‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের’ শিরোনামে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পেশ শুরু করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। নতুন অর্থ বছরে বাজেটের প্রস্তাবিত আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। যা দেশের মোট জিডিপির ১৮ শতাংশ। আর জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আয়-ব্যয়ের হিসাবে প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার ৭’শ ৭২ কোটি টাকা ঘাটতি। অর্থমন্ত্রীর আশা দেশজ উৎপাদন ৭ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। আর জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির হার থাকবে সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যেই। মধ্য আয়ের দেশের স্বপ্ন পূরণের স্পষ্ট পথনকশার সাথে সাথে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশের কাতারে সামিল হওয়ার দিকনির্দেশনাও রয়েছে বাজেটে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে সদা হাসিমুখের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে প্রবেশ করেন দেড়টায়। রমজান মাস, ইফতারের আগে বক্তৃতা শেষ করার তাড়া, সেজন্য কালো ব্রিফকেসে বন্দী বাজেট উত্থাপনের সময় একটু অর্থমন্ত্রী এগিয়ে নিয়ে আসেন। স্পিকার ডক্টর শিরীন শারমিন চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে চলতি অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট এবং আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট পেশ শুরু করেন অর্থমন্ত্রী।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে মুহিত ব্যয় করবেন ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার ব্যয় পরিকল্পনা কিছুটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকায়। এই হিসেবে বাজেট বাড়ছে ২৬ দশমিক দুই শতাংশ।
বিশাল ব্যয় পরিকল্পনায় আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯’শ ৯০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে বিদেশী অনুদান সাড়ে ৫ হাজার কোটি ধরলে মোট আয় ২ লাখ ৯৩ হাজার ৪’শ ৯৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। সুতরাং ব্যয় ও আয়ের মধ্যে ফারাক অর্থাৎ বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ৬ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা।
৪ লাখ ২’শ ৬৬ কোটি টাকা যে ব্যয় করবেন অর্থমন্ত্রী, কিন্তু টাকাটা আসবে কোত্থেকে? জনগণের কর এবং বিদেশী অনুদান সব মিলে আয় হবে ২ লাখ ৯৩ হাজার ৪’শ ৯৪ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের ২ লাখ ৪৮ হাজার ১’শ ৯০ কোটি টাকাই আসবে এনবিআর আহরিত কর থেকে। এনবিআর বহির্ভূত কর ৮ হাজার ৬’শ ৬২ কোটি টাকা। এখানে যোগ হবে মাদক শুল্ক, যানবাহন কর, ভূমি রাজস্ব এবং নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প বিক্রির অর্থ। আর কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৩১ হাজার ১’শ ৭৯ কোটি টাকা আসবে সরকারের বিভিন্ন বিনিয়োগের লভ্যাংশ ও মুনাফা, প্রশাসনিক ফি, ভাড়া ও ইজারা, সেতুর টোল এবং লেভিসহ এরকম বিভিন্ন আয় থেকে। রাজস্ব আয়ের বড় অংশের যোগান আয়কর, শুল্ক ও মূসক থেকে আসবে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে রাজস্ব আয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ১ জুলাই থেকে মূসক আইন কার্যকর করা।
৪ লাখ ২’শ ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে বড় দুই খাত উন্নয়ন ব্যয় এবং অনুন্নয়ন ব্যয়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপিসহ উন্নয়ন ব্যয় আগেই চূড়ান্ত হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়েই তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু, মেট্টো রেল, মাতারবাড়ী তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী নদীর নীচ দিয়ে টানেল কিংবা রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। আবার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সব ধরনের অবকাঠামো নির্মাণও হয় এই উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দ থেকে। বরাবরের মতো এবার সবচে গুরুত্ব পেয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী এবং পরিবহন ও যোগাযোগ খাত।
রাস্তা-ঘাট, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের বাইরে সরকার যে ব্যয় করে তাই অনুন্নয়ন ব্যয়। এর বড় অংশ চলে যায় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন পরিশোধ এবং দেশের ভেতর ও বিদেশ থেকে নেয়া ঋণের সুদ পরিশোধে, ভর্তুকি ও প্রণোদনা ব্যয় মেটাতে। আবার সরকার বছরজুড়ে বিভিন ধরনের পূর্ত কার্য করে, শেয়ার ও ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ করে তার সংস্থানও হয় অনুন্নয়ন মূলধনী ব্যয় থেকে।
আয় ও ব্যয়ের অংক তো জানা হলো। এখন প্রশ্ন এই দুইয়ের যে ফারাক, সেই ঘাটতি মেটানো হবে কোত্থেকে? ১ লাখ ৬ হাজার ৭’শ ৭২ কোটি টাকার ঘাটতি মেটাতে বরাবরের মতো এবারও অর্থমন্ত্রী ভর করেছেন দেশের ভেতরের ব্যাংক থেকে ধার-কর্জ, বিদেশী ঋণ এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে অর্থ পাওয়ার ওপর।
বাজেট বক্তৃতার একদম শেষে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, যেভাবে ব্যয় পরিকল্পনা করা হয়েছে তাতে ২০২১ সালের আগেই চরম দারিদ্র্যকে বিদায় করতে চান তিনি। যেতে চান বহুদূর। চরম দারিদ্রকে বিদায় করার জন্য সামাজিক খাতকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
আাওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের চতুর্থ বাজেট এটি। আর ২০০৮ সালে নির্বাচিত হবার পর বর্তমান সরকারের নবম বাজেট। অর্থমন্ত্রী হিসেবে এটা আবদুল মুহিতের ১১তম বাজেট। বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০৯-১০ অর্থ বছরে ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকার বাজেট দিয়ে শুরু করেছিলেন মুহিত।
বৃহস্পতিবার দুপুরে স্পিকার ডক্টর শিরীন শারমিনের অনুমতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট ও আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পেশ শুরু করেন। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ সভায় বাজেট অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৮৪ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রী বলেন, তার এই বাজেট বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে শেষ কার্যকরি বাজেট।
২০১৭-১৮ অর্থ বছরের বাজেটে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে বেশি ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ জন্য বিশাল এই বাজেটে ঘাটতি ৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে।