১৯৬৬ সনের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হওয়া দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশের ইতিহাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা, রাজনীতিতে এ বিশ^বিদ্যালয়ের অগ্রগণ্য ভূমিকা বাঙালি জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে কৃতার্থ চিত্তে স্মরণ করে। প্রথিতযশা এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ৫৬তম বর্ষে সগৌরবে স্বমহিমায় পদার্পণ করল এবং একই সঙ্গে দেশের প্রতি প্রতিষ্ঠানটির দায়বদ্ধতার জায়গাও স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেল। দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা, ক্রীড়া নৈপুণ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করা প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে জাতি গঠনে সাহসী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা অর্জন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকার বয়ান সর্বজনবিদিত।
শুধু মহান মুক্তি সংগ্রাম নয়, দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করবার প্রয়াসে গণতান্ত্রিক প্রত্যেকটি আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা সর্বজনগ্রাহ্য। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন এমন প্রথিতযশা অধ্যাপকগণ দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, গবেষণা ও রাজনীতিতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। দেশের যে কোন জায়গায় ঘটে যাওয়া অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সুসংহত অবস্থান সর্বত্র। কাজেই সার্বিকভাবে শিক্ষা ও গবেষণায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান অগ্রগণ্য। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পৃথিবীখ্যাত নামকরা স্কলারশীপ নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন এবং ডিগ্রী গ্রহণ শেষে দেশে ফিরে গবেষণায় আত্ননিয়োগ করছেন। শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গমন করছেন এবং বিশ^বিদ্যালয় ও দেশের মর্যাদা বিশ্বর কাছে প্রতিনিয়ত উজ্জ্বল করছেন। কাঙ্খিত ডিগ্রী গ্রহণ শেষে সৃষ্টিশীল গবেষণায় আন্তনিয়োগ করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সুবিশাল কার্যক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রার সোপানে নতুন নতুন পালকের সংযোজন ঘটাচ্ছে, বিস্তৃতির পাশাপাশি গুণগত মান বৃদ্ধির উপরও জোর দেওয়া হচ্ছে। একাডেমিক সাফল্যে বহু শিক্ষার্থী স্বর্ণপদক প্রাপ্তির গৌরব অর্জন করছেন। ২৩২১ একর জায়গার উপর অবস্থিত বিশ^বিদ্যালয়টিতে বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৫২টি, অনুষদ ১০টি, ছেলেদের জন্য ৯টি হল, মেয়েদের জন্য ৫টি হল, হোস্টেল ১টি, গবেষণা কেন্দ্র ৫টি, অধিভুক্ত অনুষদ ১টি, শিক্ষকের সংখ্যা ৯০৭ জন, শিক্ষার্থী ২৭৫৫০ জন, কর্মকর্তা ৩৭৬ জন, কর্মচারী ১৫৯৮ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল ও আধুনিক করার স্বার্থে অনুষদগুলো বিভিন্ন সময়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করছে। অনুষদ থেকে বিভিন্ন ইস্যু ভিত্তিক জার্নাল বের হচ্ছে এবং শিক্ষকদের মৌলিক গবেষণাগুলো যাচাই বাছাইয়ের পরে জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে। শিক্ষা কার্যক্রমে নতুন নতুন একাডেমিক কারিকুলাম সংযুক্ত করে শিক্ষার মানকে যুগোপযোগী ও বৈশ্বিক মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করছে। চালু হচ্ছে অত্যাধুনিক সব ডিসিপ্লিন ও অনুষদের কার্যক্রম।
প্রকৃতি সম্পূর্ণ উজাড় করে দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে, অপার সৌন্দর্যে যে কেউই মুগ্ধ হবেন নিমিষেই। সবথেকে বড় বিষয় হচ্ছে, প্রকৃতিভিত্তিক গবেষণার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় যে কোন গবেষকের জন্য হতে পারে তীর্থস্থান। সে সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বোটানিক্যাল গার্ডেন, কাঁটা পাহাড়ের রাস্তা, শহীদ মিনার, বুদ্ধিজীবী চত্ত্বর, জয় বাংলা ভাস্কর্য, চালন্দা গিরিপথ, কলা অনুষদের ঝর্ণা, স্লুইস গেইট, খেলার মাঠ, মাইজভান্ডারী কেন্দ্রীয় মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডাসহ নান্দনিক স্থাপনায় প্রকৃতিগতভাবে চবি সমৃদ্ধ। চবির সৌন্দর্যকে আরো প্রসারিত করেছে ঐতিহ্যের বাহন চবির শাটল ট্রেন। এ ট্রেনকে মঞ্চস্থ করেই শিক্ষার্থীদের কত শত স্মৃতির বহর শোনা যায়, প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা শাটলের স্মৃতি রোমন্থন করেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। শাটল ট্রেন ধরার ব্যস্ততা, শাটল মিস হয়ে গেলে ভোগান্তিতে পড়া, শাটলে বসে ক্লাশ পরীক্ষার পড়া তৈরি, রাজনৈতিক আলোচনা, বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ এসবই শিক্ষার্থীদের পুলকিত করে সময়ে অসময়ে।
