দেশের ক্রীড়াঙ্গন আচ্ছন্ন সংবর্ধনা হুজুগে। বাংলাদেশের দুই সোনার মেয়ে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত ও মাহফুজা খাতুন শিলাকে সম্মান জানাচ্ছে পুরোদেশ। সাধারণ পরিবারের অসাধারণ দুই লড়াকু কন্যার ‘স্বর্ণ-অভিযান’ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশের হাজারো কন্যার প্রেরণা।
ক্রীড়া সমঝদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দুই সোনার মেয়ের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছেন তখন আশা করাই যায় সীমান্ত-শিলা এশিয়ান গেমস কিংবা অলিম্পিকে পদক জয়ের সংগ্রামে মাথার উপর পাচ্ছেন এক মহীরুহের ছায়া। তবে আলোচ্য সেটা নয়। সীমান্ত-শিলার সংবর্ধনা কিংবা বন্দনার মিছিল বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন ও ফেডারেশন কর্তাদের জন্য বিশাল স্বস্তি।
হুজুগে বাঙ্গালির নতুন হুজুগে আপাততঃ মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছেন দেশের ক্রীড়া সংগঠকরা। সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, বঙ্গবন্ধু কাপ এরপর এসএ গেমস, তিন উপমহাদেশীয় ক্রীড়া আসরে বাংলাদেশের যা পারফরম্যান্স তাতে ব্যর্থতার কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হতো তাদের। ভারতের গুয়াহাটি ও শিলং’এ শেষ হওয়া এসএ গেমসের পদক তালিকা বলে দিচ্ছে খেলাধুলায় আসলে কোন অবস্থানে বাংলাদেশ।
বিশ্ব-মানচিত্রে অনগ্রসর সাউথ এশিয়া অঞ্চলে অর্থনৈতিক বা জীবনমান সূচকে লাল-সবুজ যতোই বিশাল ভারতের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হোক, খেলার মাঠে একমাত্র ক্রিকেট ছাড়া তার প্রতিফলন একেবারেই নেই। শুধু ভারত কেনো, শ্রীলংকা, সন্ত্রাসে বিধ্বস্ত আফগানিস্তান-পাকিস্তান, ক্ষুদ্র দুই রাষ্ট্র মালদ্বীপ ও নেপালও কোনো কোনো খেলায় আমাদের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। অথচ একমাত্র ভারত বাদ দিলে এই উপমহাদেশের অন্যান্য দেশগুলোর ক্রীড়াখাতের বাজেট বাংলাদেশের ক্রীড়াখাতের বাজেট বরাদ্দের চেয়ে কোনভাবেই বেশী নয়।
লোকসংখ্যা, অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা কিংবা স্পন্সরশিপ সবকিছুতে নেপাল, শ্রীলংকা, মালদ্বীপের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। পদক তালিকায় তার প্রতিফলন কোথায়? ২০১০’এ ঢাকায় একাদশ এসএ গেমসের আসরে ভারত ৯০ স্বর্ণসহ ১৭৫ পদক পেয়ে শীর্ষস্থানে। বাংলাদেশ ১৮ স্বর্ণসহ ৯৭ পদক পেয়ে তৃতীয়। ১৬ স্বর্ণসহ ১০৫ পদক পেয়ে চতুর্থ স্থানে ছিলো শ্রীলংকা।
ছয় বছর পর সেই একই গেমসে ভারতের প্রাপ্তি ১৮৮ স্বর্ণসহ ৩০৮ পদক। চতুর্থ থেকে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা শ্রীলংকার থলেতে ২৫ স্বর্ণসহ পদক সংখ্যা ১৮৬। ছয় বছরে নয় সোনা সহ মোট ৭৯টি পদক বাড়িয়েছে শ্রীলংকা। আর ছয় বছর পর বাংলাদেশ তৃতীয় থেকে দুই ধাপ নেমে পঞ্চম স্থানে।
২০১০ এ জয় করা ১৮ স্বর্ণ পদকের বিপরীতে এবারের অর্জন চার সোনা। সেবার বাংলাদেশের অর্জিত মোট পদক সংখ্যা ৯৭, এবার ৭৫। কোনো সূচকেই কি খেলাধুলায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ! কর্মকর্তারা যুক্তি দেখাতে পারেন এবার ছিলো না কারাতে, ক্রিকেট কিংবা গলফের মতো খেলা যা গত আসরে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছিলো কয়েকটি স্বর্ণ ।
