চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সুখ, সুখ দিবস ও মাহমুদুল্লাহ-দীনেশের ছক্কা!

মা ন্না দে গেয়েছিলেন বটে, ‘সবাই তো সুখী হতে চায়’, কিন্তু মুশকিল হল, সুখ কীসে হয়, কী পেলে ভালো থাকা যায়, প্রশ্নটা ভয়ানক গোলমেলে। ভেবে দেখুন তো, ভূতের রাজা এসে যদি এক্ষুণি তিনটে বর দিতে চায়, কী চাইবেন? মাথা চুলকে যদি চেয়েও ফেলেন তিনটে, তার পর মনে হবে না তো, ইশ্, এটার বদলে ওটা চাইলে ঢের ভালো হত! আসলে চাহিদার কোনো শেষ নেই, সুখেরও কোনো সীমা নেই। হয়তো পরিমাপকও নেই। তারপরও কিন্তু সুখের জন্য তত্ত্ব-তালাশ থেমে নেই!

এই সুখের খোঁজ-খবর নিতে, সুখের নিকুঞ্জে নিজেদের অবস্থান জানতে ‘সুখ দিবস’ নামে একটা আন্তর্জাতিক দিবসই ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতি বছর ২০ মার্চ অনেক ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গোটা বিশ্বে পালন করা হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস’। যদিও বাংলাদেশের মানুষ এত দিনে নির্ঘাৎ বুঝে গেছেন যে, গিয়েছেন যে, ‘সুখ কেবলই ফাঁকি৷’ কারণ সমীক্ষা অনুসারে আমাদের দেশটি-‘নিশিদিন’ নিতান্তই ‘সুখহীন৷’ ২০১৮ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের স্থান ১৫৬টি দেশের মধ্যে ১১৫ নম্বরে! অর্থাৎ প্রায় তলানিতে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৮ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে প্রতি বছর ২০ মার্চ এ দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। দিনটি পালন সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘‘সাধারণ পরিষদের সব সদস্য এ বিষয়ে একমত যে, সবারই জীবনের মূল উদ্দেশ্য সুখে থাকা।’’

শুধু তাই নয়, সার্বিকভাবে ‘‘একটি সার্বিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও প্রয়োজন যার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ সর্বোপরি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য প্রতি বছরের ২০ মার্চ এ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’

আন্তর্জাতিক সুখ দিবস প্রচলনের প্রচারটি শুরু হয় মূলত হিমালয়ের দেশ ভুটানের হাত ধরে। দেশটিতে ইতিমধ্যে সুখ-সূচকের ভিত্তিতে জাতীয় সমৃদ্ধির পরিমাপের প্রচলন করা হয়েছে। তারা জাতিসংঘের কাছে বছরের একটি দিন সুখ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানায়। এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

এবার বিশ্বে সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ ফিনল্যান্ড। প্রতিবেশী নরওয়েকে পেছনে ফেলে তালিকার এক নম্বরে উঠে গেছে দেশটি। গত বছর এই তালিকায় ৫ম দেশ ছিল ফিনল্যান্ড। আর নরওয়ে ছিল এক নম্বরে। কিন্তু এবার সেই নরওয়েকে নকআউট করে দিয়ে তারা এক নম্বরে উঠে এসেছে। তালিকা অনুযায়ী তৃতীয় ডেনমার্ক, চতুর্থ আইসল্যান্ড, পঞ্চম সুইজারল্যান্ড, ষষ্ঠ নেদারল্যান্ডস, সপ্তম কানাডা, নিউজিল্যান্ড অষ্টম, সুইডেন নবম আর অস্ট্রেলিয়া ১০ম সুখী দেশ।

যুক্তরাষ্ট্রও এবার চার ধাপ পিছিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সুখী দেশের তালিকায় ১৮ তম অবস্থানে রয়েছে। তবে যুক্তরাজ্য আগের অবস্থানেই রয়েছে, দেশটির অবস্থান ১৯তম। এছাড়া জার্মানি ১৫তম, সিঙ্গাপুর ৩৪তম ও ফ্রান্স ২৩তম সুখী দেশের তালিকায় রয়েছে।

আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সুখী দেশের তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। দেশটি ৭৫তম স্থান দখল করতে পেরেছে। এ তালিকায় ভারতের অবস্থান ১৩৩তম, নেপাল ১০১ এবং শ্রীলঙ্কা ১১৬তম। গত বছর ভারত ১২২তম, নেপাল ৯৯ এবং শ্রীলঙ্কা ১২০তম অবস্থানে ছিল।

এবার সবচেয়ে কম সুখী দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে আফ্রিকার বুরুন্ডি। প্রশ্ন হলো ভয়াবহ ঠাণ্ডার দেশ ফিনল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে ‘সুখী দেশ’ কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, ফিনল্যান্ডে রয়েছে প্রাকৃতিক সুরক্ষা, শিশুদের যত্নের ব্যবস্থা, আছে ভালো স্কুল। আছে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা। দেশটিতে এমনি আরো অনেক সেবা রয়েছে, যার জন্য ফিনল্যান্ডবাসী সুখী। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিনল্যান্ডে চলে এসেছেন ব্রায়ানা ওয়েনস। তিনি এখন ফিনল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহৎ শহর এসপোতে শিক্ষকতা করেন। এই শহরের জনসংখ্যা মাত্র দুই লাখ ৮০ হাজার। এ সম্পর্কে ব্রায়ানা ওয়েনস বলেন, আমি অন্য মার্কিনিদের সঙ্গে কৌতুক করি। তাদেরকে বলি আমেরিকানরা যেসব স্বপ্ন নিয়ে আছেন আমি সেই স্বপ্ন খুঁজে পেয়েছি ফিনল্যান্ডে। আমার মনে হয় এই দেশটিতে যা কিছু রয়েছে তার সবটাই মানুষের সফলতার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে পরিবহন সর্বত্র একই অবস্থা। মানুষ যাতে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তার জন্য এই প্রচেষ্টা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমেই সামাজিক সঙ্কট বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে অসমতা, আস্থার সঙ্কট, সরকারের মধ্যে কম আস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে এখন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তা সেদেশের নাগরিকদের সুখী হওয়ার ক্ষেত্রে অনুকূল নয়। সরকারে যখন আস্থা একেবারে কমে যায়, দুর্নীতি বেড়ে যায়, অসমতা ঊর্ধ্বমুখী থাকে, স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলোর অবনতি হয়, সেই পরিবেশকে তো ভালো থাকার অনুভূতির অনুকূলে বলা যায় না।

আন্তর্জাতিক সুখ দিবস পালনের প্রেক্ষাপট যাই হোক, এটুকু সহজেই অনুমেয় যে পশ্চিমের শিল্পোন্নত ও কল্যাণমূলক দেশগুলিই থাকবে এই তালিকার প্রথমে৷ অতএব তালিকার প্রথম চারে ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড বা ডেনমার্কের থাকা নিয়ে আমাদের হীনমন্যতা অনুভবের বিশেষ কোনও কারণ নেই৷

আমরা বরং আনন্দিত হতে পারি এই ভেবে যে, আমাদের পরেও অনেক দেশের নাম আছে। বিশেষ করে এ তালিকায় আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ১৩৩তম এবং শ্রীলঙ্কা ১১৬তম। তবে আমাদের আফসোস শুধু একটাই, তালিকায় পাকিস্তান আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে! বৈশ্বিক এই র‌্যাংকিংয়ে দেশটির অবস্থান ৭৫তম।
পাকিস্তানের মত দেশ বাংলাদেশের উপরে স্থান পাওয়ার যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া শক্ত, কারণ এই দেশটিতে জননিরাপত্তা বলে কিছু নেই। জঙ্গি হামলায় অকাতরে বলি হওয়া যে দেশের নিয়মিত দৃশ্য সেই পাকিস্তান নামক দেশটির বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের উপরে স্থান পাওয়াটা কিছুটা বিস্ময়ের জন্ম দেয় বৈকি!
এতদত্ত্বেও একটি সমীচীন প্রশ্ন উঠতে পারে৷ সুখ বা আনন্দ জাতীয় আয় বা মুদ্রাস্ফীতির হারের মতো কোনও নৈর্ব্যক্তিক মানদণ্ড নয়৷ অতএব এ ধরনের ব্যক্তিনির্ভর অনুভূতির আঙ্কিক পরিমাপ কি আদৌ সম্ভব? এ ক্ষেত্রে পরিমাপটি কিন্তু আপেক্ষিক৷

অর্থাৎ বাংলাদেশের সুখের মোট পরিমাণ কত সেটি এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়৷ সমস্যা হল, সুখের যদি একটি মাপকাঠি তৈরি করা যায়, সেই মাপকাঠিতে বাংলাদেশের স্থান প্রায় সবার পিছে, সবার নীচে এবং আক্ষরিক অর্থেই সবহারাদের মাঝে৷ অতএব, পরিমাপটি যেহেতু তুলনাত্মক, অতএব নিতান্তই অযৌক্তিক নয়৷ অতঃপর প্রশ্ন উঠতে পারে মাপকাঠিটির যাথার্থ্য নিয়ে৷ মাপকাঠিটি নির্মাণে যেমন অর্থনৈতিক উন্নতির সূচকগুলি বিবেচনা করা হয়েছে, তার সঙ্গে স্থান পেয়েছে এমন কিছু সূচক যা সামাজিক সৌহার্দ্য ও আস্থাকে সূচিত করে৷ যথা সততা, উপচিকীর্ষা বা পারস্পরিক সহযোগিতা।

