চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সামান্য ‘নো’ বল নিয়ে বিতর্কে এমন হত্যাকাণ্ড!

এসএসসির ফলাফল হাতে শিক্ষার্থী ও তাদের প্রিয়জনদের যখন উচ্ছ্বাস তখন ভাল ফল পেয়েও ব্যতিক্রম মিরপুরের একটি পরিবার। শোকের মাতমে ভারি হয়ে ছিল বসতি হাউজিংয়ের ১০/সি নম্বর বাড়িটি। পরিবারের আর্ত চিৎকারে আশে পাশের বাসিন্দাদের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। চোখের জলে মকলের আলোচনায় এস এস সি পরীক্ষায় বাবুলের ভাল ফল, তার মৃত্যু ও ক্রিকেট।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবেশে অটো মোবাইলস মেকানিকের সন্তান হয়ে জিপিএ-ফাইভ পাওয়া ছেলেটির অর্জনে পরিবারের স্বপ্ন আরো বেড়ে যাওয়ারই কথা ছিল! কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের ঘণ্টাখানেক আগে ক্রিকেট খেলার ‘নো’ বলকে কেন্দ্র করে বন্ধুদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বিপক্ষ দলের এক বন্ধুর ব্যাটের আঘাতে মৃত্যু হলো মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-ফাইভ বাবুল শিকদারের।

স্থানীয় লোকজন জানান, বুধবার বেলা ১১টার দিকে মিরপুরের বড়বাগের বসতি হাউজিংয়ের ধানক্ষেত মোড় সংলগ্ন একটি খেলার মাঠে এ হৃদয় বিদারক ঘটে। খেলায় একটি বলে আউট হয় বাবুল। বলটি ‘নো’ ছিল বলে বাবুল দাবি করে। এ নিয়ে বিবাদের শুরু। এরপর বাবুল পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশ উপলক্ষে আজকের মতো খেলা বন্ধও করতে বলে। কিন্তু কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে এক বন্ধু ব্যাট দিয়ে তার মাথার পেছনে আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বাবুল। তাকে আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সাইন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এর কিছুক্ষণ পর দুপুরে এসএসসির ফল প্রকাশের পর দেখা যায়- বাবুল জিপিএ-ফাইভ পেয়ে উৎতীর্ণ হয়েছে। প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন দেখত বাবুল। বাবা মোস্তফা শিকদার স্থানীয় রাব্বি অটো মোবাইলসের মেকানিক হলেও স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। বাবাকে বাবুল বলতো, ‘বড় হয়ে একদিন মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো আমি।’

তাঁর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল। সেসঙ্গে পরিবারের স্বপ্নও অধরাই রয়ে গেল। বাবুলের বাবা মোস্তফা শিকদার বলেন, ‘বাবুল পড়াশোনায় খুব মনযোগী ছিল। এবারের রেজাল্ট নিয়েও সে আশাবাদী ছিল। সে বলত, এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে সে বিদেশে যাবে। সেখানে পড়াশোনা করবে, কাজ করবে। একদিন মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দেশে ফিরে আসবো। আমাদের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।’

বাবুল তার পরিবারের সঙ্গে মিরপুরের বসতি হাউজিংয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকত। তাদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর সদর উপজেলার দক্ষিণ আলমনগর গ্রামে।

ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবুল শিকদারের তিন বন্ধুকে আটক করা হয়েছে। হয়তো বিচার হবে, হয়তো হবে না। বিচার হলেও বাবুলের মা জাহানারা বেগম কখনোই আর তার ছেলেটিকে ফিরে পাবে না। ভাই ফিরে পাবে না ভাইকে। তাদের আর্তনাদে মিরপুরের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে।

বাবা অটো মোবাইল কারখানাতে কাজ করলেও তাঁকে কখনো ইঞ্জিনিয়ার বলা যাবে না, কারণ তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার সনদটি নেই, যা তিনি পূরণ করতে চেয়েছিলেন সন্তানের দ্বারা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সব বাবা-মায়েরাই চান তাদের সন্তান মুস্তাফিজ কিংবা সাকিবের মতো ক্রিকেটার হোক। কিন্তু মুস্তাফিজ কিংবা সাকিব হয় বড় জোর কোটিতে একজন। আর বাস্তব স্বপ্ন হলো সন্তানকে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গড়ে তোলা, তবু সেই স্বপ্নপূরণ হয় না নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের। অর্থ কিংবা ঘাতে অপঘাতে তা অধরাই রয়ে যায়।

বাবুলের মতো এমন ট্র্যাজেডি এটাই প্রথম না। গতমাসের ১৬ তারিখে মোহাম্মদপুরের বাশঁবাড়ি এলাকাতেও ক্রিকেট খেলা নিয়ে বিরোধের জের হিসাবে আদিপ নামের ১৮ বছরের একটি ছেলে খুন হয়। তবে কি শহুরের ইট পাথরের বেড়াজালে আবদ্ধতার কারণেই বিবেক ও বুদ্ধির অবসান ঘটেছে এই প্রজন্মের কিশোর-কিশোরী তরুণ-তরুণীদের? নৈতিকতা বিবর্জিত সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠা এর জন্য কম দায়ী নয়। আসলে বাবুলের মৃত্যুর জন্য আমরা সবাই দায়ী। কারণ: আমরা আমাদের সন্তানদের এই নৈতিক শিক্ষাটা ঠিকঠাকমতো দিতে পারছি না। যে কারণে ঘটছে এক একটি স্বপনের অপমৃত্যু।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)