চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সুন্দরবনের সর্বনাশ করে বিদ্যুত প্রকল্প নয়

জঙ্গিবাদ অবশ্যই দেশের সামনে এখন এক নম্বর সমস্যা। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকার যা কিছু করছে, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রশংসনীয়ও বটে। কিন্তু জঙ্গিবাদ বিরোধী কার্যক্রমের ডামাডোলে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ইস্যু যেন চাপা পড়ে না যায়। যেমন রামপালে নির্মাণাধীন ভারত-বাংলাদেশের কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অস্তিত্বের সঙ্গেও প্রকল্পটির যোগ আছে বলে মনে করছেন।

বিষয়টি নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধান দরকার। সরকার ও আন্দোলনকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংলাপ দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার যে কোনো মূল্যে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জিদ পরিহার করা। ইতিমধ্যে দেশব্যাপী এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে একটা জনমত গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণ থেকে সুন্দরবন বাঁচাতে ব্যাপক প্রচারণা চলছে।

বিভিন্ন ব্যক্তি তাদের টাইমলাইনে, ‘আমি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের একজন ‪#‎নাগরিক এবং সংবিধানের ৭ এর (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দেশের ‪#‎মালিক। আমি রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের তীব্র ‪#‎প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিদ্যুৎ আমিও চাই কিন্তু ‪#‎সুন্দরবন ধ্বংস করে আমার বিদ্যুৎ-এর দরকার নাই। আমার এ প্রতিবাদ আমলে নিন।’- এমনটা লিখে শেয়ার দিচ্ছেন।

সুন্দরবনের পাশে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি বিনষ্ট হবে এমন অভিযোগে আন্দোলন করে আসছে তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ দেশের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন। প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি সই হয়েছে।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা পর্যন্ত যেসকল কর্মকাণ্ড চলবে সেটা একটি দেশের বনাঞ্চল ধ্বংসের মূল কারণ। বর্তমানে এমনিতেই বনের বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে নানাকারণে। আবার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন হলে সুন্দরবনের ভিতরের বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর নতুন করে মৃত্যু হবে।

দেশের মধ্য থেকে অনেক রকম বাধা এসেছে বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে বাধা পাত্তা দেননি। তার যুক্তি-এক. উন্নয়ন করতে গেলে জলা, বনের কিছুটা ক্ষতি স্বীকার করতেই হবে। উন্নয়নের সুফল এই ক্ষতি পুষিয়ে দেবে। দুই. এখন উন্নত প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করলে পরিবেশের ক্ষতি সহনীয় মাত্রায় হবে। ক্ষতির চেয়ে লাভ বেশি হবে। তিন. সারা দেশে বিদ্যুতের জোয়ার এলে, এরকম ছোটখাটো দু’চারটে ক্ষতি মানুষ ভুলে যাবেই। চার. যে প্রক্রিয়ায় আমরা গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি, একই প্রক্রিয়ায় উন্নয়নবিরোধী সব তৎপরতা থামিয়ে দেয়া যাবে।

অপরিণামদর্শী উদ্যোগ অনেক সময়ই বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশেই তার নমুনা আছে। কথিত লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র করেছিলেন একই যুক্তি ও বিশ্বাসে। পাহাড়িদের দুর্দশা যা-ই হোক না কেন, জলবিদ্যুতের উন্নয়ন তা ভুলিয়ে দেবে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের উন্নয়নতত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
যেনতেন প্রকারে, শক্তি প্রয়োগের নীতিতে, জনমানুষের ভাবনার বিপরীতে উন্নয়ন অনেক সময় বড় বিপদই ডেকে আনে। রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প যেন তেমন কোনো পরিণতি সৃষ্টি না করে-তা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।

সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন। জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও শিক্ষা ঐতিহ্য বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। জাতিসংঘের জলাভূমি বিষয়ক সংস্থা রামসার কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও বিশেষ শ্রেণির ডলফিনের জন্য বিখ্যাত এ সুন্দরবন। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে মানুষ, জলযান, যত বেশি চলাচল করবে সুন্দরবনের ভেতরে বাস করা সব প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য তা বিপজ্জনক হবে, এ চিন্তায় ইউনেস্কো, জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা ও ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান সুন্দরবনকে রক্ষার আহ্বান জানাচ্ছে বেশ ক’বছর ধরেই।

রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে বন বিভাগের দুই পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে সম্ভাব্য তিনটি ক্ষতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে গরম পানি বর্জ্য হিসেবে নির্গত হবে, তা সুন্দরবনের পানির সঙ্গে মিশবে। এতে সুন্দরবনসংলগ্ন নদীগুলোতে বসবাসকারী প্রাণী ও উদ্ভিদ কণারা বাঁচতে পারবে না। সুন্দরবনের বিপুল মাছ, পাখি ও বন্য প্রাণী এই প্রাণী ও উদ্ভিদ কণা খেয়ে বেঁচে থাকে। এর ফলে সুন্দরবনের নদীগুলোতে বসবাসকারী ডলফিনদের বিচরণও বাধাগ্রস্ত হবে।

