চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সেদিন কি আমাদের সন্তানেরা তাদের হাত বাড়িয়ে দেবে?

ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে খুব ভাল রেজাল্ট করে পাশ করে আমি হলিক্রস কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলাম ১৯৮২ সালে। সেখানে ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাওয়ার পরেও আব্বার পরামর্শে ভর্তি হলাম ইডেন কলেজে। অদ্ভুত একটা যুক্তি দিয়ে আব্বা আমাকে মোটিভেট করেছিলেন সেদিন।

বলেছিলেন, ‘হলিক্রস কলেজে অনেক পরীক্ষা, অনেক চাপ। খামোখা চাপ নেয়ার দরকার কী? বরং আরাম করে পড়াশোনা কর সরকারি কলেজে।’

এই আরাম করে পড়তে গিয়ে আমারতো মুখ থুবড়ড়ে পড়ার দশা হয়েছিল। পারবো পারবো করে ওভার কনফিডেন্স হয়ে গিয়েছিল আমার। ইডেন কলেজের স্বাধীন পরিবেশে হৈ-হুল্লোড়, আড্ডাবাজি করতে গিয়ে টেস্টে আমি বেশ খারাপ করলাম । খারাপ করার পর সেই ফলাফল আব্বা আম্মার কাছে গোপন করলাম ঠিকই, কিন্তু মনেমনে খুব অপরাধবোধে ভুগতে থাকলাম। আব্বা আমার মেধার উপর আস্থা রেখে আমাকে কম চাপওয়ালা কলেজে ভর্তি করে দিলেন, আর আমি হেসে খেলে খারাপ রেজাল্ট করলাম!

সেরকমই একটা অবস্থায় আব্বার পেশাগত ঝামেলা শুরু হল। টাকা পয়সার মহাসংকটে পড়ল আমাদের পরিবার। এই আর্থিক টানাটানির মধ্যেও আব্বা একদিন ৩০০ টাকা দিয়ে আমাকে জেনারেল হিস্ট্রির একটি বই কিনে দিয়েছিলেন রেফারেন্স বই হিসেবে। বইটা হাতে নিয়ে আমি অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। কেঁদেছিলাম এই ভেবে যে, আমি যেন ভাল রেজাল্ট করতে পারি তাই আব্বা এত অভাবের মধ্যেও বইটা কিনে দিলেন, আর আমি ফাঁকি দিয়ে রেজাল্ট খারাপ করছি?এই অপরাধবোধ থেকে বাকি তিনমাস পড়াশোনা করে অনেক ভাল রেজাল্ট করে এইচএসসি পাশ করলাম। এরপর থেকে আজ পর্যন্ত যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তাদের জন্য কিছু করার। আমার জীবন গড়ার পেছনে তাদের যে অবদান, তা স্মরণে রাখতে।

এই বই কিনে দেয়ার কথাটা আমার বারবার বিভিন্ন কারণে মনে পড়ে। বাবা মায়েরা উজাড় করে সন্তানকে সুখ শান্তি দেয়ার চেষ্টা করেন। এখনকার বাবা মায়েদের কাছে সন্তানকে অদেয় কিছু নাই। কিন্তু সন্তানরা এর কতটা অনুভব করে? কতটা কৃতজ্ঞ তারা বাবা মায়ের কাছে?আমি এখন মা। তাই বুঝি বাবা মায়েরা সাধ্যের ভেতর এবং মাঝেমাঝে সাধ্যের বাইরে গিয়েও চায় বাচ্চার আশা আকাঙ্খা পূরণ করতে। আমাদের বাবা মায়েরা যা করতেন, তার চেয়েও অনেক বেশি করেন আজকালকার বাবা মায়েরা।

