চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সুবচন নির্বাসনে, সুযোগ্য নেতা কারাগারে

নুরুল আজিম রনি, তাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সবচেয়ে আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা। বর্তমানে অব্যাহতি পাওয়া ছাত্রলীগ নেতা। আলোচনা-সমালোচনা, নিন্দা, নন্দন, ফুল ও চন্দন সবই জুটেছে এই নেতার নামের পাশে। সম্প্রতি তিনি নতুন করে আবার আলোচনায় এসেছেন। চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজের কথিত অধ্যক্ষ জাহেদ খানকে মারধোরের ঘটনায় তার জামিন নামঞ্জুর করে আত্মসমর্পনের আদেশ দেন নিম্ন আদালত। বর্তমানে তিনি জেল হাজতে আছেন।

ঘটনা একটু পেছানো যাক…চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর রনি আলোচনায় এসেছিলেন ইতিবাচকভাবে। দেশের বিপ্লবের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত চট্টগ্রামের সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে বিভিন্ন আন্দোলনের উদ্যোগ বেশ প্রসংশা লাভ করে। চট্টগ্রামের সিটি বাসগুলোতো সাধারণ ছাত্রদের অর্ধেক ভাড়ার নির্ধারণের দাবি নিয়ে রনি সাধারণ ছাত্রদের ব্যপক জনসমর্থন লাভ করে। এর ফলে স্থানীয় পরিবহন মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছে রনি পরিণত হন এক ভিলেন হিসেবে।

চট্টগ্রামে খেলার মাঠ বলতে এখন আর তেমন কিছুই অবশিষ্ট নেই। নগরীর জিমনেসিয়াম মাঠের সামনে এখন বাণিজ্যিক ক্রিকেট প্রশিক্ষণ হয়, আর্মি মাঠে গড়ে উঠেছে স্থাপনা। এই এম. এ আজিজ স্টেডিয়ামের আউটার মাঠ থেকে উঠে এসেছেন নান্নু, আকরাম খান, তামিম ইকবাল, নাফিস ইকবাল, আফতাব আহমেদের মতো ক্রিকেটাররা। চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়াম আউটার মাঠ দখল করে সুইমিং পুল ও বাণিজ্যিক স্থাপনা তৈরির বিরুদ্ধাচারণ করেছিলো নুরুল আজিম রনি। এই আন্দোলনেও সাধারণ ছাত্রদের সমর্থন ছিলো। বাকী ঘটনা আমরা সবাই জানি। ফলে আবারো অতি লোভী ব্যবসায়ীদের শত্রু হয়ে ওঠেন।

১৯৮৫ সাল থেকে ২০১৫, শিবিরের ক্যান্টনমেন্ট বলে পরিচিত চট্টগাম কলেজের ছাত্র সংসদে ছিলো না জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। মাঝে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ থেকে ২০০১ ও ২০০৮ এর নির্বাচনের পর থেকে আবারও সরকার গঠন করে ক্ষমতায় আছে। তবুও ২০১৫ সালে রনির নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র সংসদের দেয়ালে ৩০ বছর পর আবারও দেখা যায় জাতির জনকের ছবি। সেই সঙ্গে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাম ও বিভিন্ন প্রগতিশীল রাজনীতির চর্চা শুরু হয়। যা আগে ছিলো না, রনির সাহসিকতায় আরো কয়েকটি প্রগতিশীল সংগঠনের দুয়ার খুলেছে চট্টগ্রাম কলেজে। আজ রনির এই খারাপ সময়ে বাম ছাত্র নেতাদের পাশে না পাওয়াটা দুঃখজনক। এ ঘটনায় বরাবরের মতোই দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াত শিবিরের চক্ষুশূলও হতে হয় রনিকে।

চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কলেজ, ও বাণিজ্যিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যে যার মতো করে সরকার ঘোষিত নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করে এ শহরে বাণিজ্য করছে। প্রথম থেকেই এসব বাণিজ্যে-বুর্জোয়ার অবৈধ ব্যবসার প্রতিবাদ করে রনি। স্বভাবতই শিক্ষা বাণিজ্য করা শ্রেণীর চক্ষুশূল হতে হয় রনিকে।

রনিকে কারাগারে নিলে স্বতস্ফূর্ত জনগন রাস্তায় নেমে আসে

শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়ে একাধিকবার আলোচনায় এসেছে চট্টগ্রাম বিজ্ঞান কলেজ। ডিজিটাল ক্লাস রুম, আধুনিক ল্যাবসহ নানা তথ্য দিয়ে লোভনীয় অফারে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হয় এই কলেজে। শিক্ষার্থী-অভিভাবকের বরাবরেই অভিযোগ, নানা ছুতোয় জিম্মি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। অথচ বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ল্যাব ও কম্পিউটার ল্যাব ব্যবহার করতে পারেন না তারা। অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেছে। যা নিয়ে গতবছরও অভিযোগ ছিল এই কলেজের বিরুদ্ধে।

গেলো ৩১ মার্চ অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়ে রনির সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন কলেজ অধ্যক্ষ। তাদের তোপের মুখে অভিভাবকদের ফেরত দেয়া হয় উন্নয়ন ফির নামে ৯৭৩ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে জনপ্রতি ৫০০০ করে বাড়তি নেয়া টাকা। এসময় ছাত্রলীগ নেতা রনির সঙ্গে অধ্যক্ষের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। অভিভাবক ও সাধারণ ছাত্ররা এ আন্দোলনে রনির পাশে ছিল।

