আমাদের অনেক বাংলাদেশিরই যাপিত জীবন যাপনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকে প্রিয় গান-কবিতা, কবি-লেখক-শিল্পী এবং তাদের কাজ। অনেক শিল্পী’র সাথেই আমাদের অন্য রকম একটা মেলবন্ধন হয়ে যায় নিজেদের অজান্তেই। জীবনের অনেক বৈরী সময়েও আমাদের মনের একটু খোঁড়াক হয়ে দাঁড়ায় এসবই। তবে আমরা যারা প্রবাস জীবন যাপন করছি, তারা জানি কখনও কখনও এই বন্ধন কতটা হৃদয় গভীরে গাঁথা।
প্রবাসের অনেক অবসরে, লম্বা কোন ড্রাইভে আমরা যাদের গান শুনি, এই সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রিয় দু’জন মূলতঃ আধুনিক গানের শিল্পী ফাহমিদা নবী এবং বাপ্পা মজুমদার ১৪ আগস্ট, রোববার সিডনীতে থাকা তাদের অনেক ভক্ত শ্রোতাদের মোহিত করে দুর্দান্ত একটা সন্ধ্যা উপহার দিয়ে গেলেন।
আয়োজক বাংলাদেশি আইডল সিডনী’র শিল্পী দম্পতি আতিক হেলাল এবং আরফিনা মিতা’র আন্তরিক প্রচেষ্টায়, জনপ্রিয় এই দুই শিল্পীকে এক সাথে পাওয়া ছিল সিডনীতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের জন্যে অনেক কাঙ্ক্ষিত একটা ক্ষণ। এই প্রসঙ্গে আয়োজক আতিক হেলাল বলেন, উনাকে এই একটি দিন এর জন্যে ৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।
অনুষ্ঠান শুরুতেই অনেকের অসম্ভব প্রিয় বাংলাদেশে এই মুহূর্তে গান করছেন, গান নিয়ে ভাবছেন, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা গান’কে জনপ্রিয় করার জন্যে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বাপ্পা মজুমদার তিনি আসেন মঞ্চে। নিজের পছন্দের, তার ব্যান্ড দলছুট এর সাথে করা, সর্বশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এরকম একের পর এক প্রিয় প্রিয় গান গেয়ে যান বাপ্পা, উপস্থিত দর্শকশ্রোতাদের একের পর এক আবদার এবং তাদের গলা মেলানোতেই বুঝা যাচ্ছিল একজন বাপ্পা যাদের প্রিয় তাদের কতখানি প্রিয়।
উনি যে গানটিই ধরেন, সাথে সাথে দর্শক উল্লাসই বলে দেয় প্রতিটা গানের লিরিক্সই প্রায় সবার জানা। চোখেরই জলে, ফিরে এসো বা তুমি আমার বায়ান্ন তারা একটু চেনা বা অচেনা, শুরুটাই শুধু বাপ্পা ধরেন, বাকিটা দর্শকরাই গেয়ে যান অবলীলায়। বায়োস্কোপের নেশা আমায় ছাড়ে না, যেন দর্শক শ্রোতাদের উড়িয়ে নিয়ে যায় সেই অন্য এক “বায়োস্কোপ ভুবনেই” সেই ভাবনায় যেন সব দর্শকদের বয়সই যায় কমে।
বাপ্পা যখন শেষ করেন সেই ভাবনায় বয়েস আমার বাড়ে না, ঠিক তখন আয়োজক মিতা আপা মাইক্রোফোন হাতে মঞ্চে উঠেন রাতের খাবার বিরতির ঘোষণা নিয়ে তার আগে বলে উঠেন, কি কারণে যেন আমাদের বাপ্পা’র ও বয়েস বাড়ছে না।
বাপ্পা মঞ্চ থেকে নামার আগে ছোট্ট করে বলেন আমি আসলে অল্প অল্প ফরমালিন খাই, তার এই মজার কথার রেশ ধরেই ৩০ মিনিটের বিরতি শেষ করে মঞ্চ আলো করে উঠে আসেন আরেক প্রিয় এবং জনপ্রিয় শিল্পী ফাহমিদা নবী।
উনার গান শুরু করার আগেই ছোট করে সময় নেয়া হয় অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দাতাদের জন্য। তাদের পক্ষ থেকে ক্রেষ্ট প্রদান এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন শেষ করেই ফাহমিদা তার কণ্ঠের জাদুতে আবেশিত করে তুলেন পুরো অডিটোরিয়াম।
এই অনুষ্ঠানে আগত দর্শকদের প্রায় সবাই যে এই দুই শিল্পীকে ভালোবেসেই অনুষ্ঠানটি উপভোগ করতে এসেছেন তা বুঝা যায় তার গানেও দর্শক শ্রোতাদের গলা মেলানো শুনে। ফাহমিদা গানের পাশাপাশি ছোট ছোট কথার মায়াতেও মোহিত করেন সবাইকে।
দর্শকদের প্রায় সকল অনুরোধ আন্তরিকতার সাথে নেন। উনি যখন উনার বাবা প্রয়াত মাহমুদ্দুন্নবী স্মরণে গান ধরেন, গানের শুরুতেই দর্শক শ্রোতা থেকে ভীষণ ভালোবাসাময় আবেগে সেই গানের সাথে একটু গলা মেলাতে পারবেন এমন একজন দম্পতিকে আহ্বান করেন মঞ্চে।
প্রবীণ এক দম্পতির কণ্ঠ অভিনয় সবাইকে একটা অন্য রকম আবহে নিয়ে যায় যেন। গান শেষে ফাহমিদা ভীষণ আপ্লুত হয়ে বলেন এই প্রবীণ দম্পতি গানের মাঝে অনেক প্রেমের অভিনয় করতে যেয়েও চোখ ভিজিয়েছেন এটি তার মনকেও ভিজিয়ে দিয়ে গেছে।
ওপার বাংলার একটি গানের অনুরোধ এলে বিনয়ের সাথে বলেন, আজ কেন নয় শুধু বাংলাদেশেরই গান হয়ে যাক। এত এত গান আমাদের, সেই গান গাই আপনাদের অনুমতি পেলে। দর্শকদের সরব সমর্থন নিয়ে জনপ্রিয় গান শুনাতে থাকেন বিরতি ছাড়াই। তুমি যে আমার কবিতা গানটি ধরার আগে উনি মঞ্চ থেকে একজন পুরুষ কণ্ঠ কে তুলে নিয়ে আসেন। আনিস নামের যে ভদ্রলোক ফাহমিদা নবী’র সাথে কণ্ঠ মেলাতে উঠেন উনার কণ্ঠও বেশ সুন্দর।
সবার প্রিয় রোমান্টিক এই গানটি যেন নতুন এক জুটির কণ্ঠে অন্য এক মাত্রা পায়। ফাহমিদা নবী মানেই পুরো দর্শকদের সাথে ভীষণই এক নিবিড় যোগাযোগ, যেখানে একদম ক্ষুদে দর্শকরাও তার সাথে মেতে উঠতে পারে ছোট একটা ক্ষণ ভীষণই আমোদে। ফাহমিদা নবী তার একক পর্বটি শেষ করেন “লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প দিয়ে” যার সাথে মঞ্চে উঠে আসে অডিটোরিয়ামের থাকা প্রায় সব ক্ষুদে শ্রোতা-দর্শক, আর “এই দিনই যেন প্রেমময়” গানটির সাথে বাচ্চাদের তাল-বেতাল নাচের আনন্দ দর্শক মনকে নির্মল এক আনন্দ দিয়ে যায়।
আরো কিছু গান শেষে আবারও মঞ্চে উঠে আসেন বাপ্পা এবং শুরু হয় ফাহমিদা এবং বাপ্পার জনপ্রিয় সব গানের আবেদন নিবেদন। নিরাশ করেননি তাঁরা, অসংখ্য জনপ্রিয় গানের বেশ কিছুই গেয়ে শোনান তারা। এরপর সময় স্বল্পতার জন্য, অনেক গানের পুরোটা না গাইতে পারলেও, একটি বা দুটি অন্তরা দিয়ে হলেও দর্শকদের মন ভরিয়ে দেন। দুজনের কণ্ঠেই রবীন্দ্র সংগীতের অনেক বেশি অনুরোধে শেষমেশ “আমারও পরানও যাহা চায়” গাইতেই হয়।
