কানাডার মেনিটোবা প্রদেশের রাজধানী উইনিপেগ শহরে জুলাই ২৮, ১৯৫৮ সালে জন্ম নিয়েছিল একজন স্বপ্ন বালক, তার নাম টেরি ফক্স। পিতা রোলান্ড ফক্স এবং মাতা বেটি ফক্স। টেরির বয়স যখন আট বছর তখন তার পিতা-মাতা তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে মেনিটোবা থেকে চলে আসে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার পোর্ট কোকুইটলাম শহরে। সেখানেই ওরা বড় হতে থাকে। ফ্রেসার ও পিট নদীর মোহনায় অবস্থিত এই সুন্দর শহরটির সংক্ষিপ্ত নাম ‘পোকো’।
টেরির বাবা চাকরি করতেন রেল কোম্পানিতে। শিশুকালেই টেরি খুব গোছালো স্বভাবের ছিল। জ্বালানির জন্য গাছের কাটা গুড়ি বেশ কষ্ট করে তাকেতাকে সাজাতে পারত। একটা গুড়ি পড়ে গেলে ধরে ধরে জায়গা মত তুলে দিত দক্ষতার সাথে। বাবা মায়ের শেখানো আদব কায়দা মেনে বড়দের নামের আগে সম্মান সূচক সম্বোধন করতে টেরির কোন তুলনা ছিল না। স্কুল থেকে এসে খেলতে যাওয়ার আগে ওদের সব ভাইবোন জামা কাপড় বদলিয়ে তারপর মাঠে যেত। টেবিল মেনার্স পালনেও ছিল খুব যত্নবান। খাবার টেবিলে হাত উঠিয়ে কখনো বসতো না। কাঁটা ছুড়ি ব্যবহারে শব্দ হতো না। খাবার সময় ওদের কারোর মাথায় হ্যাট থাকতো না। অল্প বয়স থেকেই চেরি বাগানে কাজ করে নিজেদের হাত খরচ জোগাড় করতে শিখে গিয়েছিল ওরা। এছাড়াও টিন-এজ হতেই পছন্দের জিনিস নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়েই কিনতে পারতো। মায়ের উৎসাহে টেরি খেলাধুলাতে জড়িয়ে যায়। ছোটবেলায় টেরি পরাজয় সইতে পারতো না তাই অক্লান্ত চেষ্টা করতো খেলাধুলায় ভালো অবস্থানে থাকতে। ফুটবল, রাগবি, বেসবল বাস্কেটবল সব কিছুতেই ছিল তার দক্ষতা। এভাবেই সুখে শান্তিতে দিন কাটছিল ফক্স পরিবারটির।
টেরি ছিল খুব ইন্টোভার্ট। ক্লাসের মেয়েদের দেখলেই লাল হয়ে যেত। স্কুলে তার প্রিয় বন্ধু ছিল ডাগ আলওয়ার্ড। সেও ছিল লাজুক প্রকৃতির এবং টেরির মতই তুলনামুলক ভাবে খাটো প্রকৃতির। খেলাধুলাতে দুজনেরই ছিল চমৎকার পারফর্মেন্স। টেরি ও তার বন্ধু ডাগকে ওদের কোচ অনেক উৎসাহ এবং সুযোগ দিত যাতে ওরা বিভিন্ন গেমসে অংশ নিতে পারে। হাইস্কুলে উঠেও ওরা ভালো করলো। নিয়ে আসতে লাগলো একের পর এক পুরস্কার। ক্রস কান্ট্রি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেয়। দু’জনেই মন দিয়ে বায়োলজি পড়তো আবার দু’জনেই দৌড় প্রতিযোগিতার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতো। প্রায় সবগুলো সাবজেক্টে ‘এ’ পেয়ে টেরি হাইস্কুল ছাড়ে। এরপর গেল সাইমন ফ্রেজার ইউনিভার্সিটিতে। ইচ্ছা ছিল ভাল করে বাস্কেটবল খেলবে এবং শারীরিক শিক্ষক হবে। যাতে করে সে ভাল কোচ হয়ে নতুন নতুন সম্ভাবনাময় মুখ বের করে আনতে পারে ট্রাক এন্ড ফিল্ডে।
একটা গাড়ী দুর্ঘটনার পর আস্তে আস্তে টেরির পায়ে ‘ওস্টিওসারকোমা’ নামক ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। ডাক্তার বলে দিয়েছিল মরা বাঁচার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। এসবের জন্য টেরি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এমন কি বয়স হয়েছে যে তাকে জীবনের বাইরে অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে হবে। তবুও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ে সে জানতে পারে ‘ওস্টিওসারকোমা’ ক্যান্সারের আক্রান্ত রোগীদের বাঁচার সম্ভাবনা এখন যে ফিফটি-ফিফটি অবস্থানের কথা বলা হচ্ছে কিছুদিন আগেও সেটা ছিল মাত্র ১৫ ভাগ। অর্থাৎ গবেষণালব্ধ উন্নত চিকিৎসার কারণে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। ক্যান্সার যেন টেরির শরীরে ছড়িয়ে না যায় সে জন্য তার ডান পা হাঁটুর উপর পর্যন্ত কেটে ফেলতে হলো। গবেষণার উপকারিতা বুঝতে পারলো টেরি। বেড়ে গেল গবেষণার প্রতি তার আস্থা। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল কিছু বাড়তি সময়।
