চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আমার ছেলেবেলা

আমার জীবনে সবচেয়ে স্মৃতি বিজড়িত বিদ্যালয় লক্ষ্মীপুর সদরের দালাল বাজার বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাবা এই বিদ্যালয়ে ৩ যুগের বেশী শিক্ষকতা করেন। বাবা শিক্ষক হওয়ার কারণে প্রায়ই সেই স্কুলে যেতাম। সেখানে নিয়মিত দেখা হতো সনাতন ধর্মালম্বী বেশ কয়েক জন শিক্ষকের সঙ্গে। বাবার এই সহকর্মীদের পাশাপাশি অনেক বন্ধুও ছিলেন যারা হিন্দু সম্প্রদায়ের। এখনো আমি স্মরণ করতে পারি বিষ্ণুবাবু, বজ্রলাল স্যার, কানন দিদি, হরেকৃষ্ণ স্যারদের কথা, যাদের সঙ্গে আমার কেটে যেত দিনের অনেকটা সময়। নেইলি দি, টিংকু মল্লিক আংকেলদের সাথেও ছিল বেশ সখ্যতা।  অথচ কখনো আমার মনেই হয়নি এই মানুষগুলো আমাদের কেউ না।

বয়স তখন আট কি নয় । বাবা বলতেন সবাইকে আদাব বা সালাম দিবে। কিন্তু কখনো বলেননি যে হিন্দুদের আদাব আর মুসলিমদের সালাম দিতে। প্রায়ই আমি দ্বিধায় পড়ে যেতাম কাকে সালাম আর কাকে আদাব দেব। হিন্দু স্যারদের সালাম দিলেও তারা আদর করে কাছে ডেকে বলতেন, ‘কেমন আছ?’ বন্ধুদের কাছ থেকে শিখেছি যে হিন্দুদের আদাব/নমস্কার আর মুসলিমদের সালাম দিতে হয়।

কানন দিদি এত আদর করতেন যে প্রায়ই বলতেন, ‘তুই আমার ছেলে। তোর বাবা-মায়ের কাছে দত্তক দিয়েছি’। এতে আমার কখনো মন খারাপ হত না। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সেই স্কুলে পড়েছি। দুপুরে দেখতাম শিক্ষক-শিক্ষিকারা একসঙ্গে খেতে বসছেন। স্যারের ছেলে, তাই আমিও তাদের সঙ্গী হতে পারতাম। মজার তরকারিগুলো এক প্লেট থেকে আরেক প্লেটে ঘুরে আসত চোখের পলকে। কখনো কারো মধ্যে বিন্দু পরিমাণ সংকোচ দেখিনি। আমার এখনো কানন দিদির কথা খুব মনে পড়ে। কোথায় আছেন, কেমন আছেন ?  আমাকে মনে রেখেছেন কি না। মাঝে মাঝে ভাবি, ওই দিনগুলো ফিরে ফেলে মন্দ হতো না। আচ্ছা, এই মিলনমেলা এখনো হয়? এখন তো সবাই অনেক ‘শিক্ষিত’, তাহলে চারপাশে এত ধর্মান্ধ মানুষ কোথায় থেকে এল? আগের সেই মানুষগুলোই বা কোথায় গেলেন?

পূজার সময় আমাদের অন্যরকম আনন্দ হত। বাবা আসার সময় সন্দেশ বা নাড়ু নিয়ে আসতেন। তখন বুঝিনি হিন্দু কী আর মুসলিম কী! এখন বুঝি, আমার শিক্ষক বাবাই আসলে এসব পার্থক্য বোঝাননি।

আম্মা খুব বেশি পড়াশোনা করেননি। প্রচণ্ড ধর্মভীরু। উনি কখনো হিন্দুর বাড়িতে খাবার খাওয়া পছন্দ করতেন না। তাই বলে আমাদের খেতেও বারণ করতেন না। তবে বাড়িতে বাবার অন্য ধর্মের বন্ধু বা পরিচিত কেউ আসলে ঠিকই যত্ন করতেন।
আমরাও যে কতবার হিন্দু শিক্ষক বা বন্ধুদের বাসায় গিয়েছি তার হিসাব নেই। সাত ভাই-বোন বাবার আদর্শই পেয়েছি। সময়ের বিবর্তনে আম্মার মধ্যেও এখন আর সেই ধর্মীয় গোঁড়ামি আর নেই। পড়াশুনা না জানা মায়ের পরিবর্তন হলেও শিক্ষিত মানুষ এই ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে বের হতে পারেননি।

মেহরাবের বাবা
বাবার সাথে

 

প্রাথমিক শেষ করে গ্রামের স্কুল মোহাম্মদপুর উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হই। সেখানে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত ছিল। গণিতে আমি খুব দুর্বল ছিলাম, মানে টেনেটুনে পাশ করাটাও আমার জন্য যুদ্ধ ছিল। সুরঞ্জিত বাবু নামের এক স্যারের অনুপ্রেরণায় আমাকে এক সময় গণিত নিয়ে অতটা ভাবতে হয়নি। এরপর দালাল বাজার এন.কে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ  নিই। হিন্দু-মুসলিম বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা হতো সবার প্রিয় সন্তোস ডাক্তার কিংবা অরুন দাদার দোকানে অথবা মহাপ্রভুর বাড়িতে (মন্দিরে)। পুজোয় আড্ডা হতো বেশ, এই দিনগুলোতেও আমার মধ্যে পরিবর্তন আসেনি।

আমার অনেক প্রিয় বন্ধু হিন্দু সম্প্রদায়ের। এমনকি বিশ্ববিদ্যলয় জীবনেও আমার প্রিয় শিক্ষক দিপায়ন ভদ্র স্যার। স্যারের বাসায় যতবারই গিয়েছি মনে হয়েছে, আন্টির ভালোবাসায় মনে হয়েছে ইনারা খুব কাছের কোনো আত্মীয় আমার।

ভারত সরকারের আইসিসিআর স্কলারশিপ নিয়ে বর্তমানে আমি দিল্লি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছি। ১৮জন শিক্ষার্থীর মধ্যে আমি একমাত্র মুসলিম। এখন পর্যন্ত কোনো মুসলিম শিক্ষকও পাইনি। তারপরও কখনো আমার মনে হয়নি ওরা অন্য ধর্মের। এমন দারুন বোঝাপড়া যা শুধু মানুষ মানুষের মধ্যেই হয়।

আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস নেই, কিন্তু মানবিক শিক্ষায় আমরা কেন এতটা পিছিয়ে পড়ছি-এই ভাবনায় এখন আমার দিন কাটছে। গুজব কান/পরিকল্পিত ঘটনা জেনেও প্রতিবেশি সংখ্যালঘু ভাই-বোনদের কষ্ট দিয়ে আমরা কোন আনন্দটা পাচ্ছি? আমাদের বাবা-মা আমাদের কী শেখাচ্ছেন? প্যালেস্টাইন/ আফগানিস্তান নিয়ে আমাদের আহাজারি অনেক! অথচ নিজের দেশকে আমরা সেই পথেই নিয়ে যাচ্ছি।

নিজের জীবন থেকে এতটুকু বুঝি- মানুষের মানবিক বিকাশ পরিবার ও বিদ্যালয় থেকেই আসে। একটি সচেতন পরিবারই হলো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূল ভিত্তি। এখনকার দিনে যারা এই হামলা-ভাঙচুর করছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের ৯৫ শতাংশ পরিবারই অন্য ধর্মের মানুষদের ঘৃণা করে।

বাবাকে কখনো কোনো কিছুতে সেইভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো হয়নি। আজ পেছনে ফিরে মনে হয়, তার ঘরে জন্ম বলেই আমি এমন হয়েছি।আমি ঠিক জানি, আমার মতো মানুষের সংখ্যাটাই পৃথিবীতে বেশি। এটাও জানি, একদিন পৃথিবীটা এমন মানুষেই ভরে যাবে। হ্যাঁ, একটু দেরিতে হলেও পৃথিবী এমন হবে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)