এ ধরনের সূচকের পরিমাপ কঠিন হলেও নিতান্ত অসম্ভব নয়৷ অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্বের আধুনিক গবেষণাতেই সেটি প্রমাণিত হয়েছে৷ অতএব অর্থনীতি ও না-অর্থনীতির যুগল সম্মিলনে যে চিত্রটি পরিস্ফুট হয়েছে, সেটি বাংলাদেশের পক্ষে গৌরবজনক না হলেও সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত নয়৷ বিশ্বের মানব উন্নয়ন সূচকের দিকে চোখ রাখলেই প্রত্যাশার কারণটি বোঝা যায়৷

২০১৭ সালের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রেও জগৎসভায় পেছনের সারিতে, ১৫৫টি দেশের মধ্যে ১১০তম স্থানে৷ মানব উন্নয়নের সঙ্গে জীবনযাত্রার মানের একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক থাকাই স্বাভাবিক৷ জীবনযাত্রার মান বাড়লে যে সুখের মাত্রা বাড়ে, সেটিও মোটের উপর সর্বজনমান্য৷ কাজেই সুখের নিরিখে বাংলাদেশের হতমান পরিস্থিতিও দুর্বোধ্য নয়৷

এক রসিক ভদ্রলোক বলেছিলেন, নিজের ভায়রার চেয়ে যার রোজগার একশোটা টাকা বেশি, সে-ই সুখী! ইয়ার্কির অংশটুকু বাদ দিলে একটা কাজের কথা পড়ে থাকে, আমরা সুখী কি না, সেটা বোঝার একমাত্র পথ তুলনা। হয় চারপাশের লোকদের সঙ্গে তুলনা, অথবা নিজের অতীতের সঙ্গে তুলনা। এ যে সুখের দাঁড়িপাল্লা। উল্টো দিকে অন্য কাউকে না রাখলে সুখের পরিমাণ বোঝার উপায় নেই।

১৯৯৭ সালে ম্যাকন এরিকসন নামের একটি বিজ্ঞাপন সংস্থা মাস্টার কার্ডের জন্য একটা বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল। ‘দেয়ার ইজ সামথিং দ্যাট মানি ক্যানট বাই; ফর এভরিথিং এলস, দেয়ার ইজ মাস্টার কার্ড’। সুখী হওয়ার রেসিপি এমন এক লাইনে আর কোথাও পাওয়া দুষ্কর। বেশির ভাগ সুখই আমরা কিনি। কিন্তু, কোন জিনিসটা কিনলে সুখ, তা কে বলে দেবে?

শ্রীলংকায় সদ্যসমাপ্ত ত্রিদেশীয় টি-টুয়েন্টি নিদাহাস ট্রফিতে যখন মাহমুদুল্লাহ ছয় মেরে বাংলাদেশকে ফাইনালে তোলেন, সেই ছক্কাটি বাংলাদেশের মানুষের জন্য ছিল ‘সুখ’; আর শ্রীলংকার মানুষের জন্য ছিল বেদনা জর্জর ‘দুঃখ’! পক্ষান্তরে ফাইনালের দিন শেষ বলে ছয় মেরে দীনেশ কার্তিক যখন ভারতকে জিতিয়ে দেন, তখন সেই ছক্কাটি ভারতবাসীর জন্য নিদারুণ ‘সুখ’; বাংলাদেশের জন্য তা হয়ে দাঁড়ায় ভীষণ এক ‘স্বপ্ন-ভঙ্গের বেদনা’! ক্রিকেট খেলার একটি ছক্কাও হতে পারে একটি দেশের সুখ বা সুখ-ভঙ্গের কারণ! যদিও তা ক্ষণিকের, তবুও সুখ বা দুঃখ বয়ে আনতে পারে!

আসল কথা হলো, সুখ সুখ করে কেঁদে, বিলাপ করে কোনো লাভ নেই। সুখ একটা মানসিক অনুভূতি। নিজেকে সুখী মনে করলেই সুখ, না হলে সকলই গরল! তবে কেন জানি সুখ আমাদের কাছে ধরা দেয় না, আসি আসি করেও আসে না! যদিওবা আসে, বেশিক্ষণ থাকে না!

কাজেই, সুখ কিংবা সুখী দেশের বিশ্ব র‌্যাংকিং নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আসুন, আমরা সমবেত কণ্ঠে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা গান গাই: ‘সুখের কথা বোলো না আর, বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি/দুঃখে আছি, আছি ভালো, দুঃখেই আমি ভালো থাকি….!’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)