নব্বইয়ের দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের তুমুল জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহর মৃত্যুর ২৪ বছর পর মৃত্যু রহস্যের জট খুলেছে সর্বশেষ তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই।
তবে সংস্থাটি অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থার মতোই ‘‘আত্মহত্যা জনিত মৃত্যু” উল্লেখ করেছে।
মামলার তদন্তভার গ্রহণের পর যা করল পিবিআই
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, মামলার তদন্তভার গ্রহণের পর পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা ও পুলিশ পরিদর্শক হুমায়ূন কবির মোল্লার সমন্বয়ে একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়।
পিবিআই তদন্তকালে ঘটনার সময় উপস্থিত ও ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ৪৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করে। এছাড়াও ১০ সাক্ষীর সাক্ষ্য ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় লিপিবদ্ধ করা হয় এবং ঘটনা সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করা হয়।
পিবিআইয়ের তদন্তের বিবেচ্য বিষয়
পিবিআই তদন্তকালে প্রথম ও দ্বিতীয় সুরতহাল রিপোর্ট, ভিসারা রিপোর্ট, কেমিক্যাল রিপোর্ট, ময়না তদন্ত রিপোর্ট, বিশেষজ্ঞ মেডিকেল বোর্ড কর্তৃক মতামত, হস্তলিপি বিশারদের মতামত, ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বিল্ডিংয়ে প্রবেশ এবং বাহির সংক্রান্তে বিশেষজ্ঞের মতামত, রিজভী আহমেদ ও জরিনা বেগমের অডিও রেকর্ড, সাক্ষীদের ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি, ঘটনা সংশ্লিষ্ট সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রেকর্ডকৃত জবানবন্দি, জব্দকৃত আলামত পর্যালোচনা, পূর্ববর্তী তদন্ত প্রতিবেদন সমূহ পর্যালোচনা, বিভিন্ন দালিলিক সাক্ষ্য, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য, কাগজপত্র ও অন্যান্য সাক্ষ্য পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে।
পিবিআইয়ের তদন্তের ফলাফল
১. সালমান শাহ খুন হননি
২. সালমান শাহ এর মৃত্যুর ঘটনাটি আত্মহত্যাজনিত
সালমানের আত্মহত্যার পাঁচ কারণ
১. সালমান শাহ এবং চিত্র নায়িকা শাবনুরের অতিরিক্ত অন্তরঙ্গতা;
২. স্ত্রী সামিরার সাথে দাম্পত্য কলহ;
৩. মাত্রাধিক আবেগ প্রবণতার কারণে একাধিকবার আত্মঘাতী হওয়ার বা আত্মহত্যার চেষ্টা;
৪. মায়ের প্রতি অসীম ভালোবাসা, জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে পড়ে পুঞ্জিভূত অভিমানে রূপ নেয়া;
৫. সন্তান না হওয়ায় দাম্পত্য জীবনে অপূর্ণতা।
মঙ্গলবার আদালতে যাবে সালমান হত্যার চূড়ান্ত প্রতিবেদন
সালমান শাহ আত্মহত্যার বিষয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন মঙ্গলবার সকালে আদালতে দাখিল করবে তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই।
সংস্থার প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ৬০০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি। মঙ্গলবার সকাল ১০টায় তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।
আরো দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করছিলেন সালমান
পিবিআই প্রধান বলেন, সালমান শাহ ছিলেন অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ, স্ত্রী সামিরা বিয়েতে রাজি না হওয়ার ৯০টি ইনওকটিন চেতনানাশক ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন তিনি। পরে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে তাকে ওয়াশ করানো হয়।
এরআগে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়াকে কেন্দ্র করেও একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন সালমান।