অপারেশনের আগের রাতে টেরির কোচ তাকে একটি ম্যাগাজিন এনে দেয়। এই ম্যাগাজিনে সে দেখতে পায় ডিক ট্রাম নামের এক দৌড়বিদের উৎসাহ দায়ক গল্প। ডিক ট্রাম একটি নকল পা নিয়ে ২৬ মাইল ম্যারাথন সফল ভাবে সম্পূর্ণ করেছে। এই সংবাদ পড়ে ওর মনের জোড় বেড়ে গেল। টেরি ভাবতে লাগলো এই বয়স্ক লোকটি যদি নকল পা নিয়ে ম্যারাথন করতে পারে তবে আমি কেন পারবো না। পার্থক্য হল মানুষ জীবনে একবার কিংবা একাধিকবার ম্যারাথনে অংশ নেয়, টেরি সংকল্প করলো সে যদি হাঁটতে পারে তবে ম্যারাথন শেষ করবে প্রতিদিন যতদিন কানাডার পূর্বপ্রান্ত থেকে পশ্চিমে এসে পৌঁছাতে না পারে। অর্থাৎ প্রতিদিনে একটি করে ম্যারাথন। এসব করার উদ্দেশ্য হলো ক্যান্সার রিসার্চের জন্য এক মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা।
সফল অস্ত্রোপচার হবার পর তাকে একটি নকল পা পড়িয়ে দেয়া হয়। সেই পা নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করে টেরি। এরপর ফিরে যেতে চায় খেলাধুলার মাঠে। বাবার সাথে শুরু করে গলফ খেলা। এদিকে একাকীত্বে বসে ভাবতে থাকে হাসপাতালে মৃত্যু যন্ত্রণায় পরাজিত ক্যান্সার রোগীদের কথা। বিশেষ করে যন্ত্রণা কাতর শিশুগুলোর মুখ সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। তাদের কান্না সে শুনতে পায় ঘরে বসেও। যে সমস্ত মানুষের হাসি চিরতরে হারিয়ে গেছে তাদের কথা মনে করে তার চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ে। তাই সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তার স্বপ্নের প্রতি। তার স্বপ্ন সেই ছিল ছোটছোট শিশুদের দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার থেকে বাঁচাতে হবে। দরকার হলে বাকী জীবন উৎসর্গ করে যাবে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষদের জন্য। শুরু হল প্রস্তুতি। নকল পা লাগানোর পরপরই সে হুইল চেয়ারে বসে বাস্কেটবল খেলা শিখতে থাকে। কেমোথ্যারাপি চলাকালীন অবস্থায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অর্জন করে জাতীয় পুরস্কার।
চৌদ্দ মাস নকল পা নিয়ে যন্ত্রণাদায়ক প্রশিক্ষণ শেষ করলো টেরি। কেউ জানে না কেন এত পরিশ্রম। কখনো পায়ে ফসকা পড়ে যেত, কখনো তীব্র ব্যথা শুরু হতো আবার কখনোবা রক্ত ঝরত পা থেকে তবুও সে ঠিক করলো তার লক্ষ্যমাত্রা। একদিন মাকে বলে বসলো মানুষকে বাঁচানোর জন্য দেশের পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম পর্যন্ত সে দৌড়বে যার নাম হবে ‘ম্যারাথন অব হোপ’। সে দেশবাসীকে জানাতে চায় ক্যানসার নিরাময়ের জন্য গবেষণা কতোটা জরুরি আর সেই গবেষণার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা খুবই প্রয়োজন। ছেলের কথা শুনে মা বলেছিল পাগলের মত কথা বলছ কেন? কিন্তু টেরির বাবা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল ছেলে সংকল্পে কতোটা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল, তাই তার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল ‘কবে’?
