চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

সাকিব ঝাঁজে সেমির আশা থাকল

বাংলাদেশ টেবিলের পাঁচে

সাউদাম্পটনের রোজ বোলে আফগানিস্তানকে নিয়ে যেন একাই খেললেন সাকিব আল হাসান! প্রথমে ব্যাট করে পেলেন ৫১ রান, বাংলাদেশ পেল ২৬২ রানের চ্যালেঞ্জিং সংগ্রহ। পরে বল হাতে একাই গুঁড়িয়ে দিলেন প্রতিপক্ষের মেরুদণ্ড, শিকারি বাঘের মতো তুলে নিলেন ৫ উইকেট। সাকিব ঝাঁজে ২০০ রানে অলআউট হয়ে ৬২ রানে হেরে আসরে জয়হীনই থাকল আফগানরা।

কবিতার বুলিতে ম্যাচের আগেরদিন বাংলাদেশকে ডুবিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন আফগানিস্তান অধিনায়ক গুলবাদিন নায়েব। কিন্তু কবিতার ছন্দ যে মাঠে খাটে না সেটা মর্মে মর্মে বুঝিয়ে দিলেন সাকিব আল হাসান। আরব্য রজনীর দৈত্যের মতো এক হানায় গুঁড়িয়ে দিলেন আফগানদের টাইগার বধের স্বপ্ন।

সাকিবের কাব্যিক পারফরম্যান্সে আবারও সেমির স্বপ্ন জেগে উঠল বাংলাদেশের। আফগানদের হারিয়ে শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ঠেলে লাল-সবুজরা উঠে গেছে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচে। সাত ম্যাচে টাইগার পয়েন্ট এখন ৭। শীর্ষে থাকা- নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত আর ইংল্যান্ড যদি পা পেছলায়, ভারত-পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজেদের শেষ দুই ম্যাচে যদি জয় আসে, সেমিফাইনালে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার দলের জন্য।

নিজেদের ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সময় উইকেটের চেহারা টের পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষের স্পিন আর বড় মাঠের কারণে রান তুলতে হাঁসফাঁস করতে হয়েছে। বল হাতে তাই আফগানদের যেন সেই সময়টাই ফিরিয়ে দিতে চাইল বাংলাদেশ। মাশরাফী-মোস্তাফিজরা শুরুটাও করলেন কিপ্টেভাবে। দেখেশুনে বাংলাদেশকে কোনো উইকেট উপহার না দিয়ে আফগানরা প্রথম ১০ ওভারে তুলে ফেলে ৪৮ রান।

আঁটসাঁট বোলিংয়ে রান আটকানো গেলেও ক্রমেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল আফগানদের উদ্বোধনী জুটি। সেই জুটি ভাঙার জন্য ১১তম ওভারেই নিজের সেরা অস্ত্র সাকিব আল হাসানকে ব্যবহার করেন মাশরাফী। অধিনায়কের ভরসা রাখতে নিজের প্রথম ওভারের পঞ্চম বলে মিডউইকেটে রহমত শাহকে ২৪ রানে তামিমের ক্যাচ বানান এবারের বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক।

এরপরই রানের চাকা শ্লথ হয়ে পড়ে আফগানদের। তার উপর কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে ২১তম ওভারের পঞ্চম বলে হাসমতউল্লাহ শাহিদিকে (১১) স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন মুশফিক-মোসাদ্দেক জুটি।

অনেকটা ধুঁকতে ধুঁকতেই পরে কোনরকমে একশো পেরোয় আফগানিস্তান। উইকেট স্পিনবান্ধব হয়ে যাওয়ায় রান তুলতে ঘাম ছুটছিল দুই ব্যাটসম্যান গুলবাদিন নায়েব ও আসগর আফগানের। দরকারি রানরেট পারদের মতো চড়তে থাকায় আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলেন দুজনে।

ঠিক সেই মুহুর্তেই দ্বিতীয় স্পেলে সাকিবকে আবারও আক্রমণে আনেন মাশরাফী। ২৯তম ওভারে এক বলের ব্যবধানে গুলবাদিন ও মোহাম্মদ নবীকে সাজঘরের পথ দেখান সাকিব। প্রথম বলেই গুলবাদিনকে (৪৭) শর্ট কাভারে লিটন দাসের কাছে ক্যাচ দিতে বাধ্য করেন, এক বল বাদে রানের খাতা খোলার সুযোগ না দিয়ে বিপজ্জনক নবীকে করেন বোল্ড।

