ লোডশেডিং। খানিকক্ষণ অপেক্ষা। তারপর বিফল মনোরথ হয়ে ঘরে ফিরে যাওয়া!
সাদাকালো টিভিতে বিটিভির অনুষ্ঠান দিয়েই আমাদের টিভি দেখা শুরু হয়। ঝাঁপসা ছবি আসত, তাও মাঝে মাঝে হারিয়ে যেত। তবু নাছোড়বান্দার মতো টিভির দিকে তাকিয়ে থাকতাম। একেকটি অনুষ্ঠান দেখে বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইতো না।
এরশাদের আমলে থানাগুলো উপজেলায় রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মফঃস্বলগুলোতে ‘বৈপ্লবিক’ পরিবর্তনের ঢেউ লাগে। তৈরি হয় নতুন নতুন ভবন, রাস্তাঘাট। সেসব ভবন আর রাস্তাঘাট তৈরির কাজে উদ্ভব ঘটে নতুন এক নতুন পেশাজীবী গোষ্ঠী যার নাম ‘ঠিকাদার’। একটা নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠে। সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে নগদ টাকা আসে। সেই টাকায় তারা নিজেরাও পাকা বাড়ি তৈরি করে, মোটরসাইকেল কেনে, তাদের বাড়িতে টিভি আসে। এভাবেই এলাকায় টিভির প্রসার ঘটে, আমাদেরও টিভি দেখার ভাগ্য প্রসারিত হয়।
আমরা উত্তরবঙ্গের মানুষরা কিছুটা ভাগ্যবান ছিলাম। বিটিভির বাইরে আমাদের ওখানে ভারতীয় টিভি চ্যানেল দূরদর্শন দেখা যেত। দূরদর্শনে মাঝে মাঝে বাংলা সিনেমা দেখানো হতো। উত্তম, সুচিত্রা, সৌমিত্র, সুপ্রিয়া, সাবিত্রি, বিশ্বজিৎ, মহুয়া রায় চৌধুরী প্রমুখের প্রথম সিনেমা দেখার সুযোগ হয়েছিল এই দূরদর্শনে।
এই দূরদর্শনেই প্রথম দেখেছিলাম ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’। আর এই সিনেমাতেই প্রথম দেখেছিলাম নায়িকা সুপ্রিয়া দেবীকে। তখন তো আর অত-শত বুঝতাম না। তবে ওই সিনেমার নায়িকার ডাগর চোখের চাহনি, প্রচন্ড দুঃখ-কষ্টের মধ্যে অসম্ভব মায়া জাগানো বেদনাক্লিষ্ট ‘সাদাকালো মুখখানি’ আজও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে!
পরিণত বয়সে যখন সিনেমাটি আবার দেখি, তখন বুঝেছি এই সিনেমার মাহাত্ম্য। এই নায়িকা আর পরিচালকের অসাধারণত্ব। এই ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় দেখা সুপ্রিয়া দেবীকে নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক।
দেশভাগের কারণে দেশান্তরী হওয়ার যে অসীম বেদনা তা পরিচালক ঋত্বিক ঘটক ফুটিয়ে তুলেছিলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’য়, বাস্তুহারা এক স্কুলমাস্টারের পরিবারের মধ্যে দিয়ে। মানুষের, মানুষ হওয়ার লড়াই, টিকে থাকার তাগিদে পিপীলিকার মত যে মাত্রাহীন সংগ্রাম সব কিছুই স্বচ্ছ ভাবে উঠে এসেছিল তাঁর এই ছবিতে। ছবির গল্প এগোয় নীতা নামের এক নিম্নমধ্যবিত্ত মেয়ের পরিচিত কাহিনি নিয়ে। সে সুন্দরী, শিক্ষিতা এবং দায়িত্বশীল। যদিও এই ‘দায়িত্বশীলতা’ আর অন্য সবার ‘স্বার্থপরতা’ তাকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়!