উনারা বেশ ক’বার ঘোষণা দিয়ে শেষ গান পরিবেশন করলেও, এত প্রিয় দু’জন শিল্পীকে কাছে পেয়ে কারই বা মন ভরে! তবে ঘড়ির কাঁটা যখন বলে শুভ রাত্রি বলতেই হবে এবার, উনারাও দর্শকদের কৃতজ্ঞতা, ভালোবাসা এবং ধন্যবাদ জানিয়ে, সবাইকে অনুরোধ করেন শেষ গানটিতে সবাই যেন দাঁড়িয়ে উনাদের সাথে গলা মেলান, “ধন ধান্য পুষ্প ভরা, আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক, সকল দেশের সেরা, ও সেই স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা”।
বাংলাদেশের এই দুই শিল্পীই যেন তখন আমাদের কাছে এক টুকরো বাংলাদেশ, এত আপন এত ভালোবাসার মনে হয় কাছের মানুষ মনে হয় এই শিল্পীদ্বয়কে, দর্শক সারিতে দাঁড়িয়ে অনেক দিন পর দেশের একটি গান গেয়ে গলা ফাটিয়ে হৃদয়কে নতুন করে স্পর্শ করে, চোখ ভিজে যাওয়ার অনুভূতি ভুলেই গিয়েছিলাম যেন, কান্নার জল যেন প্রায় সবাইকে মনে করিয়ে দেয় আরো একবার কি ভীষণ এক টান, নিজ মাতৃভূমির টান।
দু’জনের গান উপভোগের পাশাপাশি বেশীর ভাগ দর্শকদেরই যেটা মুগ্ধ করেছে সেটা হচ্ছে একজন শিল্পী আরেক জন শিল্পী কে ঘিরে যে শ্রদ্ধা এবং বিনয়। ভালো গান হয়তো আরো অনেকেই করেন, কিন্তু নতুন অনেক শিল্পীর কাছেই দৃষ্টান্ত হতে পারেন একজন ফাহমিদা নবী এবং একজন বাপ্পা মজুমদার।
গানের মাঝেই অসম্ভব জনপ্রিয় শিল্পী বাপ্পা মজুমদার অষ্ট্রেলিয়ার বাংলাদেশি কমিউনিটিকে কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি উদাত্ত আহবান জানান, ভালো বাংলা গান শুনতে এবং যে সব শিল্পী বাংলা গানকে ভালোবেসে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন, তাদেরকে যতটা সম্ভব পৃষ্ঠপোষকতা দিতে সাহায্যের হাত এভাবেই বাড়িয়ে দিতে বারবার।
বিশিষ্ট শিল্পী পরিবারে জন্ম নেয়া প্রখ্যাত শিল্পী ফাহমিদা নবী তার গানের মাঝেও অষ্ট্রেলিয়া থাকা সকল ভক্ত শ্রোতাদের কাছে অনুরোধ করেন এই মুহূর্তে ভীষণই অসুস্থ বাংলাদেশের প্রোথিতযশা গীতিকার সুরকার লাকী আখন্দের জন্যে সবার শুভ কামনা রাখবার। উনার স্মরণে “আমায় ডেকোনা” গানটিও নিবেদন করেন।
এই অনুষ্ঠানের আয়োজক একজন আতিক হেলাল এবং মিতা দম্পতি যে অনেক ভালো গান করেন এটা বোধহয় সিডনী থাকা অনেক বাংলাদেশির জানাই আছে, তবে সিডনীর বাইরে থাকা এই প্রতিবেদকের মত যারা অন্য শহর থেকে এসেছেন তাদের জন্যে আতিক হেলালের কণ্ঠে গান এবং ফাহমিদা নবী’র সাথে তার বন্ধু মিতা’র যুগল পরিবেশনা বাড়তি পাওয়া।
দু’জনের কণ্ঠই বেশ সুন্দর এবং এই রকম কণ্ঠের অধিকারী দুইজন শিল্পীই যে এভাবে অন্য গুণী শিল্পীদের কদর করবেন হৃদয় খুলে এটা স্বাভাবিক চাওয়া এবং তাদের কাছে এইরকম আরো আয়োজনের আশা বা প্রত্যাশা দুটোই বাড়িয়ে দিয়েছে।
proshantika.com.au এর সৌজন্যে প্রকাশিত।