সামিরার সঙ্গে প্রেম থাকাকালীন সময়েও হাত কেটে রক্তমাখা চিঠি লিখেছিলেন সালমান।
যা ঘটেছিল সেদিন
পিবিআইয়ের উপস্থাপিত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে জানা যায়, সালমান শাহের বাবা কমর উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী অভিযোগ করেন গত ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৯ টা ৩০ মিনিটে ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডের ১১/বি ইস্কাটন প্লাজার বাসায় তার ছেলে সালমান শাহের সাথে দেখা করতে যান। সালমান শাহর বাসায় যাওয়ার পর ঘুমাচ্ছে শুনে তিনি সেখান থেকে ফিরে যান। বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে চলচ্চিত্র প্রোডাকশন ম্যানেজার সেলিম সাহেব তাকে ফোন করে জানান সালমান শাহের যেন কি হয়েছে এবং তাকে দ্রুত বাসায় যেতে বলেন। তখন তিনি, তার স্ত্রী ও ছোট ছেলেকে নিয়ে দ্রুত সালমান শাহের বাসায় গিয়ে দেখেন সালমান শাহ তার শয়ন কক্ষে মরার মতো পড়ে রয়েছে।
তখন তিনি উপস্থিত লোকজনদের সহায়তায় সালমান শাহকে বাসা থেকে বের করে দ্রুত নিকটস্থ ‘হলি ফ্যামিলি’ হাসপাতালে নিয়ে যান। যাওয়ার পথে তারা সালমান শাহ এর গলায় দড়ির দাগ এবং মুখমণ্ডল ও হাত-পা নীলাভ বর্ণের দেখেন। হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার সালমান শাহকে মৃত ঘোষণা করেন।
মৃত্যু হয়েছে ফাঁসের কারণে
সালমান শাহের বাবা লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে রমনা মডেল থানায় অপমৃত্যু মামলা নথিভুক্ত হয়। প্রথমে থানার এসআই মাহবুবুর রহমান মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে মৃতদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে লাশ ময়না তদন্তের জন্য পাঠান এবং সংশ্লিষ্ট আলামত জব্দ করেন। ডা. তেজেন্দ্র চন্দ্র দাস মৃতদেহের ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করেন।
তিনি মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মতামত প্রদান করেন যে, ‘মৃত্যু-ফাঁসের দরুণ ঝুলে শ্বাসরুদ্ধ হওয়ার কারণে হয়েছে। যা আত্মহত্যাজনিত’। তবে বাদীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্তভার ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়।
ডিবির তদন্তেও “আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু”
ডিবির সহকারি পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবীর মামলার তদন্তভার নিয়ে ১৯৯৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সালমান শাহের মৃতদেহ কবর থেকে উত্তোলন করে পুনরায় সুরতহাল ও ময়না তদন্ত করা হয়। তিনি আলামত জব্দ করেন। ডা. নার্গিস আরা চৌধুরী মৃতদেহের ময়না তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। মামলার তদন্ত সমাপ্ত করে সালমান শাহের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে “আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু” মর্মে প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৯৭ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি “চূড়ান্ত রিপোর্ট” দাখিল করেন।
ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদী না-রাজী আবেদন করলে মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দিলে ডিবির সহকারি পুলিশ কমিশনার মজিবুর রহমান পুনঃতদন্তের ভার গ্রহণ করেন।
১৯৯৭ সালের ১৯ জুলাই রেজভী আহমদ ওরফে ফরহাদ (২০) সালমান শাহের পিতার বাসায় গিয়ে লেলিন পরিচয় দিলে তার বিরুদ্ধে ক্যান্টনমেন্ট থানার মামলা নং-৩৭(০৭)৯৭ রুজু হয়। ঐ মামলায় তাকে গ্রেফতার করে বিজ্ঞ আদালতে সোপর্দ করা হয়। সে বিজ্ঞ আদালতে সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে মর্মে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করে।
আত্মহত্যা ব্যতীত অন্য কিছু পায়নি সিআইডি