টেরির মা বলল অসুস্থ শরীর নিয়ে যদি দৌড়তে চাও তবে নিজ প্রদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখো না কেন, বাইরে যাবার কি দরকার? উত্তরে টেরি বলেছিল মা ক্যান্সারতো আমার ব্রিটিশ কলোম্বিয়াতে সীমাবদ্ধ না। এরপর তার মা কি আর বলতে পারতো? কাজেই তিনিও ছেলের পাশে এসে দাঁড়ান। টেরির হার্টেও কিছু সমস্যা ছিল, তাই হার্ট বিশেষজ্ঞের অনুমতি নিতে হয়েছিল তাকে। ডাক্তারকে কথা দিয়েছিল যদি হার্টের উপর কোন চাপ আসে তবে ম্যারাথন বন্ধ করে দেবে। এরপর যোগাযোগ করা হলো ক্যান্সার সোসাইটির সাথে। প্রয়োজনীয় কাজ সম্পূর্ণ করে টেরি উড়ে গেল দেশের পূর্ব প্রান্তের প্রদেশ নিউ ফাউন্ডল্যান্ড।
১৯৮০ সালের ১২ এপ্রিল আটলান্টিক মহাসাগরের পানিতে নকল পা ডুবিয়ে সেন্ট জোন্স, নিউ ফাউন্ডল্যান্ড স্থান থেকে বাইশ বছরের যুবক টেরি ফক্স ‘ম্যারাথন অব হোপ’ বা ‘স্বপ্ন দৌড়’ শুরু করে। গন্তব্য কানাডার পশ্চিম তীরের প্যাসেফিক মহাসাগরের শহর ভিক্টোরিয়ার ‘মাইল জিরো’ পর্যন্ত। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্যাসেফিক মহাসাগরে তীরের এই ‘মাইল জিরো’র দূরত্ব আট হাজার কিলোমিটার। টেরি তার লক্ষে পৌঁছাতে প্রতিদিন একটি পরিপূর্ণ ম্যারাথন (বিয়াল্লিশ কিলোমিটারের বেশি) শেষ করবার পরিকল্পনা করেছিল। সে অনুযায়ী প্রতিদিন ভোর চারটায় ঘুম থেকে উঠে ২০ কিলোমিটার দৌড়ত। মাঝে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাকীটা। ছোট বেলার প্রিয় বন্ধু ডাগ আলওয়ার্ড এবং কিছুদিন পর টেরির ছোট ভাই ডারেল ফক্স ওর পেছন পেছন গাড়িতে আসতো। বন্ধু ডাগ আলওয়ার্ডই সমস্ত রকম যোগাযোগ, প্রচার, গাড়ী চালানো, রান্না করা, চিকিৎসকের পরামর্শ রক্ষা করতো।
টেরি ফক্সের যাত্রা প্রথমদিকে কারো উপর কোন প্রভাব ফেলে নি। খুব অল্প মানুষই শুনেছিল তার কথা। কানাডার বৈরী আবহাওয়া, ঠাণ্ডা-গরম রোদ-বৃষ্টি কিছুই তাকে থামাতে পারে নি। এত কষ্ট করেও যখন কোন প্রভাব দেখছিল না তখন টেরির মধ্যে হতাশা ঠুকে যায়। বিশেষ করে কুইবেক প্রদেশে তার কথা খুব সামান্য মানুষই শুনেছিল। হাইওয়ে কিংবা শহরের মধ্যে দিয়ে একজন ছেলে নকল পা নিয়ে দৌড়চ্ছে দেখে তারা হর্ন বাজাতো। কেউ কেউ গাড়ী থামিয়ে জিজ্ঞেস করতো রাইড লাগবে কি না। টেরি এতোগুলো প্রদেশ পার হয়ে কুইবেক পর্যন্ত আসতে পারতো না যদি না নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের ছোট একটি শহর পোর্টওবাস্কের এক মহিলার কাছ থেকে দশ হাজার ডলারের একটি চেক না পেত। সেই ছোট্ট শহরটির লোক সংখ্যা ছিল ১০ হাজার আর মহিলা একাই দশ হাজার ডলারের একটি চেক দিয়েছিল টেরিকে। টেরি ভাবল এক মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করার উদ্দেশ্য নিয়ে সে পথে নেমেছে। তার বদলে তো কানাডার প্রতিটি জনগণের কাছ থেকে সে এক ডলার আশা করতে পারে, এটা কি খুব বেশি চাওয়া? তখনকার জনসংখ্যা অনুযায়ী মোট অঙ্ক দাঁড়ায় ২৪ মিলিয়ন ডলার।
