বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় তার বয়স মাত্র ছয়। ছেলেটি বড় হয়ে সাংবাদিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা কাভার করেছে। সেই বিচারের রায় আংশিক কার্যকর হওয়া দেখতে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো এক দশক। এই একজনের কথাতেই বোঝা যায় জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখতে জাতিকে কতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে।
‘এখনো আমরা নিশ্চিত নই যে আমাদের জীবদ্দশায় আমরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন দেখতে পাবো নাকি পাবো না,’ এভাবে তার হতাশার কথা জানালেও নিজেদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নিজের দায়িত্ব পালনের কথাও বললেন জাহিদ নেওয়াজ খান।
‘সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা কাভার করতে গিয়ে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আর জেরার প্রশ্নোত্তরে, প্রতি মুহূর্তে, দেশের রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সামরিক ও গোয়েন্দা যে ব্যর্থতা, তার দালিলিক প্রমাণ সিরিজ রিপোর্ট আকারে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছি,’ বলে জানান চ্যানেল আই অনলাইনের সম্পাদক।
দেশের অন্যতম সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা ‘শ্রাবণ প্রকাশনী’ তার ধারাবাহিক রিপোর্টটি বই আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত জানানোর পর তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের গ্রেফতারের সময় থেকেই আমি বার্তা সংস্থা ইউএনবির রিপোর্টার হিসেবে বিষয়টি কাভার করছিলাম। অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার, রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে শুরু করে পরে বিচার শুরু হলে আমি এবং সিনিয়র সহকর্মী রাশেদ চৌধুরী পুরো বিচারটি কাভার করি। সেসময় আদালতে সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও জেরার নোট, আইনজীবীদের যুক্তি-পাল্টা যুক্তির নোট, বিচারিক আদালতে বিচার ও রায় এবং পরে ডেথ রেফারেন্সের পেপারবুক ঘেঁটে যা পেয়েছি তা নিয়েই ছিলো আমার এই সিরিজ রিপোর্ট।
অগাস্ট মাসের ১ তারিখ থেকে ১৪ অগাস্ট পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে চ্যানেল আই অনলাইন।
‘ঘরে বসে হলেও আমাকে গবেষণা করতে হয়েছে। তবে, এটা কোনো গবেষণা নয়। এটা একেবারেই একজন রিপোর্টারের তথ্য বিশ্লেষণ যেখানে নিজের বা মনগড়া কোনো বক্তব্য নেই। ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা কাগজে গোপন তথ্য ফাঁসের মতো বাতাসে ভেসে বেড়ানো কোনো গল্প বা গুজবও নেই। এটি তথ্য ও সংবাদ বিশ্লেষণ,’ এভাবেই তার ধারাবাহিক রিপোর্টটিকে বিশ্লেষণ করেন জাহিদ নেওয়াজ খান।
‘এখানে কোনো পক্ষপাতিত্ব বা কাউকে বড় বা ছোট করার কোনো চেষ্টাও নেই। পক্ষপাতিত্ব একটাই ছিলো: একজন রাষ্ট্রপতি, যিনি আমাদের জাতির জনক, স্বাধীনতার স্থপতি, সেই প্রেসিডেন্টকে রক্ষায় যাদের দায়িত্ব ছিলো তাদের ব্যর্থতার দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা, এবং সেটা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য দলিলের ভিত্তিতে,’ বলে মন্তব্য করেন চ্যানেল আই নিউজের এই বার্তা সম্পাদক।
তখন যেটা দৈনিক রিপোর্ট হয়েছিলো, সেটা কেনো আবার এতোদিন পর? এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন: এর প্রধান কারণ হচ্ছে, ওই সময় যাদের জন্ম হয়েছিলো, তাদের এখন বিষয়টি বোঝার বয়স হয়েছে। প্রায় ছয় বছর আগে আপিল বিভাগে পূর্ণাঙ্গ রায় হয়ে যাওয়ার পরও অপেক্ষা করেছি যাতে ওইসময়ের শিশুরা এমন বয়সে আসে যখন তারা একটি বিশ্লেষণ পড়ে নিজেরাও বিশ্লেষণ করতে পারে।
তিনি বলেন, নতুন প্রজন্মের জানা উচিত যে কেনো তাদের রাষ্ট্রের জনক হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হতে ২১ বছর লেগে গেলো, কেনো বিচার শেষ হওয়ার পর কয়েকজন খুনির ফাঁসি কার্যকর হতে আরো একযুগ লাগলো, কেনো এখনো কয়েকজন খুনি ধরাছোঁয়ার বাইরে!
জাহিদ বলেন: ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার দলিল’ পড়লে তারা সেই মূল কারণটা উপলব্ধি করতে পারবে। সে কারণেই আবারো এ বিষয়টি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন। তবে কয়েক পর্ব প্রকাশের পর থেকেই অনেকে বই করার কথা বলছিলেন। শ্রাবণও বই প্রকাশের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠে।
এ বিষয়ে শ্রাবণ প্রকাশনীর রবীন আহসান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে মামলার দলিলের ভিত্তিতে ধারাবাহিক প্রতিবেদনগুলো শ্রাবণ বই হিসেবে প্রকাশ করতে চায় নতুন প্রজন্মের সামনে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য।
‘সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান-এর প্রতিবেদনগুলোতে ফুটে উঠেছে সেই কালো রাতের অনেক অজানা অধ্যায়। বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান নেতাকে সামরিক বাহিনীর গুটিকয়েক বিপথগামী গুলি করে হত্যা করে ! কিন্তু জাহিদ এই হত্যাকাণ্ডের পেছনের শক্তি গুলোকেও চিহ্নিত করেছেন,’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রবীন বলেন: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ঠেকাতে সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে বাংলায় তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বই নেই। আমরা শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে এই প্রতিবেদনগুলো একসঙ্গে করে বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই আগামী নভেম্বর মাসে বই আকারে প্রকাশ করবো।