চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সুপ্রিম কোর্টে ‘লেডি জাস্টিস’ এর ভাস্কর্য ও হেফাজতে ইসলাম

সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করেই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ‘গ্রিক দেবী’ থেমিসের ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবী তুলেছে হেফাজতে ইসলাম। কারণ হিসেবে তারা দেখিয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা।

বিশ্বে কোডিফাইড আইনের গোড়াপত্তন ঘটে প্রথম রোমান আমলে। রোমান সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রভূত উন্নতি ঘটে বিশ্বের আইনশাস্ত্রের। মহান রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান এবং কনস্টানটাইনের ভূমিকা এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। রোমানদের কাছে ‘লেডি জাস্টিস’ বিবেচিত হতেন ন্যায়পরায়ণতার দেবী হিসেবে। আর এই লেডি জাস্টিসই ছিলেন গ্রিক মিথলজির ‘দেবী থেমিস’।

গ্রিক মাইথোলজি অনুযায়ী দেবী থেমিস ছিলেন গ্রীকদের ন্যায়পরায়ণতার দেবী। যার দু’চোখ কালো কাপড়ে বাধা। একহাতে খোলা তলোয়ার আর আরেক হাতে দাড়িপাল্লা।দাড়িপাল্লা হলো ন্যায়বিচারের প্রতীক। যাতে বোঝানো হয়, আইন সবাইকে সমভাবে বিচার করবে। চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকার কারণ যাতে বোঝানো হয় যে , আইন অন্ধ। চোখে দেখলে যাতে পক্ষপাতিত্ব সৃষ্টি হতে না পারে, সেই কারণেই আইনের চোখ কালো কাপড়ে ঢাকা থাকে, যাতে পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে বিচার করা যায়। আর হাতে খোলা তলোয়ার থাকার মানে হলো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনে আইন শক্তি প্রয়োগ ও করতে পারে।

বিভিন্ন দেশে রয়েছে ন্যায়ের প্রতীক লেডি জাস্টিসের ভাস্কর্য

বিশ্বজুড়েই ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ন্যায়পরায়ণতার দেবী থেমিসের এই মূর্তি। কিন্তু আজ আমাদের বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম  নামের এই সংগঠনটি এবার ধর্মীয় অনুভূতির ধোঁয়া তুলে নিষিদ্ধ করার দাবি করে বসলো এটিকে। সবকিছুতেই ধর্মীয় অনুভূতির ধোঁয়া তোলা এই সংগঠনগুলোর ক্রমশই একটি মারাত্মক মুদ্রাদোষে পরিণত হচ্ছে। তাদের অনেকেরই প্রিয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের আদালতে ও যে দেবী থেমিসের এই প্রতীক ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তা সম্ভবত জানা নেই এদের। যেমন ব্যবহৃত হয়ে থাকে মিশর, তুরস্ক, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো অপরাপর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রেও।

এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার যে থেমিসের মূর্তিটি শুধুমাত্র একটি প্রতীকী ভাস্কর্যই, কোনো মন্দিরের পূজোর প্রতীমা নয়। একই কথা প্রযোজ্য ‘অপারজেয় বাংলা’ বা ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’র ক্ষেত্রেও। এগুলো শুধুই প্রতীক ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের। এই সহজ ব্যাপারটির সাথে ধর্মীয় অনুভূতির জুজু মেশানো তাই নিতান্তই অনাকাঙ্ক্ষিত।

শাহবাগের উত্তাল দিনগুলোতে ‘শুয়োরের সাথে সহবাসের ফতোয়া’ অস্বীকার করা দামাল তারুণ্যকে ঠেকাতে সুচতুরভাবে দেশের সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে উত্তেজিত করার কূটকৌশল হিসেবে মাহমুদুর রহমানের ‘আমার দেশ’ পত্রিকাচক্র প্রচার করা শুরু করে যে শাহবাগ আন্দোলন আসলে নাস্তিকদের আন্দোলন। ব্লগার আরিফ জেবতিক বেশ ক্ষোভের সাথেই এক টকশোতে বলেছিলেন, ‘আমি জুম্মার নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে দেখি আমাদের ছবি নাস্তিক ট্যাগ দিয়ে আমার দেশ পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে!’

এরপরের ইতিহাস সবারই জানা। রাতারাতি নাস্তিক দমনের জিহাদি জোশে সংগঠিত হয় হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি। ‘ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট চালানো নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবি’ জানিয়ে দলে দলে জড়ো হন শাপলা চত্বরে। ১৩ দফা দাবিতে মতিঝিল শাপলা চত্বর দখলের মধ্য দিয়ে কার্যত পুরো ঢাকা শহরেই আতঙ্ক ছড়িয়ে দেন তারা। ৫ মে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মুখে সেদিন তারা পিছুটান দিলেও কার্যত তোষণমূলক নীতির কারণে ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে এই সংগঠনটি।

