চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

স্বপ্নপূরণের পরীক্ষায় সাকিববিহীন বাংলাদেশ?

সাকিবের খেলা নিয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না মাশরাফীও

এশিয়া কাপ থেকে নিধাস ট্রফি। এক কথায় স্বপ্নভঙ্গ। গত অর্ধযুগে হাফডজন ট্রফি হাতছাড়া হয়েছে বাংলাদেশের। টাইগারদের সামনে আবার সুযোগ এসেছে পুরনো দুঃখ ভোলার। স্বপ্নপূরণের সেই পরীক্ষায় শুক্রবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নামার আগে কঠিন এক প্রশ্নের সামনে বাংলাদেশ। মাশরাফীর দলের জন্য প্রশ্ন, প্রথমবারের মতো কোনো বহুজাতিক টুর্নামেন্টের ফাইনালে জিততে পারবে টাইগাররা? সেটা আবার সাকিব আল হাসানকে ছাড়া?

তিন দলের সিরিজে এখন পর্যন্ত অপরাজিত আছে বাংলাদেশ। ব্যাটে-বলে সমান দাপট দেখিয়ে সবগুলো ম্যাচই মাশরাফীরা জিতেছে অনায়াসে। এই সিরিজেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুবার হারিয়েছে টাইগাররা, তাও আবার কোণঠাসা করে।

বুধবার শেষ ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে আনুষ্ঠানিকতার ম্যাচেও দারুণ জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সাকিব আল হাসানের ইনজুরি টাইগার সমর্থক ও দলকে কিছুটা চিন্তায় রেখেছে। বিসিবির প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু অবশ্য অভয় দিয়েছেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, সাকিবের আঘাত গুরুতর নয় এবং বিশ্বকাপে তার খেলার সম্ভাবনায় কোনো প্রভাব ফেলবে না।

পিঠে ব্যথা নিয়ে সাকিব মাঠ ছাড়ার পর প্রধান নির্বাচক বলেছেন, ‘আমরা তাকে নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইনি, তাই আমরা তাকে মাঠ থেকে ফিরিয়ে এনেছি। কিন্তু আমরা নিশ্চিত যে, তিনি শীঘ্রই ভালো হয়ে যাবেন।’

অন্যদিক, ত্রিদেশীয় সিরিজে দোর্দণ্ড প্রতাপে শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ম্যাচে রানপাহাড় গড়ে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১৯৬ রানে জেতে তারা। কিন্তু পরের ম্যাচেই হোঁচট খায় ক্যারিবীয়রা। বাংলাদেশের কাছে তারা প্রতিটি বিভাগেই পরাজিত হয়। তবে এটা বলা যায় যে, ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে যারা খেলবে সে হিসেবে এটা উইন্ডিজের সেরা দল নয়। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকা ১৫ জনের সাতজনই এই সিরিজে খেলছেন না। বিশ্বকাপের আগে রিজার্ভ বেঞ্চ বাজিয়ে দেখার যে সুযোগ নিয়েছিল, সেই পরীক্ষায় এখন পর্যন্ত পুরোপুরি সফল নয় জেসন হোল্ডারের দল।

আরও একটি পরীক্ষায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বাংলাদেশ যেমন এখনো বহুজাতিক কোনো ট্রফি জেতেনি। তেমনি দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরাও গত একদশকে ওয়ানডেতে তিন বা তার বেশি দলের বহুজাতিক সিরিজের ট্রফি হাতে তুলতে পারেনি। সবশেষ তারা জিতেছে ২০০৮ সালে, কানাডায়। আর আইসিসির পূর্ণ সদস্যেদের সঙ্গে লড়াইয়ে সবশেষ ট্রফি সেই ২০০৪ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।

এই ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে স্পটলাইটে থাকতে পারতেন আবু জায়েদ রাহি। এই সিরিজেই অভিষেক হওয়া ২৫ বছরের রাহি মাত্র দুটি ওয়ানডে খেলেছেন। কিন্তু তাতেই বাজিমাত করেছেন। নিরুত্তাপ অভিষেকের পরের ম্যাচেই পাঁচ উইকেট তুলে নেন। আইরিশ ওপেনার ও সেঞ্চুরিয়ান পল স্টার্লিংসহ অন্য ব্যাটসম্যানদের ঠিক সময়ে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে সিরিজে অপরাজিত রাখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। কিন্তু ফাইনালে তার খেলার সম্ভাবনা ক্ষীণ। গত ম্যাচে বিশ্রাম পাওয়া মোস্তাফিজের ফেরার কথা রাহির জায়গায়।

