শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত অং সান সু চির হাত ধরে মিয়ানমার গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের দ্বারপ্রান্তে থাকলেও ওই দেশের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের যেমন উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই, তেমনি নিজেদের জন্য ‘গলার কাাঁটা’ হয়ে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের জন্যও এ মুহূর্তে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো উপলক্ষ আসেনি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, খুব দ্রুত বা নিকট ভবিষ্যতে কিছু আশা করা উচিত হবে না।
তারা বলছেন, মিয়ানমারে গণতন্ত্র যদি অব্যাহত থাকে, গণতন্ত্রের পথ ধরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মানবাধিকার যদি নিশ্চিত হয়, তা হলে দূর ভবিষ্যতে একদিন বাংলাদেশ যেমন এ সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারবে, তেমনই বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারাও একদিন তাদের দেশ-ঘর-ভূমিতে ফেরত যেতে পারবে। তবে সেজন্য একাধিক প্রজন্মও লেগে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
মিয়ানমারে ঐতিহাসিক নির্বাচনে সু চির এনএলডি’র বিজয়ের পর বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ মুহূর্তে যে বড় প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে তার একটি এরকম: নিরাপত্তার ভয়ে যে মানুষটি নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলো অন্য কোনো দেশে, বা যে মানুষটি নিজের দেশে ভয়ে কুঁকড়ে মুকড়ে বাঁচতো, মিয়ানমারের নির্বাচন এবং গণতন্ত্র কি সেই মানুষগুলোর ভাগ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? সু চির জয়ের পর মিয়ানমারের লাখ লাখ রোহিঙ্গার দুঃখ-কষ্ট দূর করতে এবার কি আশার আলো দেখবে সারা বিশ্ব?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো না কোনো সময় হয়তো সেই সমস্যার সমাধান হলেও তা খুব শিগগিরই হচ্ছে না। বাংলাদেশও খু শিগগিরই রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। তদের মতে, হয়তো পরিবর্তন আসবে। তবে সেটা এখনই না। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো অনেকটা সময়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, মিয়ানমারের সংবিধানেও কিছু বিষয় রয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বই নেই। এখনও দেশটির বর্ডার ম্যানেজমেন্ট সেনাবাহিনীর হাতে।
‘সুতরাং রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু আশা করলেও সেটা যে খুব দ্রুতই হবে সেরকম কিছু আশা করতে পারছি না।’
তার এই কথার সঙ্গে একমত বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবীর।
তিনি বলেন, একটি বিষয় আমাদেরকে মনে রাখতেই হবে। মিয়ানমারে কিছু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি রয়েছে, যার সঙ্গে এই সমস্যার তীব্র যোগসূত্র রয়েছে।
‘রোহিঙ্গাদের সেখানে নাগরিক হিসেবেই বিবেচনা করা হয় না। সেখানে রোহিঙ্গাদের বিষয় নিয়ে কথা বললে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মন ভাঙার কারণ হবে। সেটা নিশ্চয়ই নতুন গঠিত একটি পার্লামেন্ট চাইবে না। ৭০ লাখ মানুষের হয়ে কথা বলতে গিয়ে প্রায় ৬ কোটি মানুষের ভোট কেউ হারাতে চাইবে?’ এমন প্রশ্ন রেখেছেন হুমায়ুন কবীর।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্কসহ কূটনৈতিক বিষয় কাভার করা ইংরেজি দৈনিক দি ইন্ডিপেন্ডেন্টের সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর ভুইয়া বলেন, দেশটির মিলিটারি এবং অং সান সু চির মধ্যে অনেকগুলো বিষয়ে মতভেদ থাকলেও বেশ কিছু বিষয়ে তারা একমত। তার একটি হচ্ছে যে তাদের মতো করে তাদের চিন্তায় দেশের স্বার্থে তারা রোহিঙ্গাদের কোনো ছাড় দিতে চান না।
‘এতোগুলো বছর তিনি গৃহবন্দী হিসেবে কাটিয়েও, শান্তির দূত হয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জনের পরও অং সান সু চি কখনো রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো কথা বলেননি,’ মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, সেটা অনেকের কাছেই দৃষ্টিকটু লাগলেও তিনি যে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের পক্ষে বলেননি সেটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
তবে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় রোহিঙ্গারা ভবিষ্যতে কোনো ফল পেলেও পেতে পারেন বলে তারা মনে করছেন।
চ্যানেল আই অনলাইনকে সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর ভুইয়া বলেন, নিশ্চয়ই সু চির নিজস্ব রাজনৈতিক এজেন্ডা আছে। তিনি হয়তো ভেবেছেন, আগে নির্বাচনে জয়লাভ করে নিই, দল ক্ষমতায় যাক; তারপর এসব সমস্যা সমাধানে কাজ করবো। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আসলেও সেটা যে খুব শিগগিরই আসছে না তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। তবে আস্তে আস্তে হয়তো এই সমস্যার সমাধানে কাজ করবেন তিনি (সু চি)।
একই কথা আমেনা মহসীনের কণ্ঠেও।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব সবসময় থেকে যাবে। এবারের নির্বাচনে জয়লাভ করেও প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না সুচি, কারণ সু চির স্বামী বিদেশী এবং বাচ্চারা বিদেশী নাগরিকত্বধারী।
‘সুতরাং সেখানকার পার্লামেন্টেও সু চির দলের বাইরে অন্যদের, বিশেষ করে বিদায়ী জান্তা সমর্থিত সরকারি দলের বেশ প্রভাব থেকে যাবে। তবে যেহেতু এখন দেশটিতে গণতন্ত্র এসেছে, সুতরাং ধীরে ধীরে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলেই আশা করা যায়,’ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবীর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হলেও হতে পারে তবে সেজন্য কমন এজেন্ডার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। শাসন কাঠামোর মাধ্যমেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু সেজন্য এখনো অনেকটা সময় গুণতে হবে।
জাতিসংঘ এবং সরকারি হিসাবে এখন বাংলাদেশ বাস করা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার। তবে প্রকৃত সংখ্যা পাঁচ লাখ হবে বলে স্থানীয়ভাবে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশের বাইরেও বিভিন্ন দেশে বাস করছে অনেক রোহিঙ্গা। চলতি বছরের শুরুর দিকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডে পাড়ি জমানোর সময় গণমাধ্যমে তাদের দুর্দশার চিত্র আসার পর এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মেলন হলেও সমস্যা সমাধানে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি খুব কম বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।