উইকেটের গন্ধ পেয়ে যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন সাকিব। তিন ওভার বাদে এবার তার আগুনে পুড়লেন আফগানদের অন্যতম ব্যাটিং ভরসা আসগর আফগান। ৩২তম ওভারের দ্বিতীয় বলে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে ২০ রানে বদলি ফিল্ডার সাব্বিরকে ক্যাচ দিয়ে বসেন সাবেক অধিনায়ক। এর দুই ওভার বাদে উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান ইকরাম আলি খিল লিটন দাসের থ্রোতে রানআউট হলে হার দেখতে থাকে আফগানরা।

সেখান থেকে সামিউল্লাহ সেনওয়ারি ও নাজিবউল্লাহ জাদরানের ৫৬ রানের জুটিতে অসম্ভব কিছু করারই স্বপ্ন দেখছিল আফগানিস্তান। বাধ্য হয়ে তাই এগিয়ে আসতে হল সাকিবকেই। আর্ম বলে নাজিবউল্লাহকে (২৩) বোকা বানিয়ে ফাঁদে ফেলেন স্টাম্পিংয়ের।

এই উইকেট দিয়েই আরেক কীর্তি গড়া হয়ে গেছে সাকিবের। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে গড়েছেন ৫ উইকেট নেয়ার মাইফলক। যুবরাজ সিংয়ের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ৫০ রান ও ৫ উইকেট নেয়ার কীর্তিও একই ম্যাচে!

কোটা শেষে সাকিবের বোলিংয়ের দিকে কেবল তাকিয়েই থাকতে হচ্ছে। পুরো ১০ ওভার বল করেছেন, উইকেট পেয়েছেন ৫টি। সেটিও আবার মাত্র ২৯ রানে! দ্বিতীয় স্পেলে আবার একটি মেডেনও আছে। ম্যাচ শেষে বাংলাদেশের কাছে না হেরে সাকিবের কাছে ম্যাচ হেরেছে আফগানরা, এমন বলটাও খুব একটা অনুচিত হবে না!

পরে দ্রুত রশিদ খান ও দৌলত জাদরানকে তুলে নেন মোস্তাফিজ। শেষ উইকেট হিসেবে সাইফউদ্দিনের বলে বোল্ড হন মুজিব-উর রহমান। ১৮ বল বাকি থাকতেই ৬১ রানে হেরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিশ্চিত হয় আফগানদের।

আগে দিনের শুরুতে টস জিতে মাশরাফীদের প্রথমে ব্যাটিংয়ে পাঠান আফগান অধিনায়ক গুলবাদিন। একাদশে পরিবর্তনের মতো ওপেনিংয়েও পরিবর্তন এনে লিটন দাস আর তামিম ইকবাল নামেন বাংলাদেশের হয়ে। কিন্তু পঞ্চম ওভারের মধ্যেই লিটনকে ঘরে ফিরতে হয়। ১৭ বলে ১৬ রান করে মুজিবের বলে ক্যাচ আউট হয়ে যান।

স্পিনার মুজিব-উর রহমানের বলে হাসমতউল্লাহ শাহিদিকে ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন লিটন। যদিও সেই ক্যাচ নিয়ে প্রশ্ন আছে।

মুজিবের বলে কাভারে ড্রাইভ খেলেছিলেন লিটন। শর্টকভারে দূরহ এক ক্যাচ নেন হাসমতউল্লাহ। ক্যাচ নিয়ে তিনি উদযাপন শুরু করলেও নিশ্চিত ছিলেন না দুই ইংলিশ আম্পায়ার মাইকেল গফ ও রিচার্ড কেটেলবরা। অনফিল্ড আম্পায়ারদ্বয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য রিভিউ চেয়ে বসেন। টিভিতে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে রিভিউতে ফিল্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখেন পাকিস্তানি আম্পায়ার আলিম দার। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে চরম বিতর্ক।

দলীয় ২৩ রানের মাথায় ধাঁধার ক্যাচে লিটন (১৬) ফেরার পর তামিম ইকবালের সঙ্গে ৫৯ রানের জুটি গড়েন সাকিব আল হাসান। ৫৩ বলে ৩৬ রান করে ফিরেছেন তামিম। মোহাম্মদ নবির বলে বোল্ড হন বাংলাদেশ ওপেনার। রান পেলেও পুরো বিশ্বকাপের মতো এই ম্যাচের শরীরের ভাষায় আস্থার অভাব দেখা গেছে।