মামলার বাদী আদালতে অপমৃত্যু মামলাটি পেনাল কোড ৩০২/৩৪ ধারায় হত্যা মামলায় পরিগণিত করে তদন্তভার সিআইডিকে অর্পণের আবেদন করেন।
অপমৃত্যু মামলাটি তদন্তাধীন থাকায় আবেদনটিসহ রেজভী আহমদের জবানবন্দির বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিজ্ঞ আদালত আইজিপিকে নির্দেশ প্রদান করেন।
সিআইডি সিটি জোন ঢাকার সহকারি পুলিশ সুপার খালেক উজ-জামান অপমৃত্যু মামলাটিসহ হত্যা মামলার আবেদন ও রেজভী আহমদের জবানবন্দির বিষয়ে তদন্তভার গ্রহণ করেন। তার তদন্তকালে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে জিজ্ঞাসাবাদে সালমানের মৃত্যুর বিষয়ে সে কিছুই জানেন না এবং তিনি সালমানের একজন ভক্ত হিসাবে তার ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় ও ছবি সংগ্রহের জন্য বাসায় গিয়েছিলেন জানায় রেজভী।
ক্যান্টনমেন্ট থানায় ও পরে আদালতে যে জবানবন্দি লেখা হয়েছে এটা তার নিজের কোন বক্তব্য নয়। তাকে ক্যন্টনমেন্ট থানায় মারপিট করা হয়। সালমানের মা-বাবা, ওসি ও ২জন এসআই তাকে সালমানের হত্যার ব্যাপারে স্বীকারোক্তি দিতে উদ্বুদ্ধ করেন বলেও উল্লেখ করেন।
অপমৃত্যু মামলার পুনঃতদন্ত সমাপ্ত করে সালমান শাহের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে আত্মহত্যা ব্যতীত অন্য কোন সন্দেহ বা অন্য কোন কারণ পাওয়া যায়নি মর্মে সিআইডি উল্লেখ করে।
তবে সালমান শাহের সঙ্গে চিত্র নায়িকা শাবনুরের অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা থাকায় স্ত্রী সামিরার সঙ্গে দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়। এ দাম্পত্য কলহের কারণেই সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন, সালমান শাহ’র মৃত্যু পরিকল্পিত কোন হত্যাকাণ্ড নয়, রেজভী আহমদের জবানবন্দিও সাজানো এবং সালমান শাহ এর মৃত্যুটি “আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু” মর্মে গত ১৯৯৭ সালের ২ নভেম্বর আদালতে “চূড়ান্ত রিপোর্ট” দাখিল করেন।
বাদীর না-রাজীর আবেদন
সিআইডি’র ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেও বাদী না-রাজী আবেদন করেন। বিজ্ঞ আদালত না-রাজী আবেদন না-মঞ্জুর করেন। পরে বাদী গত ১৯৯৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর না-মঞ্জুর আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মেট্রো ক্রিমিনাল রিভিশন মামলা নং-২৭৬/৯৯ দায়ের করলে মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের আদেশ হয়।
বিচার বিভাগীয় তদন্ত শেষে প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদি ও সামগ্রিক বিষয়াদী পর্যালোচনায় অভিযোগকারীর আনিত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে প্রতিয়মান হওয়ায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইমদাদুল হক গত ২০১৪ সালের ৯ জুলাই বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।
সালমান শাহের মা নিলুফার চৌধুরী ওরফে নীলা চৌধুরীর বিচার বিভাগীয় তদন্ত রিপোর্টের বিরুদ্ধে না-রাজী আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি র্যাবকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে ফৌজদারী রিভিশন মামলা নং-৩৫৮/২০১৫ দায়ের করেন। দীর্ঘ শুনানী শেষে আদালত র্যাবের তদন্তের আদেশ রহিতকরণ করেন, নিম্ন আদালতকে বাদীর নারাজীর দরখাস্ত আইনানুযায়ী নিষ্পত্তির নির্দেশ প্রদান করেন এবং আগের ইস্যু করা স্থগিতাদেশ তুলে নেন। পরে আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দেন।
২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর পিবিআই ঢাকা মেট্রো (উত্তর) ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক সিরাজুল ইসলাম (বাবুল) মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে।