সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার ‘সন্দেহভাজন’ তানভীর রহমান তার ক্ষেত্রে এই মামলাটি বাতিল চেয়ে করা আবেদন কার্যতালিকা থেকে বাদ দিলেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়টির শুনানিতে হাইকোর্ট বেঞ্চের এখতিয়ার নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপত্তির প্রেক্ষাপটে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ আদেশ দেন।
আজ শুনানির শুরতে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা ও সন্দেহভাজন তানভীর বিষয় সংক্রান্ত র্যাবের দেয়া প্রতিবেদন আদালতকে তুলে দেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।
এ সময় আদালত বলেন: ‘আদালতে কোন রিপোর্ট বা প্রতিবেদন আসার আগেই যদি তা মিডিয়াতে চলে যায় সেটা দুঃখজনক। এটাতো ঠিক না। একেক মিডিয়ায় একেক ধরনের লেখা আসে। এতে বিচার্য বিষয়টির ওপর জনগণের এক এক ধরনের পারসেপশন তৈরি হয়। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন: ‘মাই লর্ড এ বিষয়টি কন্ট্রেম্পচুয়াস (আদালত অবমাননাকর)। এ সময় আদালত বলেন: ‘মিডিয়া পেলে তো দিবেই। কিন্তু তাদের দেয় কে? হয় তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কেউ কিংবা অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়, এই দুই দিকের একদিক থেকেই এগুলা মিডিয়ায় আগে চলে যায়। এগুলো ঠিক না।’
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন: ‘এর আগে মামলা বাতিলের তানভীরের আবেদনটি যখন করা হয় তখন এই হাইকোর্ট বেঞ্চের ক্রিমিনাল জুরিসডিকশন (ফৌজদারি এখতিয়ার) ছিল। কিন্তু জুরিসডিকশন চেঞ্জ হয়ে এখন এই বেঞ্চের রিট জুরিসডিকশন রয়েছে। তাই এই আদালত এ বিষয়ে এখন আদেশ দেয়ার এখতিয়ার রাখেন না।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের এমন যুক্তির পর আদালত বলেন: ‘রুলস অনুযায়ী, কোন বেঞ্চ একটি জুরিসডিকশন থাকা অবস্থায় কোনো মামলার রুল এবং আদেশ দিলে, পরবর্তীতে ওই জুরিসডিকশন চেঞ্জ হলেও চলমান মামলাটির ক্ষেত্রে আদেশ দিতে পারেন। সেই বিবেচনায় এ বিষয়ে আমাদের এখতিয়ার রয়েছে। তবে যেহেতু রাষ্ট্রপক্ষ এক্ষেত্রে আমাদের এখতিয়ার নিয়ে আপত্তি তুলেছেন তাই আমারা (তানভীরের মামলা বাতিলের) বিষয়টি আমাদের বেঞ্চের কার্যতালিকা থেকে বাদ দিচ্ছি।’
এ সময় আদালতে তানভীরের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
এর আগে সাগর-রুনি হত্যায় সন্দেহভাজন হিসেবে অভিযোগ ওঠা তানভীর রহমান নামের এক ব্যক্তির করা মামলা বাতিলের আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করেন। সে অনুযায়ী গত ১১ নভেম্বর হাইকোর্টে হাজির হন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম। সেদিন এ কর্মকর্তা হাইকোর্টকে বলেন: ‘তদন্ত চলছে। চারটি ডিএনএর নমুনা এফবিআইয়ের সনদপ্রাপ্ত একটি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে দুটি নমুনা আসামিদের সঙ্গে মেলেনি। বাকি দুটি নমুনা প্রকাশিত হয়নি। যে কারণে নমুনা পুনরায় এফবিআইয়ের সনদপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়েছে। এরপর হাইকোর্ট সন্দেহভাজন হিসেবে আটক মো. তানভীর রহমান ও এ মামলার তদন্ত সংক্রান্ত বিষয়ে
আদেশের জন্য ১৪ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।
সে ধারাবাহিকতায় গত ১৪ নভেম্বর হাইকোর্ট তার এক আদেশে সন্দেহভাজন তানভীর রহমানের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন। সেই সাথে তানভীর রহমানকে নিম্ন আদালতে স্বশরীরে হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেন। তবে আইনজীবীর মাধ্যমে তাকে হাজিরা দিতে বলা হয়। এছাড়া হাইকোর্ট তার ওই আদেশে বলেন: ‘দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হলেও তদন্তের মাধ্যমে মামলার রহস্য উদ্ঘাটিত না হওয়া এবং অপরাধীদের চিহ্নিত, গ্রেপ্তার এবং বিচারের সম্মুখীন না করতে পারা নিঃসন্দেহে দুঃখ ও হতাশার বিষয়। প্রযুক্তিনির্ভর অভিজাত ও চৌকস বাহিনী হিশেবে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান র্যাব দেশের জঙ্গি, সন্ত্রাস, মাদক, বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, ভেজাল প্রতিরোধসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অনন্য সফলতা কিছুটা হলেও ম্লান হবে, যদি এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন ও দোষীদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করে বিচারের সম্মুখীন করতে না পারে।’