কানাডার প্রতিটি জনগণের কাছ থেকে টেরি ফক্স নামক একটি বালক এক ডলার করে সাহায্য চাচ্ছে এই খবর ছড়িয়ে পড়লো আগের থেকে অনেক বেশি। এরপর দেখা গেল লোকজন পরিবার নিয়ে পথে পথে দাঁড়িয়ে আছে টেরির সাথে দেখা করার জন্য। কেউ এলো পরিবারের ক্যান্সার রোগীকে সাথে নিয়ে। কেউ হুইল চেয়ারে, কেউ জগিং সুট পরে টেরির সাথে কিছু সময় দৌড়ে তাকে উৎসাহ দিল। কুইবেক পার হয়ে অন্টারিও প্রদেশে ঢোকার আগেই সে জাতীয় তারকার পরিচয় পেয়ে যায়। কেননা কানাডার রাজধানী অটোয়াতে বসবাসরত গভর্নর জেনারেল তার সাথে দেখা করতে রাজি হয়। এখানেই একটি ফুটবল লীগের কিক-অফ (উদ্বোধন) দেবার সম্মান পেয়ে যায় টেরি। সেই কিক-অফ মুহূর্তে করতালিতে ফেটে পরেছিল স্টেডিয়াম।
এমন বিরল সৌভাগ্য লাভ করে টেরি টরেন্টোর দিকে রওনা দেয়। পথে পথে লোকের ভিড় বেড়ে যেতে থাকে। অন্টারিও পুলিশ তার পেছন গাড়ীর ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে আসতে সম্মত হয়। এটাও তার জন্য অনেক বড় সম্মান বয়ে আনে। টেরি যতো এগিয়ে চলে তার পেছন পেছন সাফল্য ধেয়ে আসতে থাকে। ইতিমধ্যে অনেকে টেরির পক্ষ থেকে অর্থ সাহায্য করতে শুরু করে দেয়। যেখানে টেরি পৌঁছাতে পারে না সেখান থেকেও সাহায্য আসতে লাগলো। হোটেল মালিক, ব্যবসায়ী, সাধারণ পরিবার, ফুটবল তারকারা একে একে টেরির পাশে এসে দাঁড়ায়। টেরি হয়ে ওঠে অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার কথা ভেবে কেউ ধূমপান ছেড়ে দেয়। ক্যান্সার থেকে বাঁচবে বলে কেউ নিয়মিত ব্যায়াম ক্লাসে ভর্তি হয়। টেরি লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ায় এবং স্বপ্ন বিলি করে যায়। নিজে যেমন স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে অন্যকেও সে স্বপ্ন দেখায়, একজন সাধারণ যুবক থেকে কানাডার হিরো হয়ে ওঠে টেরি ফক্স।
তবুও টেরি মাঝে মাঝে মনোবল হারিয়ে ফেলত। বিশ্রামের কথাও মাথায় এসেছিল কয়েকবার এমন অবস্থায় পথে ১০ বছরের এক ক্যান্সার ভিক্টিম তাকে ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা যোগায়। গ্রেগ নামের দশ বছরের একটি ছেলের পায়ে তারই মত নকল পা দেখে সে কেঁদে দিয়েছিল। ছেলেটির প্রতি টেরির এতোই মায়া লেগে যায় যে ছোট্ট এই ক্যান্সার ভিক্টিমের সাথে সে পুরো একটা দিন কাটানোর জন্য যাত্রা বিরতি করে। দশ বছরের এই ছেলে কি যন্ত্রণাই সহ্য করছে সেটা উপলব্ধি করতে পেরে ওর সাথে সাঁতার কেটে খেলাধুলা করে সমস্ত দিন কাটিয়ে দেয়।
