যুদ্ধ শুদ্ধ একটা ফ্রন্টে হয় না। হতে পারে না। যুদ্ধের লাগাম তার হাতেই যায়, যারা বেশিরভাগ ফ্রন্টে এগিয়ে থাকে। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সবটা সময়ই মনোবলে এগিয়ে থাকার একটা বড় কারণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র! চট্টগ্রামের অদূরে কালুরঘাটে যা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামে চালু হয়েছিলো, বিপ্লব শব্দের সাথে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের দূরত্ব থেকেই কি না কে জানে, বিপ্লবী শব্দটা ছেঁটে ফেলা হল! স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দুর্দান্তভাবে মোকাবেলা করেছিল প্রতি-প্রচারকে।
বাংলাদেশের যুদ্ধের একটা বড় সুবিধার জায়গা ছিল ভারত। বিতর্ক বা স্বার্থ-অস্বার্থের আলাপ যাই বলা হোক না কেন, ভারতের ভূভাগ ব্যবহারের ফলে অনেক কিছুই সহজে সম্ভব হয়েছে। কালুরঘাট থেকে স্থানান্তরিত হয়ে ভারতের রামগড়ে ২০০ কিলোওয়াট শর্ট ওয়েভে প্রচার শুরু করার পর মে মাসে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে ভারত সরকারের সহায়তায় ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ক্ষমতা নিয়ে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ৫৭/৮নং দোতলা বাড়িতে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল। এই বাড়িটিই শেষ পর্যন্ত ছিল স্থায়ী ঠিকানা হয়ে।
এখান থেকেই প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। প্রচারিত হতো তুমুল জনপ্রিয় ‘চরম পত্র’সহ মুক্তিযুদ্ধের গান, যুদ্ধক্ষেত্রের খবরাখবর, রণাঙ্গনের সাফল্যকাহিনী, সংবাদ বুলেটিন, ধর্মীয় কথিকা, বজ্রকণ্ঠ, নাটক, সাহিত্য আসর এবং রক্তের আখরে লিখি ইত্যাদি অনুষ্ঠান।
স্বাধীন বংলা বেতার কেন্দ্রের নিউজ-ইন-চার্জ কামাল লোহানি তার একটি লেখায় বলেন, “বাংলার মানুষের মরণজয়ী মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ (Psychological Warfare) এর প্রধান অস্ত্র।” যুদ্ধ শুদ্ধ বন্দুক দিয়ে হয় না, এটা একটি মনস্তাত্ত্বিক লড়াইও। যে যুদ্ধেও বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে খুব সামান্য যন্ত্র কম লোকবল নিয়ে, প্রচণ্ড পেশন থেকে।
যুদ্ধ ক্ষেত্রে রেডিও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটা প্রাসঙ্গিক বিষয় মনে করা যেতে পারে। বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানিদের বিপক্ষে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে, সেই সময়টাতেই বাংলা ভাষাভাষী অংশেই চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল ও জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখের নেতৃত্বে চলছিল নকশালবাড়ি আন্দোলন। নকশালদের প্রতিনিধি দল চীনে গেলে চীনের কাছে একটা রেডিও স্টেশন স্থাপনের যন্ত্রপাতি চেয়েছিল। কিন্তু নিরাপদ ঘাঁটি অঞ্চল না থাকায় নকশালরা রেডিও স্থাপন করার মতো ইকুপমেন্ট পায় নি। অনেক কারণের এটাও একটা কারণ হতে পারে নকশালবাড়ি আন্দোলন আরও ইফেকটিভ না করতে পারার। আরেকটা কথা মনে করা যায় কিউবা বিপ্লব নিয়েও। বাতিস্তাকে হটিয়ে হাভানা যখন ক্যাস্ট্রোদের নিয়ন্ত্রণে, তখন আমিরিকা থেকে এক আচমকা ঘোষণা আসে, কিউবা নতুন সরকার গঠন করা হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় সেখানে ক্যাস্ট্রোদের নাম নিশানা নাই! এর পর দ্রুত ফিদেল রেডিও স্টেশনে যান এবং ভাষণ দেন।
দুইটা প্রসঙ্গ তোলার কারণ স্পষ্ট। প্রচার যন্ত্র জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়, মনোবল ভেঙে দেয়, আতঙ্কিত করে। নিজেদের প্রচার যন্ত্র না থাকলে যুদ্ধের একটা অংশে পিছিয়ে পড়তে হয়। আমাদের সৌভাগ্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মতো একটা পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত রেডিও স্টেশন আমাদের ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এবং যুদ্ধের ইতিহাস চর্চার বড় একটা অংশও রেডিও। এমন কি যুদ্ধ প্রশ্নে এখনও প্রধান বিতর্কের একটা রেডিওকে কেন্দ্র করেই!