বরাবরের মতোই সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কলেজ অধ্যক্ষ ড. জাহেদ খান (যদিও তার ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে বিতর্ক আছে)। এদিকে কলেজটিতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষাবোর্ড। এই অধ্যক্ষ শিক্ষাজীবনে ইসলামি ছাত্র শিবির করতেন ও পরে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে নেপথ্যে সক্রিয় আছেন।

ভাইরাল হয়ে যাওয়া সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, বাক বিতণ্ডার এক পর্যায়ে বিজ্ঞান কলেজের অধ্যক্ষকে চড় মারেন রনি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে থাপ্পর মারার উদাহরণ নেহাতই কম নয়। আমাদের দেশের মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ অনিয়ম দেখে চড় মেরেছেন। তা মিডিয়াতে প্রচারও হয়েছে। রাস্তা-ঘাটে কিংবা রেল বাস স্টেশনেও চড় মারার নজীর আছে। মিনিস্টার চড় মেরে বলেছেন, যেখানে অনিয়ম সেখানেই প্রতিরোধ হবে। এমনকি রনির শহর চট্টগ্রাম সিটি মেয়রেরও রয়েছে রাস্তাঘাটে চড় থাপ্পর মারার নজির আছে। তারা কি আইনের আওতায় এসেছে? নাকি ক্ষমতার চেয়ারে থাকলে যাকে তাকে চড়-থাপ্পর মারা জায়েজ ?

একই ধারাবাহিকতায় রনিও যদি এই পথ বেছে নেয়। তাহলে কি দাঁড়ায়? রনির এক চড়ের বিনিময়ে যদি সাধারণ ছাত্রদের প্রায় অর্ধকোটি টাকা ফেরত আসে তাহলে চড়ই ভাল!

এবার আসি একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে, স্থানীয় প্রভাবশালী ধণিক গোষ্ঠীর কাছে নুরুল আজিম রনি বরাবরই মাথাব্যথার কারণ। রনির পদক্ষেপে তাদের বাণিজ্যে ধাক্কা লেগেছে। সেই সাথে তার বিরোধিতায় নেমেছে নিজ দলেরই কিছু সুবিধাভোগী নেতা।

সারা দেশের ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে মারামারি হয় টেন্ডার নিয়ে, ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে। অথচ প্রায় সাড়ে ৪ বছর দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম মহানগরের মত গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটের সাধারণ সম্পাদকের পদ যখন অভিমান করে ছাড়লেন; তখন তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৫টি মামলা আর দুই বছরের সাজা।

কথায় আছে রেগে গেলে নাকি হেরে যেতে হয়। রনিও হেরে গেছেন। এক বন্ধুর কাছে নিজের পাওনা টাকা আদায়ে ১৩টি চড় মেরে তিনি এখন জাতীয় শত্রুতে পরিণত!

আমরা ডিজিটাল দেশের নাগরিকরা কতটাই সচেতন এখন। আমরা ভিডিও দেখেই রায় দিয়ে দেই। অথচ তার অভিযুক্ত পক্ষের কোনো দোহাই মানি না। নিজের কষ্টের পাওনা টাকা চাইতে গেলে তা না দিয়ে বছরের পর বছর ঘোরালে মাথা কার না গরম হয়। আর সেই মাথা গরমের খেসারত দিতে হলো রনিকে! টাকায় টাকা গেলো, কপালে কলঙ্ক আর মামলার মালা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিহত ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের মা ও কারাবন্দী ছাত্রলীগ নেতা রনির মা

যত রাগই হোক, অপরাধই হোক কারো গায়ে আপনি হাত তুলতে পারেন না। এটা অন্যায়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই রনি এখন অপরাধী। কিন্তু তাকে তো চড়ের মামলা দেয় হয়নি। তাকে চাঁদাবাজি মামলা খেতে হয়, কোর্টে হাজিরা দিতে দিতে জুতোর তলা ক্ষয় করতে হবে। উকিলের পেছনে ভুরি ভুরি টাকাও ঢালতে হবে।

একদিক দিয়ে কারাগারে গিয়ে রনি বেঁচে গেছেন কারণ তাকে আরেক প্রতিবাদী সাহসী নেতা দিয়াজের মত করুণ মৃত্যুবরণ করতে হয়নি। এসবই ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে প্রতাপে থাকা আদর্শহীন নেতাদের কূটকৌশল।

রনি শুধু আর ছাত্রলীগ নেতা নয়, ছাত্র নেতা হিসেবে নিজেকে উজ্জ্বল করেছেন। ছাত্রলীগের সমসাময়িক আর কোনো নেতার মুক্তির জন্য রাস্তায় সাধারণ ছাত্র ও অভিভাবকেরা নেমেছে কীনা তার দৃষ্টান্ত নেই।

রনি সংক্রান্ত বিষয়গুলো পর্যলোচনা করলে দেখা যায় বরবরই সুবিধাবাদী ধনী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তিনি। এই সমাজে রনির মতো বিপ্লবীরা আজ অসহায়। বিপ্লবী এলাকা বীর চট্টলা। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদরা এই চট্টগ্রামে জন্ম নিয়েছেন। এই বিপ্লবের শহরে জন্ম নেয়া রনিরা দমে থাকতে পারে না। চট্টগ্রামের সাধারণ ছাত্র অভিভাবক জনগণেরাই ঠিক করবে রনি নিন্দিত নাকি নন্দিত!ছাত্র রাজনীতির অবক্ষয়ের যুগে একমাত্র ব্যতিক্রম রনি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)