একদিন বিরতির পর টেরি আবার নতুন উদ্যমে শুরু করে তার ‘স্বপ্ন দৌড়’। আকাশ ভরা চাঁদের আলো, সূর্য উঠবে উঠবে করছে এমন সময় টেরির পায়ের ঘটঘট শব্দ জাগিয়ে দিত চারিদিকের নিঃশব্দতা। একক ব্যক্তির পক্ষে যদি পুরো দেশকে নাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয় টেরি সেটা করে দেখিয়েছে। তুষার-ঝড়, বৃষ্টি-বাদল উপেক্ষা করে টেরি ছুটে চলে পশ্চিমে। সে ভুলতে পারে না পেছনে ফেলে আসা মানুষগুলোর কথা যারা প্রতিদিন তাকে উৎসাহ দিয়েছে। বিশেষ করে কানাডার রাজধানী অটোয়াতে এসে পৌঁছালে গভর্নর জেনারেল এবং প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ। ১৬ হাজার ফুটবল ভক্তের উপস্থিতিতে ফুটবল লীগের উদ্বোধন। গ্রেগ নামের ছোট শিশুটির কথা ভাবতে ভাবতে সে টরেন্টো এসে পৌছায়। বিশাল এক সম্বর্ধনা পায় এখানে। একদিনেই এক লাখ ডলারের বড় অঙ্ক সংগ্রহ করে সে।
টরেন্টো এসেই বুঝতে পারে গোটা কানাডাকে সে কি ভাবে নাড়া দিয়েছে। এখন আর পিছপা হবার সুযোগ নেই। কিন্তু মনের জোর আর শরীরের জোর একসাথে কথা বলছিল না। সিটি হলের বিশাল জনসমুদ্রের সামনে তাই সে উচ্চারণ করলো ‘যদি আমি না পারি আপনারা চালিয়ে যাবেন’।
ছুটির ঘণ্টা বেজে উঠলো তার কণ্ঠস্বরে। তবুও বুকে সাহস এবং নতুন প্রেরণা নিয়ে সে এগিয়ে যেতে থাকে। এভাবেই বাড়তে থাকে টাকার অঙ্ক বাড়তে থাকে লুকানো ক্যান্সার সেল। বিষ ব্যথা নেমে আসে পায়ে, মাথা ঘুরতে থাকে, টেরির দৌড় তবুও থামে না। দৌড়বিদ জানে আর কতোটা পথ তাকে পাড়ি দিতে হবে। খুব বেশি সময় হাতে নেই তাই জীবনের শেষ জন্মদিনেও সে থেমে থাকে না। টেরি ভক্তরা পথে দাঁড়িয়ে তাকে গান গেয়ে শোনায় ‘হ্যাপি বার্থডে টু ইউ’। টেরি হাত নেড়ে তাদের ভালোবাসার স্বীকৃতি দেয়। এদিকে বেলা পড়তে থাকে সূর্যের আলো এক সময় চোখে এসে ঘোলাটে লাগে। টেরি চায় আরো কিছুটা পথ অতিক্রম করতে। সে চায় ২৪ মিলিয়নের খুব কাছাকাছি এগিয়ে যেতে।
একদিন তাকে বলা হলো অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যথার ওষুধ নিতে হবে, এখন থেমে যাওয়া ভাল। টেরি আন্দাজ করতে পারে পথের দূরত্ব তবুও ছুটি নেবার পরামর্শ নাকচ করে দেয়। আবার নামে পথে। অন্টারিও প্রদেশ এত বড় যে শেষ হতেই চায় না তবুও টেরি চায় ‘স্বপ্ন দৌড়’ শেষ করতে। তখন তার পরিচিতি এমন এক জায়গাতে পৌঁছে গেছে যে তার নামে চিঠি আসতো টেরি ফক্স, কানাডা – ব্যাস এতোটুকুই। দেশি-বিদেশি সব চিঠি আসতো ঠিকানা বিহীন। টেরি ফক্সই ছিল সবচাইতে বড় ঠিকানা। যে যতটুকু পারে তাকে সাহায্য করেছে। সেও যতোটুকু পারে অতিক্রম করেছে কিন্তু অন্টারিও শেষ প্রান্ত ‘থান্ডার বে’ আসতে আসতেই তার শরীরে ক্যান্সার ছড়িয়ে পরে।
