চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ দ্বন্দ্ব চিরতরে শেষ করতে তিনটি করণীয়

নৃশংস আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল রেখেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। এই রায়ে স্বস্তি প্রকাশ করেছে মুক্তিকামী প্রতিটি মানুষ। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের প্রধান নিজামীর নেতৃত্বে এবং ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে ঘঠিত আলবদর বাহিনীর সবচেয়ে বড় অপকর্ম ছিলঃ বাঙালিকে মেধাশূন্য করার জন্য নীলনকশা করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য গঠিত আলবদর বাহিনী নিজামীর নেতৃত্বে হত্যা করে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।

জামায়াত-বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী জোট ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করলে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত সরকার এই দানবকে মন্ত্রী বানায়। স্বাধীনতার শত্রু, লক্ষ শহীদের হত্যাকারীদের অন্যতম এই ঘাতক দোর্দণ্ড প্রতাপে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে রঞ্জিত জাতীয় পতাকা শোভিত গাড়িতে দাবিয়ে বেড়ায় স্বাধীন বাংলাদেশে। যে বাংলাদেশকে আঁতুড় ঘরেই হত্যা করতে চেয়েছে নিজামী ও তার দল যুদ্ধাপরাধী সংগঠন, জামায়াতে ইসলামী।

নিজামীর ফাঁসির রায় বহাল থাকার প্রতিক্রিয়ায় শহীদ বুদ্ধিজীবী জায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী বলেছেন, “নিজামীকে যখন দেখতাম আমার স্বামীর রক্ত রঞ্জিত পতাকা নিয়ে চলছে তখন মনে হত ঐ গাড়ি আমার বুক চিরে চলে যাচ্ছে”। নিজামীর আপিল নিষ্পত্তির পড় ট্রাইবুন্যালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে করা যে সব আপিল সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঘাতক মীর কাশেম ও ঘাতক আব্দুস সোবহান। ট্রাইবুন্যালে বিচারাধীন রয়েছে কয়েকশ মামলা।

তবে তার মধ্যে আর কোন হেভিওয়েট ঘাতক নেই। মীর কাশেম ও সোবহানের দণ্ড কার্যকর হয়ে গেলে একাত্তরের ঘাতকদের সীমাহীণ অপরাধের বিচার কার্যের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটবে। দ্বিতীয় পর্বে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে একে একে জীবিত সকল ঘাতকের বিচার সম্পন্ন হতে থাকবে। সব কয়টি ঘাতকের বিচার কাজ সম্পন্ন করার মধ্যদিয়ে ঘটবে ইতিহাসের দায়মুক্তি।

বাঙালি জাতি দীর্ঘ ৪৪ বছরের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে; বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। ঘাতক নিজামীকে ২০১০ সালে ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে আটক করা হয় পরবর্তীতে ট্রাইবুন্যাল তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী করলে তাকে মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১২ সালে ট্রাইবুন্যাল তার বিচার শুরু করে এবং ২০১৪ সালে রায় দেয়। ২০১৬ সালে তার আপিল নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগ। রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রার্থনা পর্ব শেষ করতে আরও কয়েক মাস লেগে যাবে। অর্থাৎ তার বিচার সমাপন করতে চার বছর সময় লাগছে।

অন্যান্যদের ক্ষেত্রেও একই রকম সময় লাগছে। বর্তমানে চালু একটি ট্রাইবুন্যালে বিচারাধীন পাঁচ শতাধিক মামলা নিষ্পত্তি হয়ে রায় কার্যকর হতে কত সময় লাগবে তা এই মূহুর্তে প্রাক্কলন করা অত্যন্ত কঠিন। তবে ট্রাইবুন্যালের সংখ্যা না বাড়ালে আরও বেশ কয়েক বছর যে লেগে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। একটি ট্রাইবুন্যাল এর মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেও পরে তা বাড়িয়ে দুইটি করা হয়।

ঘাতক কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর হওয়ার পর হঠাৎ করে অনেক মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে, এখন আর দুইটি ট্রাবুন্যালের দরকার নেই – এরকম কথা বলে একটি ট্রাইবুন্যাল বন্ধ করে দেয়া হলে ট্রাইবুন্যালের সংখ্যা আবার একটি হয়ে যায়। একটি ট্রাইবুন্যালের পক্ষে বিচারাধীন পাঁচ শতাধিক মামলা আগামী পাঁচ/সাত বছরের মধ্যে সামলানো কোন মতেই সম্ভব নয়। বিচার শুরু হওয়ার আগেই প্রাকৃতিক নিয়মে একাত্তরের বহু ঘাতকের জীবনাবসান হয়েছে। একটি ট্রাইবুন্যাল দিয়ে এই গতিতে বিচার কাজ চললে এখনো যেসব ঘাতক এখনো জীবিত আছে তারাও পার্থিব বিচারকে পাস কাটিয়ে অপার্থিব জগতে যাত্রা করবে।

একাত্তরের ঘাতকদের বিচার সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে আপনা-আপনি একাত্তরের চেতনায় বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হয়ে যাবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। দেশে এখনো ক্রিয়াশীল রয়েছে একাত্তরের ঘাতকদের দোসর, রক্ষক, পরবর্তী প্রজন্ম; আর রয়েছে এদের ৭৫ হাজার কোটি টাকার অর্থনীতি। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতের ঔরসে জন্ম নেয়া বিএনপি তাদের জন্মলগ্ন থেকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তী সময়ে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া স্বাধীনতা বিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।

তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা দরকারঃ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাকে বিতর্কিত করা; শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করা; শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি অসম্মান মূলক উক্তি করা; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের অসম্মান, অশ্রদ্ধা করা; মুক্তিযুদ্ধের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তি করা; জামায়াত, মুসলিম লীগসহ সকল নিষিদ্ধ স্বাধীনতা বিরোধী দলকে রাজনীতি করার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া; নাগরিকত্ব বাতিল হওয়া যুদ্ধাপরাধীকুল শিরোমণি গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনা; মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা, সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসনে পাকিস্তানপন্থীদের উচ্চ পদে নিযুক্ত করা; স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রী বানানো; যুদ্ধাপরাধীদের যুদ্ধাপরাধী নয় বলে প্রচার করা; যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত ট্রাইবুন্যালকে বিতর্কিত করা; যুদ্ধাপরাধীদের রাজবন্দী নামে আখ্যায়িত করা; যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গণজাগরণে যোগ দেয়া মানুষদের ‘নাস্তিক’ ও ‘নষ্ট ছেলে’ বলে অভিহিত করা; ট্রাইবুন্যালের রায়ের বিরুদ্ধাচারণ করে জামায়াতের ডাকা হরতালে নৈতিক সমর্থন দেয়া; যুদ্ধাপরাধীদের সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত করা; রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের সম্পদের পাহাড় তৈরীতে সাহায্য করা।

মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং আমেরিকার সঙ্গে ঘোঁট পাকানো বিএনপি নেতাদের এসব কাজের জন্য শাস্তি দেয়া না হলে ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের ভিত্তি নিয়ে এই বিতর্ক চলতে থাকবে যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ণ করার পথে বিপুল বাঁধা সৃষ্টি করছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় লুটপাট করে অর্জন করা ধন-সম্পদ এবং স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অর্জিত সম্পদ রয়েছে যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের পরিবারগুলোর হাতে।

সরকারী জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বহু যুদ্ধাপরাধীর নামে। শীর্ষ ঘাতকদের রাষ্ট্রীয় কাজে অমূল্য অবদার রাখার নামে দেয়া হয়েছে গুলশান, বনানী এবং উত্তরার মত অভিজাত এলাকার জমি। তাদের জন্য বানানো হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ঔষধ কারখানা, ব্যাংক, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে এদের হাতে ৭৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে যা থেকে প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মুনাফা আসে। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা; ব্যয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী কর্মকাণ্ডে, ভয়ংকর জঙ্গিবাদে। স্বাধীনতা বিরোধীদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কোন শ্রদ্ধা নেই। তাদের কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা সবই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। তারা সাম্প্রদায়িক মৌলবাদে, জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী।

এদের মধ্যে নেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি টান। এরা পাকিস্তানী সংস্কৃতি এবং ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। যতদিন এদের নির্মূল করা না যাবে ততদিন চলতে থাকবে স্বাধীনতার পক্ষ এবং বিপক্ষ শক্তির দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশই পৃথিবীর বুকে একমাত্র দেশ যেখানে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার পরেও স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে চলতে হচ্ছে। এই দ্বন্দ্ব বিকাশের নয় ধ্বংসের। পাকিস্তানী উপনিবেশের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পরেও চুয়াল্লিশ বছর ধরে চলমান এই দ্বন্দ্ব বাংলাদেশের অগ্রগতি ব্যহত করছে। বাঙালি শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, কর্ম উদ্দীপনায় পৃথিবীর যে কোন জাতির সঙ্গে তুলনাযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির দ্বন্দ্ব বাংলাদেশকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসছে না। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে তথাকথিত আন্দোলন – হরতাল, জালাও, পোড়াও। এই দ্বন্দ্ব শেষ করার এখনি উপযুক্ত সময়।

স্বাধীনতা বিরোধীদের নির্মূল করতে পারলে বন্ধ হবে অহেতুক জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী দেশি এবং বিদেশী শক্তি ‘৭৫ পরবর্তী যেকোন সময়ের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে দূর্বল অবস্থায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিও এখন বাংলাদেশের অনুকূল। এমতাবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তিগুলোকে নির্মূল করার জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার পাশাপাশি দরকারঃ (১) সকল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সংগঠনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা; (২) যুদ্ধাপরাধীদের স্থাবর, অস্থাবর সকল সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে তা মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করা; এবং (৩) মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও স্বাধীনতা বিরোধীদের সমর্থন, পৃষ্টপোষকতা দানকারীদের শাস্তির বিধান করে ইউরোপের ১৩টি দেশের হলোকাষ্ট ডিনায়াল আইনের অনুরূপ আইন প্রণয়ন করা।

২০০৯ সালে বর্তমান সরকার গঠিত হবার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো তৈরী করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল গঠন করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ব্যবস্থা করে, দেশি-বিদেশী ব্যাপক চাপ অতিক্রম করে বিচার কার্য পরিচালনায় আদালতকে সর্বাত্বক সহযোগিতা দিয়ে এবং রায় কার্যকর করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ দ্বন্দ্ব নিরসনে সবচেয়ে কঠিন কাজটি ইতোমধ্যে করে ফেলেছে। বাকী তিনটি কাজ সম্পন্ন হলে তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীলতা এনে দিতে পারবে – এ প্রত্যাশা স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত প্রতিটি মানুষের।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)