বাংলাদেশ যেমন ব্যাটসম্যান-বোলার উভয়ের দিকেই তাকিয়ে থাকবে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে তেমনি ব্যাটসম্যান শাই হোপ আলাদা করে স্পটলাইটে থাকবেন। চার ম্যাচে দুই সেঞ্চুরি ও এক হাফসেঞ্চুরি, ৯৯ গড়ে ৪০০’র কাছাকাছি রান নিয়ে টপ স্কোরার তিনিই। বাংলাদেশের বিপক্ষে হোপই ওয়েস্ট ইন্ডিজের একমাত্র ব্যাটসম্যান যিনি সাবলীলভাবে ব্যাট করে চলেছেন।

শুধু এই সিরিজেই নয়, চলতি বছরজুড়েই দারুণ খেলছেন হোপ। গত ১২ মাসে তার ব্যাটিং গড় ৭২.০৬। বাংলাদেশের বিপক্ষে সবশেষ আট ম্যাচে তিনটি সেঞ্চুরি করেছেন। বিশ্বকাপে এবং বিশ্বকাপের আগে এমন ফর্মের একজন ব্যাটসম্যান ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অবশ্যই ভালো অবস্থানে রাখবেন।

চলতি সিরিজে এখন পর্যন্ত চারটি সেঞ্চুরি পেয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৬ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পর এবারই যা প্রথম। শাই হোপের সঙ্গে প্রথম ম্যাচে দুর্দান্ত সেঞ্চুরি করেছিলেন জন ক্যাম্পবেল। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ১৭৯ রানের ইনিংস খেলার পর থেকে চোটে তিনি মাঠের বাইরে।

স্পটলাইটে থাকছেন টাইগারদের ওয়ানডে অধিনায়ক আর সহ-অধিনায়কও। বুধবার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অবশ্য একটি মাইলফলকে পৌঁছার সুযোগ ছিল তাদের। কিন্তু হয়নি। ত্রিদেশীয় সিরিজের দুই ম্যাচে তিনটি করে উইকেট নিয়েছেন মাশরাফী। ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে তিন উইকেট পেলে গর্বের উপলক্ষ্যে নাম লেখাবেন এ পেসার। অধিনায়ক হিসেবে করে ফেলবেন উইকেটের সেঞ্চুরি।

বাংলাদেশকে ৭৫ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে মাশরাফী এপর্যন্ত নিয়েছেন ৯৭ উইকেট। একশ’র বেশি উইকেট আছে মাত্র তিনজন অধিনায়কের। ওয়াসিম আকরাম, ইমরান খান ও শন পোলক ছাড়া এই কীর্তি নেই অন্যকারোই।

ওয়ানডে ক্যারিয়ারে আরেকটি উইকেট পেলেই সেটি হবে সাকিবের ২৫০ নম্বর শিকার। মাশরাফীর পর দ্বিতীয় বাংলাদেশি বোলার হিসেবে স্পর্শ করবেন এ কীর্তি। তাতে করে আরও বড় মঞ্চে নাম লেখাবেন এ অলরাউন্ডার। ওয়ানডেতে ৫ হাজার রান এবং আড়াইশ উইকেটের মালিক এখন পর্যন্ত মাত্র চারজন ক্রিকেটার। তারা- সাউথ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস, শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়াসুরিয়া, পাকিস্তানের আব্দুল রাজ্জাক ও শহীদ আফ্রিদি।

এই সিরিজে ব্যাটেও দারুণ করেছেন সাকিব। তিন ম্যাচে ৬১, ২৯ ও ৫০ রান করেছেন। গড় ১৪০। যদিও চোট নিয়ে তার ফাইনালে খেলা ঘিরেই শঙ্কার মেঘ। গত এশিয়া কাপেও চোটে ফাইনাল খেলা হয়নি তার।

শুক্রবারের ফাইনালে নজর থাকবে মুশফিকুর রহিমের দিকেও। চলতি সিরিজে ৩৫, ৬৩ এবং ৩২ সবগুলো ইনিংসেই অপরাজিত ছিলেন তিনি। আগের ম্যাচেই আবার বিশ্বের পঞ্চম উইকেটকিপার হিসেবে ৫ হাজার রান ও ২০০ ডিসমিসালেরর রেকর্ড গড়েছেন মুশি।