নতুন করে দেখা দেয় কাশি এবং বুক ব্যথা। তখনো পথের পাশে লোকজন অপেক্ষা করছে। তারা বলছে, ‘টেরি তুমি পারবে’ ‘টেরি তুমি এগিয়ে যাও’। টেরিও পারতে চায়। হাত তালি দেয়া লোকগুলোকে নিরাস করে না। তাদের সামনে সে দৌড়াতে থাকে হাসি মুখে। যখন কিছুটা ফাঁকা দেখা যায়, সবুজ বনাঞ্চলে ভেতর একা একা পায়ের খটখট শব্দ শুনতে পায়, পেছনে শুধু অন্টারিও পুলিশের ফ্ল্যাশ লাইট আর বন্ধুর গাড়ী। এমন অবস্থায় টেরি দাঁড়িয়ে যায়। ঠিক আগের দিনও সে ৪২ কিলোমিটার দৌড় সম্পূর্ণ করেছে অথচ আজ আর পারছে না। টেরি বুঝতে পারে সে তার জীবনের শেষ কিলোমিটার পার করে এসেছে। এখন তার গন্তব্য পথ না, ঘর। অশ্রুসজল চোখে এ্যাম্বুলেন্স স্ট্রেচারে শুয়ে সে সাংবাদিকদের জানায় তার ক্যান্সার ফুসফুস দখল করে নিয়েছে। তাই ১৪৩ দিন পর এবং ৫৩৭৩ কিলোমিটার দৌড়ে এখন তাকে থামতে হচ্ছে। এখন সে বাড়ি যাবে। যদি দাঁড়াতে পারে তবে আবার এসে দৌড় শেষ করবে। সেপ্টেম্বর ১, ১৯৮০ তারিখে থেমে যায় টেরি ফক্সের ‘স্বপ্ন দৌড়’।
এক সপ্তাহ পর, দেশব্যাপী ‘টেলি-থন’ নামে এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয় এবং মাত্র পাঁচ ঘণ্টার প্রতিযোগিতায় ১০.৫ মিলিয়ন ডলার তুলে ফেলে কানাডাবাসী। পরবর্তী এপ্রিল মাস নাগাদ ২৩ মিলিয়নের উপর দাঁড়িয়ে যায় টেরি ফক্সের তহবিল।
যে টেরি ফক্স মাত্র এক মিলিয়ন ডলার অর্থ তহবিল গড়তে চেয়েছিল মৃত্যুর পূর্বে সে দেখে গিয়েছিল তার ঝুড়ি কি ভাবে উপচে পড়ছে। অথচ ১৯৮০ সালের ক্রিসমাসের সময় সে তার মায়ের কাছে দুঃখ করে বলেছিল আমি ক্যান্সারের জন্য বেশ তো জোগাড় করতে পারলাম কিন্তু ক্রিসমাসের জন্য তোমাকে কিছু কিনে দেবার মত টাকা আমার নেই। তারপর সে বড় ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে মাকে একটা গোলাপি রঙের ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট উপহার দেয়। সেটাই ছিল টেরির জীবনের শেষ ক্রিসমাস। ১৯৮১ সালের ২৮ জুন ২২ বছর বয়সে টেরি ফক্স স্বর্গে যাবার আশা নিয়ে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়।
একজন স্টেটসম্যান না হয়েও তার মৃত্যুতে সমগ্র দেশে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করা হয়। রেডিও টেলিভিশনে শিরোনাম হয় তার মৃত্যু সংবাদ। কানাডার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অব কানাডা’ সহ একাধিক সম্মানে তাকে ভূষিত করা হয়। প্রচুর পার্ক রাস্তা কিংবা ভবনের নামকরণ করা হয়েছে তাকে সম্মান জানিয়ে। টেরির নিজস্ব দৌড় থেমে যাবার সাথে সাথে নতুন গতি পায় টেরি ফক্সের ‘স্বপ্ন দৌড়’। যতোটুকু জানা যায় টেরি ফক্সের নামে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ এখন ৬৫০ মিলিয়নের উপর।
গত ত্রিশ বছর ধরে ‘টেরি ফক্স ফাউন্ডেশন’ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। বিশ্বের ৬০টি দেশের লোকজন এখন এক সাথে কাজ করছে ক্যান্সার মুক্ত বিশ্ব নিয়ে টেরি ফক্সের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। যখন টেরি ফক্সের বাঁচার সম্ভাবনা নিয়ে ভবিষ্যৎ বানী করা হয়েছিল ফিফটি-ফিফটি একই রোগের (অস্টিওসারকোমা) রোগীদের এখন বেঁচে যাবার সম্ভাবনা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ। বর্তমানে ‘টেরি ফক্স রান’ একদিনের ক্যান্সার ফান্ড রাইজিং এর জন্য বিশ্বের অন্যতম দৌড়।
নিজে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিল বলেই ক্যান্সার যন্ত্রণা সে অনেকের চেয়ে বেশি অনুধাবন করতে পেরেছিল ঠিকই তবে, টেরি ফক্স ফাউন্ডেশন কিংবা টেরির স্বপ্ন দৌড়ের সাথে যারা জড়িত তার কেউ আশা করে না যে সকল ক্যান্সার রোগীদের টেরির মত হিরো হতে হবে। যে অন্যের জন্য কিছুই করতে পারছে না অথচ ক্যান্সার যন্ত্রণা খুব গভীর ভাবে বুঝতে পারে তারা যেন নিজেদেরকে নিয়ে কোন বিরূপ ভাবনা না ভাবে। জগতের সকলে হিরো হতে চায় না, জগতটা কখনোই এক রঙের খেলায় মেতে থাকে না। টেরি ফক্স যদি কাউকে উৎসাহ দিয়ে থাকে এবং কাউকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে পথে নিয়ে আসতে পারে তবেই সে বেঁচে থাকবে মানুষের মাঝে। টেরি ফক্সের মত চরিত্র মানব সমাজ যুগ যুগ ধরে পেয়ে আসছে। কিন্তু মাঝে মাঝে আমরা তাদের ভুলে যাই। বাংলাদেশেও এমন অনেক মানুষ আছে যারা তাদের কর্ম ও সেবার ক্ষেত্রে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
মানব সেবা, সমাজ উন্নয়ন কিংবা পঙ্গুত্বকে হার মানীয়ে সাহসী সৈনিক হয়ে বেঁচে আছেন অনেকে। আবার তাদের অনেককে আমারা ভুলে গেছি। টেরি ফক্স যেভাবে সাহায্য সহযোগিতা পেয়েছিল সেরকম কিছু হলে বাংলাদেশ থেকেও হয়তো বেরিয়ে আসবে নতুন কোন ‘স্বপ্ন দৌড়’। মানুষের দ্বারা সবকিছুই সম্ভব, মানুষই এগিয়ে আসে মানুষের পক্ষে লড়াই করতে।
গত জুলাই মাসে আমি ও আমার স্ত্রী পশ্চিম-কানাডা সফরে বের হয়েছিলাম। মোট দশদিন ছিলাম টুর বাসে। অন্টারিও থেকে পশ্চিমের সবগুলো প্রদেশের মাটি স্পর্শ করে এসেছি। টুর বাসের বিশেষ স্টপ ওভারের মধ্যে ছিল অন্টারিওর থান্ডার বে নামক স্থান। সেখানে টেরি ফক্স ১৪৩ দিন পর দৌড় সমাপ্ত করতে বাধ্য হয়। টেরি ফক্স দৌড় সমাপ্তির স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। সেই ভাস্কর্যটি দেখে আমি অভিভূত হয়ে যাই। পশ্চিম দিকে (যেটা ছিল তার লক্ষ্য) মুখ করে টেরি এগিয়ে যাচ্ছে। নকল পা টেনে আনার সময়ও তার মাথা উঁচু এবং মুষ্টিবদ্ধ হাত দৃঢ়তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। আমি সেই ভাস্কর্যের পা স্পর্শ করতে চেয়ে ছিলাম কিন্তু টেরির উচ্চতার কারণে তাঁকে ছুতে পারলাম না। মনে মনে আফসোস থেকে গেল। সেই ছোটবেলা থেকে কত মানুষের পা ছুঁয়েছি। তাদের কারোর স্বভাব চরিত্র কিংবা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। শুধু বয়স আর সম্পর্কের কারণে বাবা মায়ের নির্দেশে তাদের পা ছুঁতে হতো। এদের সব যে ভালো মানুষ ছিল তা নয়। জমি দখলকারী, মামলাবাজ, ঘুষখোর, সুযোগ সন্ধানী এমন অনেক লোককে বড় হয়ে চিনতে পেরেছিলাম অথচ দুঃখজনক এই যে এক সময় আমি তাদের পা স্পর্শ করেছি। সে কারণে হাতটুকু শুদ্ধ করতে চেয়েছিলাম টেরি ফক্সের পা ছুঁয়ে।
মেনিটোবা, সাস্কাচুয়ান, আলবার্টা প্রদেশ ঘুরে যখন ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে গিয়ে পৌঁছলাম তখন আমাদের নিয়ে যাওয়া হল ভেঙ্কুবার শহর এবং পরবর্তীতে ফেরি পার করে রাজধানী ভিক্টোরিয়া। দিনের শেষ ভাগে এসে আমাদের বলা হল ভ্রমণের শেষ যাত্রা হবে ‘মাইল জিরো’। অর্থাৎ যেখান থেকে ট্রান্স-কানাডার হাইওয়ে শুরু হয়ে পূর্বে গিয়ে শেষ হয়। আর এখানে এসেই টেরি ফক্স তার যাত্রা শেষ করতে চেয়েছিল। আমিতো নতুন করে প্রাণ পেলাম। বাস থেকে নেমে দেখলাম টেরি ফক্সের একটি ভাস্কর্য। তুলনামুলক ভাবে অনেক ছোট এবং নিচুতে অবস্থান এই ভাস্কর্যের। মনে হল এবার অনায়াসে টেরি ফক্সের পা দুটি ছুঁতে পারবো। বাস থেকে নামার আগে বলা হয়েছিলো যেহেতু এটাই আমাদের শেষ এট্রাকশন তাই ‘মাইল জিরো’তে গ্রুপ ছবি তোলা হবে। এদিকে টেরি ফক্সের পা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বাস থেকে নেমে ৫১ জন যাত্রী গ্রুপ ছবি তোলার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো। তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আমি চলে গেলাম সোজা টেরি ফক্সের কাছে। তখন কেউ থামাতে পারে নি আমার হাত। একটি বিশুদ্ধ স্পর্শ নিয়ে ফিরে আসি টরেন্টো।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)