প্রতিদিন বিকালে খেলার মাঠের দক্ষিণ পাশের সুবিস্তৃত জায়গায় গাছপালা সমেত পাখির কিচিরমিচির শব্দে প্রত্যেকেই মনোমুগ্ধ হয়ে পড়েন। হলফ করে বলা যায়, এখানে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আশ্রয় রয়েছে, পাখি প্রেমী ও পাখি গবেষকদের জন্য এটি পরম পাওয়া। এছাড়াও হরিণ, বানর, শকুড়, অজগরসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী ও সাপের অভয়ারণ্য চবি ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসস্থ পাহাড়ে নানাবিধ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে, রয়েছে ওষধি প্রজাতির নানা ধরনের বৃক্ষ। এসব থেকে চিকিৎসকরা ও গবেষকগণ তাদের গবেষণার ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে পারেন। মোদ্দা কথা হচ্ছে চবির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যে কেউই বিমুগ্ধ হবেন, এককথায় উচ্চ শিক্ষা পঠন-পাঠনে যে ধরনের সৃষ্টিশীল, প্রাকৃতিক ভারসাম্যপূর্ণ ও গুরুগম্ভীর পরিবেশের প্রয়োজন রয়েছে চবিতে সবটার উপস্থিতি বিদ্যমান।
শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠার প্রত্যয়ে সহ শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপক ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভাগভিত্তিক ও অনুষদ ভিত্তিক নানা ধরনের আয়োজন পরিলক্ষিত হয়ে থাকে বছরব্যাপী। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন উৎসবে ও বিশেষ আয়োজনে তাদের পারফরম্যান্স প্রদর্শন করে থাকে। এছাড়াও যে কোন ধরনের যৌক্তিক বিষয়ে প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে মানববন্ধনসহ অন্যান্য কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে থাকেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতৃত্বগুণ বিকাশের অন্যতম প্রধান অনুসঙ্গ হচ্ছে সহ শিক্ষা কার্যক্রম। সে বিবেচনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ কেননা এখানে প্রত্যেক সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংগঠনের উপস্থিতি বিদ্যমান। সেজন্যই, শিক্ষার্থীদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ চবি ক্যাম্পাসে বিভিন্নভাবে বিদ্যমান।
বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যেক বছর কেন্দ্রীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ চমৎকার উৎসবের আয়োজন করে থাকে। শুরুর দিকে প্রত্যেক হল থেকে বিভিন্ন ইভেন্টে চ্যাম্পিয়নদের বাছাই করে কেন্দ্রীয় বাছাইয়ের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ সময়টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালেয়ের সাজসজ্জায় উৎসবের আমেজ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কেন্দ্রীয় আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ক্রীড়াবিদকে বাছাই করা হয়। হল এবং কেন্দ্রীয়ভাবে বিজয়ীদের পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। উল্লেখ করার মতো বিষয় হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। আন্ত: বিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অব্যাহত সাফল্য বিশ্ববিদ্যালয়কে মর্যাদাকে সমুন্নত করে।
শিক্ষকদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান, গবেষণা কার্যক্রমে উৎসাহ প্রদান, গবেষণা প্রস্তাবনা তৈরি, একক ও যৌথ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। বিশেষ করে আইকিউএসি প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে নব্য যোগদানকৃত শিক্ষকদের গবেষণা প্রস্তাবনা তৈরি, এসপিএসএস সফটওয়্যারের ব্যবহারবিধি, বিদেশে উচ্চশিক্ষার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা, টিচিং মেথডসহ নানাবিধ বিষয়ে অভিজ্ঞ প্রফেসরদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় আয়োজনে শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করে শিক্ষকদের নেতৃত্বগুণ বিকাশের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
এছাড়াও, গবেষণা পরিচালনা ও প্রকাশনা দপ্তর নিয়মিতভাবে গবেষণা প্রবন্ধ আহবান করে শিক্ষকদের নিকট হতে গবেষণা প্রস্তাবনা সংগ্রহ করে গবেষণা কাজ সম্পাদনে আগ্রহী করে তুলছে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মূল কাজই হচ্ছে গবেষণা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা অব্যাহতভাবে এ সেলের অধীনে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কর্ম সম্পাদন করছেন। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাঙ্কিং এ সম্মানজনক অবস্থানের জন্য গবেষণাকৃত আর্টিকেলের বিকল্প নেই, সে প্রেক্ষিতে বিশবিদ্যালয় গবেষণা কার্যক্রমে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের গবেষণাকর্মে উদ্বুদ্ধ করছে। যদিও গবেষণার বাজেট নিয়ে ঘাটতি রয়েছে তথাপি শিক্ষকেরা নিজ দায়িত্বে উদ্যোগী হয়ে গবেষণা সেলের সহযোগিতায় প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য হারে গবেষণা সম্পাদনা করছেন।
অপার সম্ভাবনার এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু সমস্যাও রয়েছে। সমস্যাগুলো সমাধানে ব্রতী হলে এ বিশ্ববিদ্যালয় সমগ্র বিশ্বে মর্যাদার আসন খুব সহজেই পাকাপোক্ত করতে পারবে। প্রতিষ্ঠার এত বছর পরেও বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিয়ে নতুন হল নির্মাণ করতে হবে, হলের মধ্যকার গণরুমের সংস্কৃতি দূর করতে হবে। উল্লেখ্য, যে সকল শিক্ষার্থীরা শহরে থাকেন তাদের যাতায়াতের অন্যতম প্রধান বাহন শাটলের শিডিউলের রকমফের হলে যাতায়াত যেমনিভাবে ব্যয়সাপেক্ষ তেমনিভাবে সময়সাপেক্ষ বিষয়। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের আবাসন সমস্যাও দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বহুতল ভবন নির্মাণ করে আবাসন সমস্যা দূর করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ গ্রহণই পারে শিক্ষা, গবেষণায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুজ্জ্বল অর্জনকে সমুন্নত রাখতে।