পরিবারের বড় ছেলে শিক্ষিত কিন্তু উদাসীন। গান গেয়ে বড় গায়ক হওয়ার সাধনায় সে ব্যস্ত। পরিবারের দায়িত্ব নিতে সে অপারগ। বড় ভাইয়ের গায়ক হওয়ার এই একগুঁয়েমি বোন নীতার জন্য দুঃসংবাদ হয়ে দেখা দেয়। সংসার চালানোর দায়িত্বটি নীতার কাঁধে চেপে বসে। বাবাও শিক্ষকতা পেশায় ছিলেন নীতার মতোই, জীবনের শেষ দিকে এসে পড়েছেন। ছোটো বোনটারও বিয়ে দেওয়া প্রয়োজন, প্রয়োজন ছোট ভাইয়ের একটা চাকরি। সংসারের কতো প্রয়োজন, কতো আবদার, কিন্তু সেসব পূরণের মানুষ মাত্র একটা। আবার অন্যদিকে বিয়ের অপেক্ষায় বসে আছেন তার স্বপ্নের পুরুষ!
ছবিতে নীতার চরিত্রটি রূপায়ণ করেন সুপ্রিয়া চৌধুরী বা সুপ্রিয়া দেবী। ঋত্বিক ঘটক অপরিসীম সংবেদনশীলতায় তাকে পরিচালিত করেছেন, আর অবিশ্বাস্য শরীরি ভাষায়, কোমল চলন ও নিপুণ অভিনয়ে ছবিটাকে তিনিই টেনে নিয়ে গেছেন ইতিহাস রচনার দিকে।
সিনেমার কাহিনি খুবই সাধারণ, কিন্তু সাধারণ একটা গল্প ঋত্বিক বুনে গেছেন অসাধারণ ভাবে। গল্পে মোড় ঘুরেছে, কষ্টের-সুখের দৃশ্যগুলো এসেছে আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পর্দায় বেজে উঠেছে ধ্রুপদী সুর। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন সিনেমা নির্মাণ সত্যি অভাবনীয়, অসাধারণ!
ঋত্বিক তার এই ছবিতে যেমন চিত্রায়ণ করেছেন রাজনীতি, সমাজ বদলের স্লোগান, একইসঙ্গে তিনি জানিয়ে গেছেন নারী শক্তির জয়গান। নীতা ব্যক্তিগত ত্যাগের শেষ চূড়ায় গিয়েও প্রাপ্য ধন্যবাদটুকু পায়নি। তার সেই আর্তনাদ মাখানো সংলাপ ‘দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম’! সেই ‘বাঁচা’র আকুতিটি সেই সময়ের সকল নারীর কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছে। সমাজে যারা শুধু সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়, তাদের করুণ আর্তিই যেন ঝরে পড়েছিল নীতার কণ্ঠে! ঋত্বিক ঘটক সেই ১৯৬০ সালেই জানিয়েছেন, নীতাদের অবদান, তাদের ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা। নীতারা শুধু ঘর সামলায় না, ঘর বাঁচায়ও। নীতা সেই ঘর বাঁচানো নারীদের অধিনায়ক। তিনি নিজেকে কী করে সংসার রক্ষার যুদ্ধে তিলে তিলে শেষ করে দেয় তারই চিত্রভাষ্য ‘মেঘে ঢাকা তারা।’
ছবিতে ছোটোবোন গীতার বিয়ে হয়ে যায় তারই ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে। মা বাবাও তাই চান। নীতা নিশ্চল বাকহীন। নীতা চলে গেলে যে সংসারের চাকা চলবে না, নীতাহীন সংসার আলোকহীন ঘর। তাই নীতাদের আশা-ভালোবাসা থাকতে নেই। কিছু চাওয়া-পাওয়ারও আবদার করতে নেই। নীতাও সেই আবহমান বাঙালি নারীরই প্রতিমূর্তি, যা দেখতে অভ্যস্ত আমরা পুরুষেরা, এমনকি নারীরাও।
আজও নারীরা সন্তান উৎপাদন আর ঘর-গেরস্থালির সহায়ক ছাড়া আর কিছুই নয়। কী ইউরোপ-আমেরিকায়, কী বাংলাদেশে সর্বত্রই নারীর একই অবস্থা। সিনেমায়ও আমরা নীতাকে একই জায়গায় দেখি। জ্ঞানে-অজ্ঞানেই আমরা নারীকে সচেতনভাবেই মন্ত্র দেই-সয়ে যাও, ‘ঝিনুক নীরবে সহ..!’