হাইকোর্ট তার ওই আদেশে আরো বলেন: ‘আদালত প্রত্যাশা করছে যে, র্যাব অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করে হত্যা রহস্য উন্মোচন ও প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করে বিচারে সোপর্দ করতে সক্ষম হবে। বিশেষায়িত এই বাহিনী ব্যর্থতার দায়ভার বহন করুক এটা কারোরই কাম্য নয়।’
এরপর হাইকোর্ট সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের সর্বশেষ অবস্থার অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়ে এ বিষয়ে আদেশের জন্য ৪ মার্চ দিন ধার্য করেন।
সে অনুযায়ী আজ হাইকোর্টে সাগর-রুনি হত্যার তদন্তের যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয় সেখানে বলা হয়েছে: ‘ডিএনএ পরীক্ষার প্রাথমিক তথ্যানুযাযী সাগরকে বাঁধার জন্য ব্যবহৃত চাদর এবং রুনির টি-শার্ট হতে প্রাপ্ত নমুনা পরীক্ষণে প্রতীয়মান হয় উক্ত হত্যাকাণ্ডে কমপক্ষে দুইজন অপরিচিত পুরুষ জড়িত ছিল।
এই অপরিচিত অপরাধী সনাক্তকল্পে ডিএনএ প্রস্তুতকারী যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিপেন্ডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিস ল্যাব ও পরাবন স্নেপশট ল্যাব কর্তৃপক্ষের সাথে বর্তমান যোগাযোগ অব্যাহত আছে। প্রতিষ্ঠান দুটি ডিএনএ -এর মাধ্যমে অপরাধীর ছবি/অবয়ব প্রস্তুতের চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে।’
এছাড়া এই হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন মো. তানভীর রহমানের মোবাইলের কল হিস্ট্রি তুলে ধরে তার বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘হত্যাকাণ্ডের দিন অর্থাৎ ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৮টায় সে (তানভীর রহমান) স্কুলের পিকনিকে অংশগ্রহণের নিমিত্তে পুবাইল চলে যান এবং রাত আনুমানিক সাড়ে ৮টায় বাসায় ফিরে টেলিভিশনে রুনির হত্যার ঘটনা জানতে পারেন। মোবাইল কল লিস্ট অনুযায়ী হত্যার দিনে আনুমানিক সকাল ৭টা ২১ মিনিটে রুনির ফোন থেকে তানভীরের ফোনে কল যায়, যার স্থায়িত্ব ছিল ৮ সেকেন্ড।’
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়: ‘প্রতিদিন তানভীর ও রুনির মধ্যে একাধিকবার যোগাযোগ হলেও হত্যার দিন তানভীর রুনিকে একবারও ফোন করেনি। এমনকি রাতে হত্যার খবর জানার পরও তানভীর রুনি বা সাগরের বিষয়ে কোনো খোঁজ খবর নেননি বা তাদের জানাযাসহ কোনো ধরনের ধর্মীয় কর্মসূচিতেও অংশগ্রহণ করেনি। স্বাভাবিকভাবে আসামি তানভীর রহমানের ঘটনার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী আচরণ খুবই সন্দেহজনক। তাহাকে এই মামলার ঘটনায় জড়িত নহে এই কথা এ পর্যায়ে বলা যুক্তিযুক্ত হবে না।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাড়িতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। সাগর মাছরাঙা টিভিতে আর রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের সময় বাসায় ছিল তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সরওয়ার মেঘ। এই হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
এ মামলায় মোট আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরা হলেন রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুণ, সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল, পলাশ রুদ্র পাল এবং নিহত দম্পতির বন্ধু তানভীর রহমান। এদের মধ্যে প্রথম পাঁচজনই মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে গ্রেপ্তার হন। প্রথম পাঁচজন ও নিরাপত্তারক্ষী এনামুল এই মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
এদিকে এ হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ৭১ বারের মত পিছিয়ে আগামী ২৩ মার্চ নতুন দিন ধার্য করেছেন ঢাকার সিএমএম আদালত।