নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলায় সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেনসহ হোমড়া-চোমড়া ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বাকি ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পেয়ে যায়, তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে।” এর আগে বিচারিক আদালত ‘এই সাত খুনের ঘটনাকে ‘মানবতা বিরোধী অপরাধ’ হিসেবে ঘোষণা করে বলেছিলেন, যে পদ্ধতিতে ভুক্তভোগীদের হত্যা করা হয়েছে তাতে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবসময় অপরাধমূলক মানসিকতা ধারণ করতো এবং তারা যে অপরাধ করেছে তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
নানা দিক থেকেই এই মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই মামলায় মোট আসামির ৩৫ জনের মধ্যে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড (ফাঁসির) দিয়েছেন আদালত। এটি একটি ইতিহাস। বিচারিক আদালতের রায়ে এ মামলায় দণ্ডিত ৩৫ আসামির মধ্য ২৫ জনই র্যাবের সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৫ জন সেনাবাহিনী, দু’জন নৌবাহিনী ও আটজন পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে ছিলেন। ফৌজদারি অপরাধে একসঙ্গে এত র্যাব সদস্যদের সাজা এর আগে আর হয়নি।
বিচারিক আদালতে সাত খুন মামলার যে রায় প্রদান করা হয়েছিল, তা ছিল জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন। যদিও হাইকোর্টে ১১ জনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে তারপরও তা ভিকটিমদের স্বজনদের মনে স্বস্তি এনে দিয়েছে। কারণ মূল আসামিদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হয়নি। যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে হয়েছে তাদের মধ্যে নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিল। যার নেতৃত্বে নূর হোসেন এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেই র্যাব কমান্ডার লে. কর্নেল তারিক সাঈদ ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের প্রাক্তন শীর্ষ নেতা এবং বর্তমানে দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মেয়ের জামাই। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত র্যাবের অপর আসামি আওয়ামী লীগের একজন সংসদ সদস্যের নিকটাত্মীয়। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যাপারে অনেকের মনে সংশয় দেখা দিয়েছিল। হাইকোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে আপাতত তার অবসান ঘটল।
এই সাত খুনের ঘটনায় সবচেয়ে যা উদ্বেগজনক তা হল, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ৩৫ আসামির মধ্যে ২৫ জনই র্যাব সদস্য। এ কারণেও এ ঘটনার নিষ্পত্তি শেষ পর্যন্ত কী হয়, অপরাধীদের কী সাজা হয় তা দেখার অপেক্ষায় ছিল দেশবাসী।
আমরা মনে করি, শুধু সাধারণ মানুষ নয়, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধেও কোনো অভিযোগ আনা হলে প্রতিটি অভিযোগেরই যথাযথ নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি। কারণ এর সঙ্গে গোটা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির প্রশ্ন জড়িত। দু-একজন ব্যক্তির জন্য সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি কলুষিত হোক, এটা কারও কাম্য হতে পারে না। তাছাড়া কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের আস্থা হারালে তা শুধু ওই প্রতিষ্ঠানের নয়, গোটা দেশের জন্যই বিপজ্জনক।
কিছু ব্যক্তির অপরাধের দায়ভার যেমন পুরো বাহিনীর উপর বর্তায় না, আবার রাষ্ট্রীয় একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী যখন সামান্য টাকার লোভে খুনী হয়ে যায়, তখন সেই বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস হারিয়ে যায়। যা একটা জাতীয় ক্ষতি। বস্তুত এ সাত খুনের নেপথ্যে ছিল অবৈধ অর্থ লেনদেন। সে সময় নারায়ণগঞ্জ জেলায় কর্মরত র্যাব-পুলিশসহ স্থানীয় প্রশাসনের অনেকেই অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, যা উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রশাসন, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সদস্যরা যখন কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, তখন দেশের মানুষ কতটা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়তে পারে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা এর একটি বড় নজির হয়ে থাকবে।
তাই সর্বস্তরের মানুষ এ ঘটনায় জড়িত প্রত্যেকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করেছে। অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে সরকারের দৃঢ় অবস্থান কামনা করেছে। নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ ও খুনের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার এবং অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি।