ক্লনটার্ফে উইনিং কম্বিনেশন ভেঙে বাংলাদেশের সেরা একাদশে সুযোগ দেয়া হয় লিটন দাস, মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত, রুবেল হোসেন ও সাইফউদ্দিনকে। এ চারজনকে জায়গা দিতে বিশ্রাম দেয়া হয় আগের দুই ম্যাচেই পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলা সৌম্য সরকার এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আগের ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা পেসার মোস্তফিজুর রহমান, মোহাম্মদ মিঠুন ও মেহেদী হাসান মিরাজকে। ফাইনালে দলে ফিরতে পারেন এ চার তারকাই।

ফাইনালে সাকিব খেলতে পারবেন কিনা সেটা বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। এখন পর্যন্ত যা অবস্থা তাতে তিনি দলে থাকবেন কিনা শুক্রবার সকালের আগে সে সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। অধিনায়ক মাশরাফীও ম্যাচের আগেরদিন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দিতে পারেনি নিশ্চয়তা। তিনি জানিয়েছেন, খেলার ব্যাপারে সিদ্ধান্তটা সাকিবের নিজের উপরই থাকছে। অধিনায়কের কথায় ইঙ্গিত, ম্যাচের দিন সকাল পর্যন্ত সাকিবের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

সাকিবের চোট যে গুরুতর কিছু নয়, সেটা আগেই জানিয়েছিলেন প্রধান নির্বাচক। তবে ফাইনালের আগে দু-একদিন সময় হাতে না থাকাতেই যা সংশয়। ফিট হওয়ার জন্য এই কম সময় পাওয়াই শেষ পর্যন্ত ম্যাচের বাইরে রাখতে পারে সাকিবকে।

দলের ফিজিও থিহান চন্দ্রমোহনও একই রকম কথা জানিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ‘গতকাল (বুধবার) আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাট করার সময় থেকে সাকিব বাঁ-পাশের সাইড স্ট্রেইনের চোটে ভুগছেন। তিনি এখন চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণে আছেন। তাকে ম্যাচের পাওয়া যাবে কিনা সে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা ফাইনালের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করব।’

শেষ পর্যন্ত সাকিব যদি খেলতে না পারেন, তাহলে দলে যুক্ত করা হতে পারে একজন ব্যাটসম্যানকে। সাময়িক এই সমস্যা কাটানোর জন্য তিন নম্বর পজিশনে ব্যাটিংয়ে দলে নেয়া হতে পারে লিটন দাসকে। সেক্ষেত্রে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কাঁধে ইনজুরি সমস্যা থাকার কারণে সাব্বির রহমান ও সৌম্য সরকারের বেশি বল করতে হতে পারে। গত ম্যাচে রাহির দুর্দান্ত বোলিংও দল নির্বাচনের ক্ষেত্রে নির্বাচকদের মধুর মাথাব্যথা বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের মতো ইনজুরি সমস্যা ছিল ওয়েষ্ট ইন্ডিজ দলেও। সেসব পেছনে ফেলে এই ম্যাচে দলে ফিরতে পারেন প্রথম ম্যাচে ১৭৯ রানের ইনিংস খেলে আইরিশদের কাঁদানো ওপেনার জন ক্যাম্পবেল। আর গত দুই ম্যাচে সুযোগ পেয়েও ভালো না করায় ফাইনালে রেমন রেইফারকে বসিয়ে দলে আনা হতে পারে পেসার শ্যানন গ্যাব্রিয়েলকে।

সিরিজে লিগপর্বে চার ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের পয়েন্ট ১৪। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯। পয়েন্টে ফারাক থাকলেও সবশেষ জয় পরাজয়ে সমানে সমান দুদল। শেষ পাঁচ ওয়ানডেতে উভয় দলই তিনটি করে ম্যাচ জিতেছে। হার দুটিতে। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে শেষ ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই জিতেছে বাংলাদেশ।

ডাবলিনের পিচ অনেকটাই ব্যাটিংবান্ধব। এখানে ম্যাচ প্রতি রান গড় ২৫৯। তবে আগে ব্যাট করা দলের জন্য খবর অনেকটা খারাপ। কারণ, ১৫ ম্যাচের মধ্যে আগে ব্যাটিং করা দল জিতেছে মাত্র পাঁচটিতে।

ডাবলিনে সোমবার ঠাণ্ডা একটু বেশি থাকবে বলেই জানাচ্ছে আইরিশ আবহাওয়া দপ্তর। তাপমাত্র থাকতে পারে ১৩ ডিগ্রির মতো। আকাশে মেঘ থাকবে। দুপুরের দিকে হালকা বৃষ্টিপাত হতে হতে পারে। তবে পুরো খেলার পথে সেটা বাধা হবে না।