তবে সেই যুক্তি ধোপে টেকে না। তুলনামূলক বিশ্লেষণে পরিস্কার হবে এবারের আসরে কতটা অনুজ্জল লাল-সবুজ। ২০১০ আসরে উশু ইভেন্টে নয় স্বর্ণের মধ্যে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিলো দুই, এবার সেই ইভেন্টে বাংলাদেশের অর্জন মাত্র একটি ব্রোঞ্জ।
তায়াকোয়ান্দোতে সেবার দুই স্বর্ণ জয়ী বাংলাদেশ এবার থেমেছে তিন ব্রোঞ্জ পদকে। বক্সিংয়ে ২০১০’এ ভারতের প্রাপ্তি তিন স্বর্ণ, বাংলাদেশের দুই। ছয় বছর পর সেই একই ইভেন্টে বাংলাদেশের সাকুল্যে প্রাপ্তি চার ব্রোঞ্জ। এবার ভারতের প্রাপ্তি শুনুন: বক্সিং দশ ক্যাটাগরির সবকটিতেই সোনার পদক জিতেছে ভারতীয়রা। এরপরও কি বলা যায় বাংলাদেশ খেলাধুলায় এগোচ্ছে!
২০১০’র তুলনায় দুটি ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অগ্রগতি দৃশ্যমান। সেবারের এসএ গেমসে সাঁতারপুল থেকে সোনার পদক বঞ্চিত ছিলো বাংলাদেশ। ছয় বছর পর মাহফুজার সৌজন্যে নদীর দেশ বাংলাদেশের প্রাপ্তি দুই সোনার পদক। ২০১০ এ পুরুষদের ভারোত্তোলনে জেতা স্বর্ণ এবার হারিয়েছেন হামিদুল। আর প্রথমবারের মতো মেয়েদের ভারোত্তোলন যোগ হওয়ায় মাবিয়া এনে দিয়েছেন সোনার পদক।
শ্যুটিংয়ে এয়ার পিস্তলে স্বর্ণ এনেছেন শাকিল। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলের সবসময়ের ফেভারিট বাংলাদেশ এবার হারিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের সেই মর্যাদা। পরিসংখ্যানের আরো একটি দিকেও প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় পিছিয়ে বাংলাদেশ। এসএ গেমসের এবারের আসরে ৫১৯ জন ক্রীড়াবিদ নিয়ে ভারতের অর্জন ১৮৮সহ ৩০৮ পদক। ৪৮৪ জন প্রতিযোগী নিয়ে শ্রীলংকার প্রাপ্তি ২৫ স্বর্ণ সহ ১৮৬ পদক।
অন্যদিকে, ২২ ইভেন্টে ৪০৯ জন প্রতিযোগীকে নামিয়ে বাংলাদেশের অর্জন ৪ স্বর্ণসহ ৭৫ পদক। ক্রিকেটের ক্রমাগত উন্নতি অন্যান্য খেলার ব্যর্থতা ভুলিয়ে দেবে, এমনটা ভাবলে ভুল করবেন আমাদের ক্রীড়া নীতিনির্ধারকরা। মাল্টি স্পোর্টস ইভেন্ট, আঞ্চলিক কিংবা মহাদেশীয় গেমসে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া প্রমাণ করছে ক্রীড়াক্ষেত্রে দেউলিয়াত্বের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।
এরকম লাগাতার ব্যর্থতার পর বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, বিভিন্ন ফেডারেশন এমনকি বিকেএসপির মতো প্রতিষ্ঠানের টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা পড়েছে প্রশ্নের মুখে। ফি’বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করা বিকেএসপি বিশ্বমানের না হোক এশীয়মানের এক বা দু’জন অ্যাথেলেট কি বাংলাদেশকে উপহার দিতে পেরেছে? বছর জুড়ে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের জন্যই কি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন! গণতান্ত্রিক সমাজে এমন প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার সময় এসেছে।