এ রায়টি রায়টি বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে অধুনা প্রচলিত একটি অভিমতকে পাল্টে দিতে সাহায্য করবে বলে আমরা মনে করি। সাধারণ অভিমত হলো, বাংলাদেশে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে। ইলিয়াস আলীর গুম হওয়ার রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়া, সাগর-রুনির হত্যা মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকা, তনু হত্যার ব্যাপারে কোনো কূলকিনারা না হওয়া, ব্লগার হত্যাকারীদের ধরার ব্যাপারে বিলম্ব ও অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা, বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় হাইকোর্ট কর্তৃক বিচারিক আদালত থেকে পাওয়া মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই প্রদান ইত্যাদি মানুষের মনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচারব্যবস্থার প্রতি একটা গভীর হতাশা তৈরি করেছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলায় রায় এ ক্ষেত্রে মানুষের মন থেকে এই হতাশাই শুধু কাটাবে না, বর্তমান সরকারের আমলে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা সম্পর্কে মানুষের মনে কিছুটা হলেও আস্থা ফিরিয়ে আনবে।
‘আইন সবল ও ক্ষমতাশালীদের স্পর্শ করতে পারে না’ বলে সমাজে যে কথাটি প্রচলিত আছে, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় সেই কথাটিকে অনেকটা অসার প্রমাণ করেছে। এই মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন ধনী ব্যবসায়ী, সাবেক কাউন্সিলর এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। ভারতে পালিয়ে গিয়েও তিনি বাঁচতে পারেননি। পলাতক বিএনপি নেতা এবং নানা গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত (তার মধ্যে কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডও রয়েছে) হারিছ চৌধুরীকে ধরে এনে বিচারে সোপর্দ করা ও দণ্ড দেওয়া এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি, কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনকে বিদেশ থেকে ধরে এনে অল্প দিনের মধ্যে বিচার করে দণ্ড দেওয়া গেছে, এটা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য একটা বড় প্লাস পয়েন্ট।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা আইন ভঙ্গ বা কোনো অপরাধ করলে ক্ষমতার জোরে আইনের ফাঁক দিয়ে সহজেই বেরিয়ে যান বলে আমাদের দেশে যে কথাটি প্রচলিত, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার রায় সেই অপবাদ থেকেও দেশকে অনেকটা মুক্তি দিতে পারে। র্যাবের অভিযুক্ত কর্মকর্তাদেরও প্রাণদণ্ডের আদেশ বহাল রাখা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ মামলার ব্যাপারে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে চায়নি। এটা একটা বড় আশা আলো ও ভরসার কথা।
ওপরতলার মানুষ যদি বড় বড় অপরাধ করে দণ্ড এড়ায় আর নিচুতলার মানুষ ছোট অপরাধ করেও শাস্তি পায়, তাহলে সে দেশে আইনের শাসন কায়েম হতে পারে না, গণতন্ত্রও সুরক্ষা পায় না। বাংলাদেশে যদি এই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করা যায় যে আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, যিনি যত ক্ষমতা ও প্রভাবের অধিকারী হন, আইনের হাত এড়াতে পারবেন না; তাহলে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, হত্যা, নির্যাতন প্রভৃতি অপরাধ দমনের জন্য সরকারকে নিত্যনতুন আইন করতে হবে না। প্রচলিত আইনের দ্বারাই দেশে আইনের শাসন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।
এই রায় বিশ্লেষণে বলা যায়, এটি কেবল হত্যার বিচার নয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে আদালতের সমুচিত রায়। নারায়ণঞ্জের সাত খুনের ঘটনা উদ্ঘাটিত হবার মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হয়েছে সত্য কখনো চাপা থাকে না। এ রায় আমাদের বিচার বিভাগের জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এ রায় ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত।
একই সঙ্গে সাতজনকে খুন করে লাশ যে কায়দায় নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, সে খবরে দেশবাসী যেমন শিউরে উঠেছিল, তেমনি পরে এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে র্যাবের একটি ইউনিটের প্রায় সব সদস্যের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ সবাইকে হতবাক করেছিল। আপাতত নিহতদের স্বজনের পাশাপাশি দেশবাসীও এই রায়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
সুপ্রিম কোর্টেও এ রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত দণ্ড কার্যকর হবে-এখন এটাই জনপ্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)