শাহবাগের আন্দোলনের কার্যত সমাপ্তি হলেও এই সংগঠনটির তৎপরতা কিন্তু থেমে থাকেনি। উপরন্তু সবাই দেখেছেন সরকারি দলের একাধিক কর্তাব্যক্তি ও হাটহাজারিতে ছুটে গেছেন শফি হুজুরকে শান্ত রাখতে। তাকে সন্তুষ্ট রাখতে রেলের জমি লিজ দেয়া শুরু করে অনেক উদ্যোগই নিয়েছেন তারা। এই নতজানু নীতি কিন্তু তেমন কোনো কাজেই আসেনি। এত এত উপহার পেয়ে হুজুর শান্ত তো হনই নি, বরং উত্তরোত্তর বেড়ে গেছে তাদের দাবি দাওয়া। আর অনেকটা সহজেই মেনে নেয়া হয়েছে।

গত বছর তারা হঠাৎই দাবি তোলে পাঠ্যপুস্তক থেকে হিন্দু আর নাস্তিক লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার। সে সময় এটা নিয়ে অনলাইনে ব্যাপক সমালোচনা করাও হয়েছিলো। কিন্তু বিস্ময়করভাবে দেখা গেলো এ বছর পাঠ্যপুস্তক থেকে ঠিকই প্রায় ৩৭ টি মানসম্পন্ন লেখা প্রত্যাহার করা হয়েছে তাদের দাবি মেনে। কিন্তু যোগ করা হয়নি জঙ্গিবাদ বিরোধী বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নতুন কোন লেখা।

আর এবার তোলা হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে গ্রিক মিথোলজির ন্যায়বিচারের প্রতীক দেবী থেমিসের মূর্তি সরিয়ে ফেলার দাবি। অথচ বিশ্বজুড়ে এই প্রতীকটি ব্যবহৃত হয় ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে। এমনকি তাদের অনেকেরই প্রিয় রাষ্ট্র পাকিস্তান ও এর ব্যতিক্রম নয়।

ভাস্কর্য আর মূর্তিপূজার মধ্যে যে যোজন যোজন দূরত্ব রয়েছে তা সম্ভবত তাদের মস্তিষ্কে ধারণ করা সম্ভব হয়নি। দেবী থেমিসের মূর্তিতে কেউ তো আর ফুল, বেলপাতা, তুলসী নিবেদন করে না যে তা মূর্তিপূজা হিসেবে বিবেচিত হবে! এটা শুধুই একটা ন্যায়পরায়ণতার প্রতীক ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দাবিতে সফলতা পেলে আমি অবাক হবো না যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাজেয় বাংলা বা শহীদ মিনার বা সাভারের স্মৃতিসৌধ সরিয়ে নেয়ার দাবিও ওঠে। কারণ প্রতি বছর ফুলেল শুভেচ্ছা সহকারে শহীদ স্মরণকেও হয়তো তারা পূজা হিসেবে ঘোষণা দিতে পারেন! কচু কাটতে কাটতেই তো ডাকাত হওয়া যায়!

হেফাজতের দাবি-দাওয়ার বহর দেখে সবশেষে সরকারের দায়িত্বশীল মহলের মধ্যেও ক্রমশ দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এরই প্রতিফলন দেখা যায় সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের বক্তব্যে। শুক্রবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় নগরীর টিআইসি মিলনায়তনে তীর্যক নাট্যদলের একুশে স্মরণে ‘নাট্যভাষা বাংলা আমার’ শীর্ষক পাঁচ দিনের নাট্যায়োজনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী বলেন,

‘যে পরিবর্তনকে হেফাজত বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানায় সেই পরিবর্তন আমার না পড়লেও চলে। তারা হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের আন্তর্জাতিক প্রতীক বিবেচিত ভাস্কর্যটি তুলে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ক’দিন পর এ মঞ্চে নাটক করতে পারবেন না, গান গাইতে পারবেন না, আবৃত্তি করতে পারবেন না। এখানে তারা সমাবেশ করবে। হেফাজত এমনভাবে বলছে মনে হয় এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নয়, যেন ইসলামি প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশ।’

এভাবেই ক্রমশই বেপারোয়া হয়ে উঠছে হেফাজতে ইসলাম নামের এই উগ্রপন্থী সংগঠনটি। এই হেফাজতে ইসলামের সাথে জড়িত সেই ব্যক্তিরাই যারা একদিন ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ শ্লোগানে প্রকম্পিত করে তুলেছিলো এ দেশের আকাশ বাতাস। আজ তারাই আবার আবির্ভূত হয়েছে নবরূপে, নব ফ্লেভারে। নতুন বোতলে পুরনো মদের মতোই। আর দিন দিন ক্রমশঃ ভয়াবহ এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে পরিণত হচ্ছে তারা। আলাদিনের দৈত্যের আসল চেহারাটি দেখা দিয়েছে ভয়াবহ রূপেই। তাকে বোতলে ভরার মন্ত্রটি জানা আছে কিনা, ভবিষ্যতের ইতিহাসই কেবল পারবে তার সঠিক উত্তর দিতে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)