পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরেই রূপালি পর্দায় আসেন অমর নায়ক সালমান শাহ। প্রয়াণ দিবসে সালমানকে ঘিরে স্মৃতিচারণ করলেন সোহান।
তিনি বলেন: পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা ক্ষণজন্মা। সালমানও সেরকম একজন। তিনি বেঁচে থাকলে কী হতো তা জানি না। তবে মাত্র সাতাশটি ছবিতে অভিনয় করেই এতো দর্শকনন্দিত হওয়া এর আগে কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি।
‘মাত্র চার বছরের চলচ্চিত্র জীবনে পুরো দেশের সিনেমাপ্রেমীদের এভাবে তাক লাগিয়ে রাখবে তা শুরুর দিকে আমি কখনো ভাবিনি। সালমানের এই সাফল্যকে বলব আল্লার দান। সে ছিল গড গিফটেড।’
সালমানকে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবিতে নেওয়ার ব্যাপারে প্রথমদিকে দ্বিধাদ্বন্বে ছিলেন সোহান। ‘প্রথমে সালমানকে নিবো না বলে স্থির করেছিলাম। নানা কারণেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এর মধ্যে একটা কারণ ছিল- সালমান ছিল একটু বেশি রাফটাফ। আমি তাকে সিনেমায় অফার করার পরও ওর নাগাল পাচ্ছিলাম না। যতোবার ওদের বাসায় ফোন দিয়েছি, ততোবার শুনেছি সালমান নেই। রাতেও কখনো শুনেছি বাসায় ফেরেনি। তখন ভেবছিলাম এরকম একটা ছেলেকে নিয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারব তো ‘
তাকে কেন নেবেন ভাবতে ভাবতে অনেক ছেলে দেখলেন তিনি। কিন্তু পছন্দ হলো না। এরপর একদিন এক মহিলা এক ছেলেকে নিয়ে ম্যাকডোনাল্ড রেস্টুরেন্টে এলেন। তাকেও দেখলেন। কিন্তু পছন্দ হলো না।
‘ওদের বিদায় দিয়ে ভাবলাম শেষবারের মতো ইমনকে ফোন দিয়ে দেখি। বাসায় ফোন ধরলো ইমন নিজেই। তাকে বললাম, তুমি কি আসতে পারবে? সে বললো হ্যাঁ আসতে পারবো-মিনিট বিশেক লাগবে।’
ইমনের জন্য অপেক্ষা করেত করতেই হোটেলের সিসি ক্যামেরায় একটা ছেলেকে দেখলেন সোহান। তাকে দেখে একরকম লাফিয়ে উঠলেন, ভাবলেন নায়ক পেয়ে গেছেন। কিন্তু, ওই ছেলেটাই যে ইমন সেটা তখনও বুঝতে পারেননি। ‘পরে দেখলাম ছেলেটা কাউকে খুঁজছে। ডেকে জিজ্ঞাসা করতেই ও নিজের পরিচয় দিল।’
কথা শেষ করে রিকসায় করে ওদের বনানীর বাসায় গেলেন সোহান। সালমানের মায়ের সঙ্গে কথা বললেন। ‘নীলা ভাবিও রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, আজ থেকে আমার ছেলেকে আপনার হাতে তুলে দিলাম।’
এভাবেই সালমানকে নিয়ে কাজ শুরু হয়ে গেল। ছয়মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো সালমানকে। সোহান তখন পাঁচটা ছবির কপিরাইট এনে রেখেছিলেন। এর মধ্যে ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ও ছিল।
ছবিটি সালমান দেখেছে কিনা তা জানতে চাইতেই বললেন, কেয়ামত সে কেয়ামত তক ছবিটি ছাব্বিশ বার দেখেছেন। ‘সেও ছবিটি করতে চাইল। পরে কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবিটিই বানালাম।’
১৯৯২ সালের ৩১ আগস্ট কেয়ামত থেকে কেয়ামত ছবির মহরত হয়। আর শুটিং শুরু হয় ১৩ সেপ্টেম্বর। সালমান-মৌসুমীকে নিয়ে কাজ করতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। কারণ সোহান বুঝতেন, তাদেরকে নিয়ে কীভাবে কাজ করতে হবে। প্রথম দিন শুটিং হলো চীন মৈত্রী সেতুর উপর। দৃশ্যটা এরকম যে ওরা একটা বাইকে চড়ে পালিয়ে যাবে। যেকোনো আর্টিস্টেরই একটা ক্যামেরা ভীতি থাকে। পুরাতন শিল্পীদেরও ক্যামেরাভিতি থাকে। ‘তাই তাদের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা আগে করলাম।’
দ্বিতীয় দিন হলো কার্জন হলে। মৌসুমী এসেছে কলেজে। তার বাবা তাকে ফলো করছে মৌসুমী ঠিক মতো কলেজে যায় কিনা দেখতে। আবার সালমান এসেছে তার সাথে দেখা করতে। এদের ভেতরে একটা ভয় ভয় ভাব থাকতে হবে। আবার ওরাও নার্ভাস ছিলো ক্যামেরার সামনে। ফলে রিয়াল নার্ভাসটাই ফুটিয়ে তোলা হলো।
ছবিতে নাচের দৃশ্য বলতে একটা গানেই বেশি মাত্রায় ছিল। সে গানটা হচ্ছে: বাবা বলেছে ছেলে বড় হবে। এই গানটার জন্য তাকে আগে থেকেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
সোহান বলেন: ছবিটি নিয়ে আমার ভেতরে প্রচণ্ড ভয় কাজ করতো। হিন্দি ছবিটি তো সবাই দেখেছে। আমাদেরটা কেন মানুষ দেখবে! ছবি মুক্তি পেল ঈদের দিন। আমি নামাজ পড়ে ছবি দেখতে গেলাম আনন্দ হলে। গিয়ে দেখলাম- লোকজন কম। আমি হতাশ হলাম। শো শুরু হলে আমি ছবির সাথে এমনভাবে ইনভলভ হয়ে গেলাম যে এসব আর কিছু মাথার ভেতর থাকলো না। ইন্টারভেলের সময় দেখলাম অনেক দর্শক। এরপর সন্ধ্যার দিকে মৌসুমীকে নিয়ে কয়েকটা হলে গিয়ে ঢুঁ মারি। তবে সালমানের সঙ্গে ছবিটি কোনোদিনই দেখা হয়নি। তখন না দেখার কারণ সে তার বন্ধু বান্ধব নিয়ে ব্যস্ত থাকায় একসঙ্গে আমাকে সময় দিতে পারেনি। আমিও ওকে বলিনি।
‘তবে সিনেমাটার অল্প কিছু অংশ দেখেছিলাম বরিশালে। ওখানে আমাদের একটা সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিলো। সেখানে বসেই একসঙ্গে সামান্য অংশ দেখা হয়েছিলো। আমরা সাগর লঞ্চে করে ভাসতে ভাসতে গেলাম বরিশাল। আমি, সালমান, তার মা, মৌসুমী ও তার মা। এটা মার্চের ৩১ তারিখ বা এপ্রিলের ১ তারিখে। আমরা ৫টার দিকে যখন বরিশাল ঘাটে গিয়ে পৌঁছলাম তখন দেখলাম সেখানে লক্ষ লক্ষ লোক। পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েও তাদেরকে থামাতে পারছে না।’
তারা গিয়েছিলেন ‘অভিরুচি’ সিনেমা হলের মালিকের আমন্ত্রণে। ঢাকা থেকে অনেক সাংবাদিককেও সঙ্গে নিয়েছিলেন সোহান। সালমান, মৌসুমী ও তাদের মাকে পাঠালেন অভিরুচি সিনেমা হলের মালিকের বাসায়। আর তিনি সাংবাদিকদের নিয়ে হোটেলে উঠলেন। ওদের বন্দোবস্ত করতে করতেই তার হোটেলে একটা ফোন এলো। তাড়াতাড়ি ‘অভিরুচি’ সিনেমা হলের বাসায় যেতে বলা হলো তাকে।
‘গিয়ে দেখলাম যে বাসায় দুটো রুম। একটার সাথে একটা অ্যাটাচড বাথরুম, আরেকটার সাথে নেই। তো এখন সেখানে কে থাকবে? সালমানের মা আর সালমান? নাকি মৌসুমী আর তার মা। এটা নিয়ে তর্ক চলছে তাদের ভেতরে। আমি যাওয়ার পর চিন্তা ভাবনা করে বললাম মৌসুমী যেহেতু মেয়ে মানুষ তাই মৌসুমী তার মাকে নিয়েই সে রুমে থাকুক। এটা বলার পর সালমান আমার উপর রেগে উঠল।তার কথা হচ্ছে, সে তার মাকে নিয়ে থাকবে অ্যাটাচড বাথরুমওয়ালা রুমটাতে। এটা নিয়ে সে অনেক উচ্চ-বাচ্চও করলো, অনেক উল্টাপাল্টা কথা বললো, যেটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগলো। যেটা আমি ওর কাছে আশা করিনি। এই খারাপ লাগার পরেই কিন্তু আমি ওকে নিয়ে আর কোন ছবি করিনি।এই অভিমানটা ছিলো আমাদের মাঝে ‘
এর বছর তিনেক পর সালমান মারা যাওয়ার মাস তিনেক আগে একদিন এফডিসিতে সোহানকে জড়িয়ে ধরে সালমান বললেন, ওস্তাদ অনেক ভুল করেছি, অনেক অভিমান করেছেন; এবার মাফ করে দেন আমাকে। চলেন, আমরা একসঙ্গে আবার ছবি বানাই।
‘তার আগে সে গাড়ি কিনেছে। নতুন গাড়ি কেনার পর সে আমাকে গাড়িতে উঠিয়েছে। যখন যে সম্মানটা করার দরকার তা করতো। কিন্তু অভিমানের কারণে ছবি করার ব্যাপারে কিছু বলতে সাহস পেত না। তাই আর ছবি করা হয়নি। কিন্তু ওর সাথে যখন আমার সম্পর্ক ভাল হলো ছবি বানাতে চাইলাম, তখন আর তা হলো না। ওকে নিয়ে গল্পও রেডি করেছিলাম। ওকে বললাম, তুমি আমাকে ডেট দিতে পারবা? ও বললো, আপনার জন্য আমি ডেট রেডি করে রাখবো। তখন অবশ্য আমি শাকিল খানকে বানিয়ে ফেলেছি। তাকে নিয়ে ছবি করবো। শাকিল খানকে নিয়ে যখন মহরত করবো তখন সে সংবাদ তার কানে গেছে। এটা শোনার পরেই মূলত সে আমার সঙ্গে ছবি করতে আগ্রহী হয়। আমি তাকে বললাম, দেখো ছবি করবো তুমি কি ডেট দিতে পারবে? বললো, বলেন কয়দিন, কখন লাগবে। আমি গল্প রেডি করছিলাম। এর মধ্যেই একদিন ও অ্যাকসিডেন্ট করলো। শাহ আলম কিরণ সাহেবের ‘বিচার হবে’ ছবির শুটিং করতে গিয়ে ঘাড়ে ব্যাথা পেলো। তো তাকে হাসপাতালে দেখতে গেলাম। তখন সে আমাকে আলাদা করে ডেকে বললো, ওস্তাদ আমি কিন্তু ডেট রেডি করে ফেলেছি।’
শাকিব খানকে নিয়ে সোহান পরে যে ছবিটা বানিয়েছিলেন ‘অনন্ত ভালোবাসা’– এ গল্পটাতেই সালমানকে নিয়ে কাজ করার কথা ছিলো।
‘সেদিন এ গল্পটা নিয়েই আমরা মিটিং করছিলাম। এর ভেতরে হঠাৎ করেই চম্পা ম্যাডামের ফোন যে সালমান তো আর নেই। তখন কী হয়েছে, কীভাবে হয়েছে কোনোকিছু না জিজ্ঞেস করে বাসায় গিয়ে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। পাঁচটার দিকে এফডিসির প্রচুর মানুষের ফোন পেলাম যে এফডিসিতে তার লাশ এসেছে। এরপর তার খাটিয়ার পাশে গিয়ে একটু দেখলাম। তারপর ওকে বিদায় করে দিলাম। ওকে নিয়ে ওই ছবিটি আর করা হয় নি।’
সোহানুর রহমান সোহান বলেন: ব্যক্তি সালমান অনেক ভাল মানুষ ছিল। ভালো ব্যবহার করতো। একজন হিরোর যে রকম হওয়া উচিত ছিলো সেরকমই ছিল। তাকে ডাকলে পাওযা যেতো। এখনকার হিরোরা মনে করে, আমি কী যেন একটা হয়ে গেছি। আমার শাকিবের কথাই বলি। তাকে ফোনে পাওয়া যায় না। বাসার নিচে গিয়ে বসে থাকতে হয়। আবার কখনো বাসায় থেকেও বলে যে সে নেই।
‘পৃথিবীটা আসলে ছোট। আজ যে স্টার কাল সে স্টার নাও থাকতে পারে। সালমানের কাছ থেকে এই শিক্ষাগুলো নেওয়া উচিত। আজ এতো বছর পরও সালমানকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনা যেই সেই আলোচনা না। আমি তো টের পাচ্ছি । এই চ্যানেল, সেই পত্রিকা। সবাই তাকে স্মরণ করছে।’
সোহান বলেন: সবাইকে মনে রাখা উচিত আমাকে যেন সবাই মনে রাখে সেভাবে কাজ করা। সালমান সেটা করেছেন। কষ্টের বিষয় যে আমরা তাকে সেময়ের অনেক আগে হারিয়ে ফেলেছি।