সেদিন রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের দেখলাম গেট খুলেনি বলে ফুটপাতে বসে পড়ছে। খুব গরম। মায়েরা একহাতে বাচ্চাদের মাথায় ছাতা ধরে আছেন, অন্য হাতে পাখা দিয়ে বাতাস করছেন। বাবাদেরও দেখতে পেলাম। তবে মায়েদের সংখ্যাই বেশি। মনটা হু হু করে উঠলো। আহারে মা বাবা। জীবনের সবকিছু দিয়ে সন্তানকে ভরিয়ে দিতে চান সেই কথাটাই সত্য ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে ভাতে’। সেই সন্তান হয়তো ঠিকই একদিন দুধে ভাতে থাকে, কিন্তু সেদিন তাদের অনেকেরই পাশে বাবা মা থাকেন না, বাবা মা থাকলেও সন্তানের সময় থাকে না তাদের দিকে তাকানোর অথবা তখন তারা বাবা মাকে বোঝা বলে মনে করে।

একই কথা মনে হয় প্রতিদিন যখন অফিস যাওয়ার পথে দেখি অসংখ্য মা রাস্তার পাশে ফুটপাতে, দোকানের সিঁড়িতে বা সংসদ ভবনের সামনে চাদর বিছিয়ে গাছের নীচে বসে আছেন, আমার কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। শুধু সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে, সংসারের যাতায়াত খরচ কমানোর জন্য তারা রোদ, বৃষ্টি, ঝড় উপেক্ষা করে এভাবে রাস্তায় বসে থাকেন, ছুটি হলে বাচ্চাদের নিয়ে যাবেন বলে কোন বিনিময়মূল্যের কথা ভেবে তারা কিন্তু এটা করেন না। করেন অপত্য স্নেহ থেকে।

যেদিন আমার মেয়েটির জন্ম হল, সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম এর চেয়ে বড় কোন সম্পদ আর আমার নেই । এরপর থেকে আমার বা আমাদের জীবন আবর্তিত হয়েছে ওকে ঘিরে। ওর সুখ, শান্তি, চাওয়া, পাওয়া, আনন্দ, বেদনা, স্বপ্ন সবকিছুই ছিল আমাদের মনজুড়ে। ও যত বড় হয়েছে, নিজের মত চলতে শিখেছে, নিজের জ্ঞান বেড়েছে, নিজেদের জগৎ বড় হয়েছে, বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা বেড়েছে; কিন্তু আমরা মা বাবাই থেকে গেছি। টিন এজে এসে যখন আমাদের ভালমন্দ, মূল্যবোধ, নিরাপত্তার ধারণা, সমাজের ধারণার সাথে ওর ধারণার অমিল হতে শুরু করল, তখন আমরা বিশেষ করে আমি খুবই মন খারাপ করতাম । সময়ের সাথে সাথে নিজেদের অনেকটা পরিবর্তন করার পরও সন্তানের চিন্তা সবসময় আমাদের তাড়িত করতো।

এখন অবশ্য আমার বাচ্চাটি অনেক ম্যাচিউরড। এরপরও বাবা মা হিসেবে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা রয়েই গেছে। ও যখন বলে, ‘উহ তোমরা এত ভাব কেন? আমরাতো জানি কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ।’ সাথে সাথে মনে হয় আমার তরুণ বয়সের কথা । ঠিক এই কথাগুলো আমিও বলতাম আব্বা আম্মাকে, উহ তোমরা এত ভাবো কেন? আমিতো বুঝিই সবকিছু। তখন আব্বা বলতেন, ‘মা আমরা কেন ভাবি, সেটা এখন বুঝবি না। যেদিন মা বাবা হবি, সেদিন বুঝবি।’ সত্যিই তাই, আব্বার কথাটা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।

স্নেহ যে নিম্নগামী হয়, তা বুঝেছি নিজেদের দিয়ে। সন্তান হওয়ার পর সবকিছুর কেন্দ্র ছিল আমাদের সন্তান। এরপরেও চেষ্টা করেছি আমাদের বাবা মায়ের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন করতে। সবসময় তাদের সব চাহিদার প্রতি দৃষ্টি দিতে পারি না, সব খবরাখবর রাখতে পারি না, পারিনা সময় দিতে।

কিন্তু অনেকেই চেষ্টা করি তাদের কিছুটা সময় দিতে, তাদের পাশে থাকতে। সেদিন একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলার সাথে কথা হচ্ছিল। উনি বললেন, ‘মা আমার তিন ছেলে, কিন্তু আমার এখন কেউ নাই । একা থাকি। আমাকে দেখাশোনা করার লোক রেখেছি, নিজের টাকা থেকে। ছেলে আর ছেলে বউদের অনেক কাজ। সময় পায় না আমার কাছে আসার। আমিতো আর কিছু চাই না, শুধু চাই ওরা পাশে থাকুক।

জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে আমরা একক পরিবারের দিকে এগুচ্ছি। ‘বাবা-মা-সন্তান’ এই আমাদের পৃথিবী। এমনকী নিজের বাবা মাকেও বাড়তি বলে মনে হয়। এটাই আমাদের বাস্তবতা। আধুনিক বিশ্বের কিছু কায়দা কানুন আমরা গ্রহণ করেছি, কিছু করিনি। সেখানে সন্তান ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বাবা মায়ের সাথে থাকে। এরপর অধিকাংশই আলাদা হয়ে যায, নিজেরটা নিজে দেখে। তাই বাবা মায়ের সাথে তাদের সম্পর্ক, দায়িত্ববোধ হয়ে থাকে খানিকটা অকেশনাল। মাদার’স ডে, ফাদার’স ডে পালন, ছুটির দিনে, উৎসবে পরবে বা মা বাবার গুরুতর অসুস্থতার সময় তারা আসে, সময় দেয়, গিফট, ফুল বা কার্ড পাঠিয়ে দায়িত্ব সারে। কারণ তারা জানে তাদের এই দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করেছে।সেখানে বয়স্কদের জন্য আছে বৃদ্ধাশ্রম, আছে চিকিৎসা সেবা, আছে ভাতা। তারা আর্থিক কারণে সন্তানের উপর নির্ভরশীল নন। কিন্তু আমাদের দেশে এসবের কিচ্ছু নেই, আছে শুধু সন্তানের হাত। সন্তান সেই হাত না বাড়ালে এদের জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিসহ।

সন্তান শেখে পরিবার থেকে। সে যখন দেখে তার বাবা মা তাদের বাবা মায়ের কদর করছে না, খোঁজ খবর নিচ্ছে না, তখন সে মনে করে এটাই বুঝি স্বাভাবিক। তাদেরও আর দায়িত্ববোধ জন্মায় না। সে যখন দেখে যৌথ পরিবারের সম্পর্কগুলোকে তার বাবা মা ঝামেলা বলে মনে করছে, তখন সেও তার জীবনে সেই প্র্যাকটিসটাই করবে।

যখন আমাদের বা আমাদের পরিচিতজনদের বাবা মায়েদের দেখি, তখন কেবলই নিজেদের কথা মনে হয়। যেদিন আমরা কাজ করতে পারবো না, নিজের মতো চলতে পারবো না, সেদিন কি আমার বা আমাদের সন্তানরা তাদের হাত বাড়িয়ে দেবে? একটু সময় দেবে আমাদের? আমাদের জীবনের পুরোটা সময়ই কিন্তু আমরা সন্তানদের দিয়েছি, বাবা মাকে দিয়েছি কম। তাহলে এখন আমাদের জীবনের হিসাবটা কী হবে?

এতগুলো কথা বললাম এজন্য যে সময়টা এতই বদলেছে যে সন্তানকে তাদের দায়িত্ব পালনের কথা আইনী বিধিমালা করে মনে করিয়ে দিতে হয়। আদালতকে ভরণ পোষণের কথা বলতে হচ্ছে। নতুবা শাস্তির ভয় দেখানো হচ্ছে। আহারে অভাগা বাবা মা, এতগুলো বছর ধরে সব ঝড় ঝঞ্চাকে উপেক্ষা করে যে বুকের ধনকে তারা বড় করেন, আজ তাদের ভালবাসা পাওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে, একথাটি ভাবতেই কষ্ট হয়।

তাই মা দিবস, বাবা দিবস যে দিবসই আসুক না কেন, শুধু কার্ড বা ছবি নয়, আসুন আমরা বাবা মায়ের পাশে থাকি। আমাদের সন্তানদেরর শেখাই ‘পিতামাতাই স্বর্গ, পিতামাতাই ধর্ম। পিতামাতাকে সুখী রাখলে সব দেবতাই খুশি হন।’ (সংস্কৃত শ্লোক)

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)