সিনেমা হল বন্ধ: স্টাফদের কেউ দিয়েছেন ভাতের হোটেল, কেউ হয়েছেন বাবুর্চি
সিনেমা হলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, পেশা বদল করছেন স্টাফরা...
নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরের ‘তামান্না সিনেমা হল’-এ ২০১৪ সাল থেকে চাকরি করেন আবদুর রহমান। প্রায় চার বছর সেখানে কাজ করার পর নারায়ণগঞ্জের গুলশান ও নিউমেট্রো দুটি হলেই চাকরি করেন বছর দুইয়েকের মতো। তারপর রংপুরে শাপলা সিনেমা হলে শো অপারেটর হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারির শেষদিক থেকে আড়াই মাস ধরে চাকরি করছিলেন। সবমিলিয়ে ৬ বছর ধরে এ পেশায় আছেন আবদুর রহমান। এরমধ্যেই শুরু হয় করোনার প্রকোপ। থেমে যায় আবদুর রহমানের কর্মজীবন।
সিনেমা হল বন্ধ হওয়ায় আবদুর রহমান হয়ে পড়েছেন পুরোপুরি বেকার একজন মানুষ। করোনায় কয়েকমাসে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে, হাত পুরোপুরি খালি। উপায় না পেয়ে নিজেকে অন্য পেশায় নিয়োজিত করেন তিনি। সিনেমা হলের স্টাফের পেশা পাল্টিয়ে রহমান এখন ভাতের হোটেল দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন রংপুরের হাজিরহাট বাজারে।
করোনায় বন্ধ থাকা দেশের সিনেমা হলগুলোতে চ্যানেল আই অনলাইন থেকে খোঁজ নিলে জানা যায়, আবদুর রহমানের মতো এমন শতশত স্টাফ জীবিকার তাগিদে পেশা বদল করছেন। রংপুর, সাতক্ষীরা, যশোর, ঢাকার কয়েকটি সিনেমা হলের কর্তাব্যক্তি ও স্টাফদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে এমনটাই জানা গেছে।
আবদুর রহমান বলেন, শাপলা সিনেমা হলে মোট ৭ জন ছিল। এরমধ্যে তিনজন বয়োজ্যেষ্ঠ। তারা অন্যকোনো পেশায় যেতে পারছে না, কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। আমিও কষ্টে ছিলাম। সিনেমা হলে ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন এখনো পাইনি। ৯ হাজার টাকা বেতনে শাপলা সিনেমা হলে চাকরি করতাম। এরমধ্যে খাওয়াদাওয়া নিজের। এখনকার সময়ে এই টাকায় কিছু হয়?
তিনি বলেন, ধার দেনা করে সাত লাখ টাকা খরচ করে গত রোজার ঈদের দুদিন পর থেকে খাবারের হোটেল চালু করেছি। সিনেমা হলের বেতনের চেয়ে মোটামুটি ভালো আছি। এই ব্যবসাটাই ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সিনেমা হল কবে খুলবে বা আদৌ খুলবে কিনা ঠিক নেই। তাই করোনা গেলেও আর সিনেমা হলে কাজ করবো না।
সাতক্ষীরার সংগীতা সিনেমা হলে গত ২৫ বছর ধরে স্টাফ হিসেবে কাজ করছেন আবদুল হক। বিগত ১০ বছর তিনি এ হলের ম্যানেজারের দায়িত্বে আছেন। তিনিও শোনালেন হতাশার কথা।
আবদুল হক জানালেন, তিনি নিজেই চিংড়ির রেণু পোণার নার্সারি করছেন। বলেন, সিনেমা মন্দা কয়েক বছর ধরে। করোনা এসে একেবারে সিনেমা ব্যবসার কোমর ভেঙে দিয়েছে। তাই করোনা গেলেও সংগীতা সিনেমা হল আদৌ চালু হবে কিনা সেটি নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন।
আলাপ করে জানা যায়, সংগীতা সিনেমা হলে স্টাফ ছিল ৬ জন। কেউ মুদি দোকানে, কেউ ইজিবাইক চালক (অটো), কেউ বা মৌসুমি ফলের ব্যবসা শুরু করেছেন। আবার একজন বাবুর্চির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
ঢাকার আনন্দ-ছন্দ দুই সিনেমা হলের তত্ত্বাবধায়ক শামসুদ্দিন মোহম্মদ বলেন, সবমিলিয়ে স্টাফ আছে ৪০ জনের মতো। কিন্তু হল বন্ধ থাকায় আয় না হওয়ায় কেউই বেতন পাচ্ছেন না। অধিংকাশ স্টাফের শিক্ষাগত যোগ্যতা সীমিত। তাই তারা এ অবস্থায় ভালো চাকরিও পাচ্ছেন না। রোজার সময় বেশিরভাগই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ফিরে অন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন।
তবে সিনেমা হল খুললে পুনরায় তারা আনন্দ-ছন্দ সিনেমা হলে চাকরির সুযোগ পাবেন বলে জানান শামসুদ্দিন মোহাম্মদ। বলেন, সরকার সবকিছুই চালু করেছেন। বন্ধ রয়েছে শুধু সিনেমা হল। সরকার অনুমতি দিলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা সিনেমা হল চালু করতে প্রস্তুত আছি।
দেশের সিনেমা হল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিখ্যাত মধুমিতা সিনেমা হলের কর্ণধার ইফতেখার আহমেদ নওশাদ জানান, তার হলে ৪০ জনের মতো স্টাফ ছিল। ঝাড়ুদার বাদে সবাইকে ছুটিতে পাঠিয়েছেন। কারণ, হল বন্ধ থাকায় বেতন দিতে পারছেন না। তারা নিজেদের মতো করে অন্যপেশায় যোগ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, দেশের সব সিনেমা হল মালিকদের অবস্থা খুবই নাজুক। স্টাফদের বেতন দিতে পারছে না কেউই। ওদিকে সহসা সিনেমা হল খোলার কোনো সম্ভবনা দেখছি না। ঢাকার বাইরে হলগুলোর অবস্থা আরও করুণ। বেশিরভাগ হলই আর খুলবে কিনা সন্দেহ। কারণ, ছবি ব্যবসা করেনা। যে মানের ছবি দরকার হয় তা প্রোভাইড করা সম্ভব হয়না।