সেখানে বসবাসকারী প্রাণী, উদ্ভিদ ধ্বংস হয়ে যাবে। একটি দেশে ভূখণ্ড অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বন থাকতে হয়। দেশের জন্য সুন্দরবন বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। সুন্দরবনের কারণে দেশে বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ সহজে হয় না, হলেও ক্ষতির পরিমাণ নিতান্তই কম। দেশের ইকোসিস্টেম বিলীন হবার আশঙ্কাও থেকে যায়, যা একটি দেশের জন্য মারাত্মক হুমকির।কিন্তু সরকারের লোকেরা গো ধরেছে, সুন্দরবন বন থাকুক আর না থাকুক, উন্নয়ন চলবেই। সেই উন্নয়ন জোয়ারে তাবৎ বাধা উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীনরা সুন্দরবনকে বিপদাপন্ন করেই রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।

কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে যে বিদ্যুৎ এসেছে, তার চাইতে অনেক বেশি ক্ষতি করেছে এই প্রকল্প। আর্থিকভাবে, পরিবেশগতভাবে প্রতিবেশভাবে এই ক্ষতি অপূরণীয়। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাহাড়ি মানুষ উচ্ছেদ হয়েছে, জলমগ্নতায় তাদের জীবন বদলে গেছে। এই উন্নয়ন প্রকল্পকে তারা নিজেদের জীবনহানির সমতুল্য ভেবে দশকের পর দশক সশস্ত্র সংগ্রাম করেছে। সেই সশস্ত্র সংগ্রামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে বছরের পর বছর ধরে সামরিকীকরণ প্রস্তুতি নিতে হয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে অস্ত্র, বারুদ, ক্যান্টনমেন্ট আর সামরিক খাতে। এক দেশের মধ্যে দুই দেশ হয়েছে। এক দেশের মানুষ পরস্পরকে শত্রু ভেবে যুদ্ধ ও প্রতিরোধ চালিয়ে গেছে বহু বছর। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিবেশ, প্রকৃতি, জনমানুষের জীবন বিবেচনায় সবচেয়ে ক্ষতিকর উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।

সুন্দরবনের জোয়ার-ভাটার স্থানগুলোতে পানির ওপরে নির্ভরশীল পাখিদের বসতি এলাকা। সেখান থেকে তারা খাবার সংগ্রহ করে ও বিচরণ করে। নদীর পানিতে গরম পানি ছাড়া হলে ওই পাখিদের পক্ষে সেখানে অবস্থান করা সম্ভব হবে না। বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বের হওয়া উত্তপ্ত পানি সুন্দরবনের নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাঙের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়বে। রামপাল প্রকল্পের জন্য সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদী দিয়ে কয়লা পরিবহন করা হবে।

বন বিভাগের প্রতিবেদনে উন্মুক্তভাবে কয়লা পরিবহনের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়েছে, এতে বিপুল পরিমাণে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ও মারকারি নিঃসরিত হবে। এই তিনটি পদার্থ বাতাসে মিশলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে সেখানকার জীববৈচিত্র্য এবং আশপাশে বসতি গড়া মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

সুন্দরবন শুধু একটি বন মাত্র নয়, এটি একটি প্রাকৃতিক ইকোপার্ক। আমাদের দেশে হাতেগোনা যে কয়েকটি পর্যটন সাইট আছে সুন্দরবন তার অন্যতম। প্রতি বছর দেশি-বিদেশি কয়েক লক্ষ পর্যটক এর অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসে। ভ্রমণপিপাশুদের ক্ষুধা মিটানোসহ যা আমাদের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে। উপকূল তীরবর্তী অবস্থানের কারণে এটি আমাদের জন্য একপ্রকার প্রাকৃতিক দেয়াল হিসাবে কাজ করছে। অন্ন সংস্থান করছে পার্শ্ববর্তী কয়েক লক্ষ মানুষের। প্রলয়োঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় সিডর-আইলার আঘাত নিজের বুকে নিয়ে রক্ষা করেছিলো আমাদেরকে। আমাদের এই চিরদূর্ভাগা দেশটাকে।

অথচ আমরা কতো অকৃতজ্ঞ।আমরা অবশ্যই উন্নয়ন চাই। বিদ্যুৎও চাই। আমাদের কর্মসংস্থান দরকার। কর্মসংস্থানের জন্য শিল্পায়ন দরকার। আর শিল্পায়নের জন্য চাই বিদ্যুৎ। তবে অবশ্যই তা সুন্দরবনের ক্ষতি করে নয়। এই প্রকল্প যদি সামান্যতম ক্ষতির কারণও হয় তবে এই প্রকল্প বন্ধ হওয়া উচিত। কারণ বিদ্যুৎ দেশের অন্য যে কোন স্থানে উৎপাদন করা যাবে, কিন্তু সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না।

কাজেই গোয়ার্তুমি বা জিদ নয়, জাতীয় স্বার্থেই রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পটি নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা দরকার। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই, তারা ‘ভারতের ইচ্ছের দাস হিসেবে ভূমিকা পালন করছেন’-এমন জঙ্গি ভাবনার সঙ্গে আমরা একমত নই। কথা হলো, সরকারের বিবেচনায় এর ভালো দিকগুলো সামনে আসতেই পারে। বিদ্যুৎ, কর্মসংস্থান, উন্নয়ন-এসবকে নিশ্চয়ই তুচ্ছ করে দেখা যাবে না।

আবার যারা সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করছেন, তাদের সকলের সততা ও দেশপ্রেমকেও উপক্ষো করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, দেশটা আমাদের সবার। এখানে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ সরকারে যেমন আছে, বাইরেও আছে। এখন এই শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সবাই মিলে যেমন জঙ্গিবাদ ঠেকাতে হবে, তেমনি দেশের মানুষের সর্বোচ্চ কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়েই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)