চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং নারীর অগ্রযাত্রা

পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল,যেসকল শোষণ, বঞ্চনা, বৈষম্যে ও পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী বাঙালি জাতি নিষ্পেষিত হয়েছিল, সেই শৃঙ্খল ভেঙে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জন আমাদের স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব। স্বাধীনতা মানে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার চিরন্তন প্রয়াস। স্বাধীনতা মানে চিন্তার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি। সবুজের জমিনে রক্তিম সূর্যখচিত মানচিত্রের এ দেশটির সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে বাঙালি জাতি। বিজয় অর্জনের পর ৫০ বছরের পথচলায় দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্য আর দুর্যোগের বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।।‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ দেশ থেকে এক আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ যেন। সুকান্তের ভাষায়: ‌‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’।

সত্যি,এই পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশের অর্জন একেবারেই কম নয় এখন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়েছে বাংলাদেশ। আর এই অগ্রযাত্রায় নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকারও সুসংগঠিত হয়েছে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা আজ শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ নেই, নারীরা পৌঁছে গেছেন বিমানের ককপিট থেকে পর্বতশৃঙ্গে।

দশভুজা নারী ঘরে-বাইরে নিজেকে আলোকিত করছেন নিজ প্রজ্ঞা আর মেধা দিয়ে। বর্তমানে এমন কোনো পেশা নেই যেখানে নারীর মর্যাদাপূর্ণ উপস্থিতি নেই। নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে লিঙ্গ সমতার প্রতিচ্ছবি যা একটি দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন।

বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বপ্রথম দেশ হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা অর্জন করেছে। এমনকি মাধ্যমিক শিক্ষায়ও আমাদের এই সাফল্য রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৮ মিলিয়ন। এদের মধ্যে ৯৭.৯ শতাংশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, যাদের ৫০.৯ শতাংশ আবার মেয়ে শিক্ষার্থী। আর মাধ্যমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ হার ৫৩ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালেও দেখা যায় মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নতির দিকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২০ সালে দেশের মোট শিক্ষার্থীর ৪৫.২৭ শতাংশ ছিল মেয়ে শিক্ষার্থী।

নারীর ক্ষমতায়নের সাথে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা, অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ।

বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে এবং পুলিশ বাহিনীতে সৈনিক এবং অফিসার পদে মহিলাদের অংশগ্রহণ, গার্মেন্টস শিল্পে বিশাল সংখ্যক নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ,বাল্য বিবাহ নিষিদ্ধ করার ফলে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার এবং কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলির অবলুপ্তি, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ফলে অসংখ্য সন্তান জন্মদানের মতো বিষয়ের সমাধান, শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে এখন নারীদের অংশগ্রহণ শতভাগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আগের তুলনায় নারীর অংশগ্রহন নিশ্চিত করা, সংবাদপত্র মিডিয়া ইত্যাদি চ্যালেঞ্জিং কাজে নারীদের পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাওয়া এবং সর্বোপরি নারী ও শিশু নির্যাতন আইন এবং পারিবারিক সহিংসতা দমন আইন প্রণয়নের ফলে সমাজে নির্যাতিত নারীরা আগের তুলনায় অনেক বেশি আইনি সহায়তা পাচ্ছেন।

নারী দিবসের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন: ‘বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন অর্থনৈতিক অগ্রগতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য; শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ব্যবসা এবং নীতিনির্ধারণের মতো জায়গায় লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাস করা।” সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষাদানের কথা উল্লেখ করেন তিনি।

এসব ক্ষেত্রে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গেলেও তা সন্তোষজনক নয়। স্বাধীনতার এত বছর পরেও নারীর সম অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাঙ্খিত প্রত্যাশা পূরণ হয়নি শতভাগ। নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্রের অভাব ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পিছিয়ে দিচ্ছে নারীর উন্নয়ন যাত্রাকে। নারীর ক্ষমতায়নের পথে অন্যতম বাধা হলো নির্যাতন ও সহিংসতা।গবেষণার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ঘরে ও বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই নারী অনেক বেশি নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বেড়ে ওঠে। নির্যাতনের ফলে ব্যক্তি নারীর শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতনের পাশাপশি গোটা পরিবারই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর নির্যাতনের দুষ্টচক্র গড়ে ওঠে।তাই নির্যাতন প্রতিরোধে পরিবার থেকেই নারী-পুরুষের দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে।

নারীর সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং নারীর অর্থনেতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে জরুরি বিষয়গুলো হচ্ছে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কারিগরি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উত্তরাধিকার, সম্পদ, উপার্জনের সুযোগ ইত্যাদি। আমাদের দেশের নারীরা এখনও এসব ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে।

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাটি এখনও নারীবিরোধী নেতিবাচক সমাজ মনস্তত্ত্ব। আমাদের সমাজে এখনও এই ন্যারেটিভ জনপ্রিয় যে, নারীর প্রাথমিক কাজ ঘর-সংসার দেখে রাখা। দুঃখজনকভাবে আমরা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় নির্বিশেষে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই এখনও নির্যাতনমুক্ত করতে পারিনি, যা অনেক সময়ই প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়েই মেয়েদের শিক্ষা সমাপ্তির একটা অজুহাত হয়ে ওঠে। সোনাগাজীতে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের হয়রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় পরীক্ষা চলা অবস্থায়ই অভিযোগকারী শিক্ষার্থী নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদে কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। এ ঘটনায় দেশব্যাপী যে আলোড়ন ওঠে তাতে বিচারের উদ্যোগ আশানুরূপ গতি পায়। সম্প্রতি বাল্যবিয়ে বন্ধে আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে নানা কারসাজি করে এখনও যে বাল্যবিয়ে হচ্ছে, তা ওই নারীর ক্ষমতায়নবিরোধী সমাজ মনস্তত্ত্বের কারণেই।এছাড়াও ধর্মীয় গোঁড়ামী নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা যদিও ছিল একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠন। বাংলাদেশের সংবিধান দ্বারাও তা স্বীকৃত। কিন্তু প্রায় ৫০ বছরেও তা আমরা বাস্তবায়ন করতে পারিনি পুরোপুরিভাবে। ‘নারীমুক্তি তখনই সম্ভব যখন নারীরা সমাজের প্রতিটি কর্মকাণ্ডে সমগুরুত্ব নিয়ে অংশগ্রহণ করবে।’ তাই নারীর নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, নারীর প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও নারী-পুরুষ উভয়ের অন্তর্ভুক্তিতেই উন্নয়নের দেখা পাওয়া সম্ভব। এভাবেই নারীরা এগিয়ে যাবেন, তাদের ভবিষ্যৎ হবে কণ্টকমুক্ত।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)