চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সালমা খাতুনের ‘উর্দু বিতর্ক’

একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সফরে গেলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে। তিনি করাচিতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললেন, “মেরা মাদেরি জবান উর্দু নেহি হে। মাগার হাম উর্দু মে বয়ান করনেকে লিয়ে কৌশিশ করে গা। মশরিকি পাকিস্তানসে যো লিডার মাগরিবি পাকিস্তানমে যাতিথি উন লুগনে বাংলা মে বয়ান করনে কে লিয়ে কাভি কৌশিশ নেহি কিয়া। মাগার হাম ইয়ে মজলিস মে উর্দুমে বয়ান করে গা। হাম উর্দু আচ্ছা নেহি জানতা হে মাগার হাম টুটাফাটা মে চালালেগা।”

চরম হাততালি, হাসির খোরাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু তার শ্রোতাদের। তিনি কিন্তু ভাষা সংগ্রামী ছিলেন। জেল খেটেছেন। আজ এতোদিন পরে এসে দেখছি উর্দুতে কথা বলা একটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে যাচ্ছে। পত্রিকা, সোস্যাল মিডিয়ায় খবরে তোলপাড় হচ্ছে পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট অধিনায়ক সালমা খাতুনের উর্দু কথা বলা নিয়ে। পাকিস্তানে উর্দুতে কথা বলে তিনি নাকি ‘শৃংখলা ভঙ্গ’ করেছেন তাই শাস্তির মুখে পড়বেন।

যে সংবাদ সম্মেলনে তার উর্দু কথা বলা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে আমি তার আগাগোড়া অনলাইনে দেখলাম। যদি সেটার-ই রেফারেন্স দেওয়া হয় তাতে সালমার বিন্দুমাত্র অপরাধ আমি দেখি না। কারণ সেখানে একটা লাইন ছিল উর্দুতে। বাকি সব কথা তিনি বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে বলেছেন। প্রথম ওয়ানডের আগে এই সংবাদ সম্মেলনে সালমা এটাও জানান যে তিনি উর্দুতে হোস্টদের সঙ্গে কথা বার্তা বলছেন, তারা অনেক আনন্দ করছেন। হোস্টরা যে আয়োজন তাদের জন্য করেছেন তাতে তারা খুবই সন্তুষ্ট। সালমার কথা পুরোটা আরও কিছু বাড়িয়ে ইংরেজিতে সুন্দর অনুবাদ করে দিয়েছেন দলের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ প্রমীলা ক্রিকেট দলের ম্যানেজার শফিকুল হক হীরা। সালমার কথার রেফারেন্স দিয়ে তিনি তাদেরকে ভিভিআইপি সিকিউরিটি দেওয়ার কথাটাও বললেন এবং অন্যদের জন্যও পাকিস্তান সফর নিরাপদ বলে জানালেন।

খবরে দেখলাম, এই ঘটনার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকে টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। পাকিস্তান সফররত বাংলাদেশ টিম ম্যানেজার এ প্রসঙ্গে দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন পত্রিকাকে বলেন, ‘এখানে যে কারও সঙ্গে আলাপচারিতা কিংবা সাক্ষাৎকারের সময় আমাদেরকে বাংলা অথবা ইংরেজিতে কথা বলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাকে বোর্ডের তরফ থেকে বলা হয়েছে খেলোয়াড়দের কথা ইংরেজিতে তরজমা করে দিতে।’

বিসিবির এক কর্মকর্তা আবার পাকিস্তানি পত্রিকাকে খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ক্রিকেট বোর্ডকে নির্দেশ দিয়েছে যে, খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা যেন ভারত সফরে হিন্দি এবং পাকিস্তান সফরে উর্দুতে কথা না বলেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিসিবির মিডিয়া ম্যানেজার জালাল ইউনুস হিন্দি ও উর্দুতে কথা বলতে নিষেধাজ্ঞা জারির কথা স্বীকার করেন বাংলাদেশী মিডিয়ার কাছে। বিসিবির এই পরিচালক বলেন, ‘বাংলাদেশ দল দেশে ফিরে আসার পর ম্যানেজারের রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেব।’

বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দলটি পাকিস্তান যাওয়ার আগেই নানা শোরগোল উঠে। যেন পাকিস্তান এমন এক দেশ সেখানে মানুষ বাস করছে না। রাস্তায় রাস্তায় মেশিনগান নিয়ে বসে আছে লোকজন একে অন্যকে হত্যা করার জন্য। অবশ্য এটাও সত্য যে জিম্বাবুয়ে ছাড়া কোনও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট দল পাকিস্তান সফর করছে না সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও সেখানে সফর বাতিল করেছে। সাকিবরা না গেলে সালমারা কেন যাবে- এটা একটা সেন্টিমেন্ট ছিল। সেন্টিমেন্ট-এর পক্ষে যুক্তিটাও ফেলনা নয়।

কিন্তু যারা ক্রিকেট কর্তা আছেন তারা আমাদের গোল্ডেন গার্লদের নিয়ে কোনও চিন্তা করছেন না- সব চিন্তা আমাদের, এটা ভাবা একটা হাস্যকর বিষয় ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমতি ছাড়া এই মেয়েদের পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য নাজমুল হাসান পাপনদের সাহস হবে না- এটাও তাদের ভাবার দরকার ছিল, যারা মহিলা ক্রিকেটারদের তাদের পাকিস্তান সফরে বিস্মিত হচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য তাদের মুখে ছাই মেরে ৪ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে এর জবাব দিয়েছেন। নিরাপত্তার বিষয় তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে তাকে প্রশ্ন করা হলে জবাবে পাল্টা প্রশ্ন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেন? খেলতে যাবে না কেন? বাংলাদেশের মহিলা ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর নিয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তার যৌক্তিকতা কি? শেখ হাসিনা বলেন, আপনারা জানেন যে, পাকিস্তান একটা ফিউডাল এবং কনজারভেটিভ সোসাইটি। কাজেই আমাদের মেয়েরা সেখানে খেলতে গিয়েছে, এটা তো সাহসের পরিচয় দিয়েছে। এটা দেখে পাকিস্তানের মেয়েরাও উৎসাহিত হবে।

এবার আসা যাক সালমার উর্দুর কথা প্রসঙ্গে। ভাষা একটি টুলস। যে যেই ভাষায় কথা বলে সে ভাষা বিদেশে নাও চলতে পারে। বিদেশিরা যদি আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলে আমাদের কিন্তু ভালো লাগে। আমিও বিদেশির মুখের ভাষায় কথা বললে তার খুশি হওয়ার কথা। এখানে সালমা তাই করেছেন। উর্দুর স্থলে স্প্যানিশ হলে আমরা কিন্তু এই প্রশ্ন তুলতাম না। বরং সালমার প্রশংসা করতাম।

আমার মনে আছে বিএনপি আমালে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা বিসিবির হয়ে টিম বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তান গিয়ে সেখানকার মিডিয়ায় উর্দুতে কথা বলেছেন। সে সময়ও এটা নিয়ে চরম হৈ চৈ হয়েছে। আমরা উর্দুকে ’৫২ সালে ফিরে গিয়ে দেখছি। এর সঙ্গে আমাদের ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানিদের নির্যাতনকে খুঁজছি। আমরা কখনো বিবেচনা করছি না এটা একজনের ভাষা জানার দক্ষতার প্রকাশ। কমিউনিকেশন টুলস।

একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে আমি সালমাদের উর্দু বলার বিষয়টি ভিন্নভাবেও দেখতে চাই।

সাংবাদিক হিসেবে আমার সংবাদ মাধ্যমের ভাষা যদি বাংলা হয় আমি চাইবো যার ইন্টারভিউ নিচ্ছি তিনি ভিন্ন ভাষী হলেও বাংলা জানলে যেন সেটাই বলেন। তাতে আমার পাঠকরা, আমার দর্শকরা সরাসরি তার মুখের ভাষা, তার ভাবনা জানতে পারছে। এটা আমার মিডিয়াকেও ভিন্ন মাত্রা দিচ্ছে। দুনিয়াভর সে কারণে তারকারা কোনও দেশে গেলে সে দেশের দু’চার লাইন ভাষা তার ভাষণে ঢুকিয়ে দেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা ভারত সফরকালে শাহরুখ খানের সিনেমার হিন্দি ডায়লগ সে কারণে বলেন। ঢাকায় থাকতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাস সে কারণেই বাংলায় কথা বলতেন দু’চার লাইন। আমি নিজে দেখেছি সেটা রোমান হরফে লিখে দেওয়া বাংলা।

সংবাদ কর্মী হিসেবে আমরা এটাও শিখাই যে, যখন আপনি কাউকে ইন্টারভিউ করছেন তাকে অনুরোধ করেন আপনার ভাষায় কথা বলতে। যারা অনেক চালাক তারা দু লাইন স্থানীয় ভাষায় বলে নিজের ভাষায় ফিরে যান, মানে তিনি যে ভাষায় কমফোর্ট ফিল করেন সে ভাষায় চলে যাবেন। বোকা দর্শকরা কিন্তু প্রথম লাইন শুনে বাকিটা শোনার জন্য অপেক্ষা করেন। আত্মিক টান অনুভব করেন। শুরুতে ভিন দেশি ভাষা দেখলে তিনি সেখানে রিমোট টিপে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার কথা ছিল। যাক এসব কমিউনিকেশনের কথা।

সালমা যদি মিডিয়ার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলেন এতে আমি এতে দোষের কিছু দেখি না। তবে অফিসিয়ালি তাকে যদি বলা হয় উর্দুতে কথা না বলার জন্য সেটা তিনি সংবাদ সম্মেলনে অবশ্যই পালন করার কথা। আমি এটা পালনে তাকে ব্যতিক্রম দেখিনি। এমনকি এটাও শুনলাম উর্দুতে করা প্রশ্নটি জবাব দিতে কোন্ ভাষা ব্যবহার করবেন পাশে বসা ম্যানেজারের পরামর্শ নিলেন তিনি এবং বাংলায় বললেন। যারা তিলকে তাল করেন তারাই শুধু খুঁজে পেলেন সালমা উর্দুতে কথা বলেছেন।

সেই সঙ্গে আমি বিসিবিকে বলবো, উর্দু এবং হিন্দিতে কথা না বলার যে সিদ্ধান্ত তারা দিয়েছেন সেটা যথাযথ সিদ্ধান্ত। সংবাদ সম্মেলনে যেন সেটা মানা হয়। খেয়াল রাখাও দরকার। তবে মিডিয়ায় সঙ্গে পার্সনাল ইন্টারভিউর ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হতে পারে না। সেখানে মিডিয়ার অনুরোধটাও দেখা দরকার। সেখানে কমিউনিকেশনকেও প্রাধান্য দেওয়া দরকার। সেখানে সংবাদ সম্মেলনের মতো তরজমা করার লোক পাশে বসে থাকে না। সালমা যদি ইংরেজিতে দক্ষ না হন, কোনও মিডিয়া তার ইংরেজি শুনিয়ে তাকে হাস্যকর হিসেবে উপস্থিত করতে পারে। আবার তার বাংলাও তরজমা করার জন্য বিদেশি টিভি স্টেশনে লোক নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে সালমা যদি উর্দু বলেন লাভটা কার, ক্ষতিটা কি?

আমাদের দেশে পাকিস্তান বিষয়টা অনেক সেনসেটিভ। পাকিস্তানেও বাংলাদেশ ইস্যুটা তাই রয়েছে। আমরা আসলে ভুলে যাই যে দুটি দেশ ৪৫ বছর ধরে স্বাধীন ও পৃথক স্বত্তা নিয়ে আছে। দুটি দেশ দক্ষিণ এশিয়ায় নামে হলেও বন্ধু রাষ্ট্র। দুটিরই অনেক বিষয়ে অন্তমিল আছে, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বন্ধন আছে। এগুলো ঘৃণার সংস্কৃতি দিয়ে পৃথক করা যাবে না। আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে যেমন ভুলবো না তেমনি দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে একে অন্যের ধ্বংস কামনাও করতে পারি না। এর মধ্যে কিভাবে পারস্পরিক সৌহার্দ বিলিয়ে এগিয়ে যাব তার চিন্তা করা উচিত। আমরা আমাদের নতুন প্রজন্মকে যেমন আমাদের ইতিহাস শিক্ষা দিব তেমনি আবার ঘৃণার সংস্কৃতি থেকে তাদের মুক্ত রাখারও শিক্ষা দিতে হবে। ঘৃণা শুধু ঘৃণারই জন্ম দেয়- প্রডাকটিভ কিছু না।

বিশ্বকে দেখেও আমাদের শেখার আছে। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার আগে আমরা ব্রিটিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছি কিন্তু ব্রিটেন আজ শুধু আমাদের নয়, ভারত পাকিস্তানেরও বন্ধু রাষ্ট্র। আমেরিকা মানব বিধ্বংসী বোমা মেরেছিল জাপানে। আজ আমেরিকা জাপানের কোনও শত্রু রাষ্ট্র নয়। ফ্রান্স, আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া আজ জার্মানির শত্রু নয়, মিত্র। তারা কি পুষে রেখেছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শত্রুতা?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)