কিন্তু ঋত্বিক সেই জায়গাতেই নীতাকে দাঁড় করিয়ে দেন পুরুষতন্ত্রের বিপরীত স্রোতে। নীতার সেই গগণবিদারী আর্তনাদ ‘… দাদা আমি কিন্তু বাঁচতে চেয়েছিলাম …!’ খসে পরে পুরুষালি মুখোশ। ঋত্বিক নীতাকে দাঁড় করিয়ে দেন পুরো পৃথিবীর মুখোমুখী। নীতা আর তখন নীতা থাকে না, হয়ে যায় এক অনিবার্য সত্যের নাম। তখনই হয়তো কোনো কোনো দর্শকের ‘পুরুষালি সত্তায়’ রক্ত চনমন করে উঠে। হয়তো করুণার উদ্রেকও করে। কিন্তু একথা তো সত্যি যে, নীতা এইসব ঠুনকো করুণা কিংবা ‘পুরুষালি সত্তা’কে উপেক্ষা করে যে সত্যকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে তা আজও বর্তমান।
ঋত্বিত ঘটক সেই জায়গাতেই আমাদের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করার তাগিদ সৃষ্টি করেন। আর নীতা চরিত্রটির মাধ্যমে সুপ্রিয়া দেবী হয়ে ওঠেন সেই বঞ্চিত উৎপীড়িত নারীর প্রতিনিধি। এর পর তিনি আরও বেশ কিছু কালজয়ী সিনেমায় অভিনয় করেন। ‘দেবদাস’–এর চন্দ্রমুখী, কিংবা ‘দুই পুরুষ’-এর বিমলা অথবা ‘বন পলাশীর পদাবলী’র পদ্মা, প্রত্যেকটি সিনেমায় তাঁর উপস্থিতি যেন উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে বাঙালি দর্শকের কাছে। উত্তম কুমার থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বাংলার সকল বড় অভিনেতার সঙ্গে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন তিনি।
১৯৫২ সালে নির্মল দে’র পরিচালনায় সুপ্রিয়া দেবীর প্রথম অভিনীত চলচ্চিত্র মুক্তি পায়, নাম ‘বসু পরিবার’। এ ছবির মাধ্যমে তিনি চলচ্চিত্র জগতে পরিচিতি পান। এ চলচ্চিত্রেই সর্বপ্রথম তার নাম পরিবর্তন করে ‘সুপ্রিয়া দেবী’ রাখা হয়। ১৯৫৯ সালে উত্তমকুমারের বিপরীতে ‘সোনার হরিণ’ তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। তারপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সুপ্রিয়া দেবীর বাবা গোপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদি-নিবাস ছিল বাংলাদেশের ফরিদপুরে। তিনি ছিলেন পেশায় ছিলেন আইনজীবী। আইনপেশার কারণেই তিনি বার্মা বা ব্রহ্মদেশ, বর্তমান মিয়ানমারের দুর্গম এলাকা কাচিন প্রদেশে বসবাস শুরু করেন। সেখানের রাজধানী মিয়িৎকিনা শহরে ৮ জানুয়ারি ১৯৩৫ সালে জন্ম নেন এই ‘ব্রহ্মকন্যা’। আসল নাম কৃষ্ণা এবং ডাকনাম বেনু। পর্দায় যিনি সুপ্রিয়া দেবী। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা যখন চারদিকে, তখন সপরিবারে ব্রহ্মদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন সুপ্রিয়া দেবী।
সুপ্রিয়া দেবীর অভিনয়ে অভিষেক ঘটে মাত্র সাত বছর বয়সে, তার বাবার পরিচালিত দুটি নাটকের মাধ্যমে। ছোটবেলা থেকেই নাচের প্রতি আগ্রহ ছিল তার, তার নাচ এতটাই ভালো ছিল যে, তৎকালীন বার্মার প্রধানমন্ত্রী কথাকিন নু তাকে পুরষ্কৃত করেছিলেন। কলকাতায় তার নাচের গুরু ছিলেন গুরু মুরুথাপ্পান এবং পরবর্তীকালে গুরু প্রহ্লাদ দাস।
১৯৫৪ সালে বিশ্বনাথ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের কয়েক বছর পর তাঁর একটি কন্যা সন্তান হয়। তবে বিশ্বনাথের সঙ্গে দাম্পত্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি সুপ্রিয়ার। সে সময় কয়েক বছরের জন্যে ছবির জগৎ থেকে বিরতি নেন তিনি। তারপর আবারও ফেরেন বড়পর্দায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)