আসরের শুরু থেকে দুর্দান্ত ছন্দে থাকা সাকিব আল হাসান এদিনও ছিলেন চেনারূপে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি বিশ্বরেকর্ড করে ফেলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার বিশ্বমঞ্চে ১০০০ রান পূর্ণ করেছেন।

১৮ জন ব্যাটসম্যান এই রেকর্ড করেছেন। টুর্নামেন্টে পঞ্চমবারের মতো ৫০’র বেশি রানের ইনিংসও খেলে ফেলেন সাকিব। যার মাধ্যমে আবারও আসরের সর্বোচ্চ রান স্কোরার তালিকায় অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নারকে ছাড়িয়ে যান।

শুরু থেকে বেশ ভালো সিঙ্গেলের উপর খেললেও ফিফটি তোলার পর অনেকটা আটকে যান সাকিব। একই অবস্থা হয় মুশফিকেরও। এই অবস্থায় বোলিংয়ে পরিবর্তন এনে মুজিবের হাতে বল তুলে দেন আফগান অধিনায়ক। আস্থার প্রতিদান দিতে একটুও সময় নেননি তিনি। ৩০তম ওভারের প্রথম বলে সাকিবকে এলবিডব্লিউর ফাঁদে ফেলেন মুজিব।

একবার রিভিউতে বেঁচে গেলেও এবার আর রিভিউ নেননি সাকিব। অপরপ্রান্তে থাকা মুশফিক রিভিউর কথা বললেও মাথা নেড়ে মানা করেন। ৬৯ বলে ৫১ রান করা সাকিবের ইনিংসে মাত্র একটি চারের মার।

সাত ম্যাচের ছয় ইনিংসে সাকিবের রান এখন ৪৭৬। দ্বিতীয়স্থানে থাকা ওয়ার্নারের রান সাত ছয় ইনিংসে ৪৪৭।

ওপেনিং থেকে পাঁচ নম্বরে নেমেও ফর্মের বদল আনতে পারেননি সৌম্য সরকার। তার আউটটা নিয়ে যদিও বিতর্ক হতে পারে। মুজিবের অফস্টাম্পের বাইরে পিচ করা বল লেগস্টাম্প দিয়ে প্রায় বেরই হয়ে যাচ্ছিল। কোনো রকমে স্পর্শ লাগে স্টাম্পে। রিভিউ নিয়ে রক্ষা পাননি সৌম্য (৩)। রিপ্লেতে দেখা যায় বলটি ব্যাটের খুব কাছেই গিয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল বল ব্যাটেই লেগেছে। কিন্তু আম্পায়ার আলট্রা এজ না দেখেই সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন।

ভারতের বিপক্ষে ১০ ওভারে ২৬ রানে এক উইকেট নেয়া মুজিব এদিন নেন ৪১ রানে তিন উইকেট। তার বোলিংয়ে এত বৈচিত্র ছিল যে, ধারাভাষ্য দিতে দিতেই টুইট করেন হার্সা ভোগলে। বলেন, মুজিব-উর রহমানের বোলিংটা দেখতে ভালোই লাগছে। কী ভেরিয়েশন!

টাইট বোলিংয়ে বাংলাদেশ চেপে ধরে আফগানিস্তান। একসময় টানা ১২ ওভারের বেশি কোনো বাউন্ডারি মারতে পারেনি বাংলাদেশ। অবশেষে ৭৩ বল পর ছক্কায় সেই গেরো কাটান মুশফিক। ওই ছক্কা দিয়ে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় আর ক্যারিয়ারের ৩৫তম হাফসেঞ্চুরির পূর্ণ করেন মিস্টার ডিপেন্ডেবল। শেষ পর্যন্ত এই হাফসেঞ্চুরিকে তিন অঙ্কে রূপ দিতে পারেননি। ৮৭ বলে চারটি চার ও এক ছক্কায় দলীয় সর্বোচ্চ ৮৩ রানে দৌলত জাদরানের শিকার হন মুশি।

ক্রিজে নামার পর থেকেই স্বাচ্ছন্দ্য মনে হয়নি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে। রান নেয়ার সময় খোঁড়াতে দেখা যায় তাকে। মাঠের ভেতর চিকিৎসাও নিতে হয়। তবু মনের জোর নিয়ে মুশফিকের সঙ্গে লড়ে যান তিনি। গুরুত্বপূর্ণ ৫৬ রানের জুটি গড়ে নিজে আউট হন ২৭ রানে। তার ৩৯ বলের ইনিংসে ছিল দুটি বাউন্ডারি।

এক ম্যাচ বাদে একাদশে ফিরে মন্দ করেননি মোসাদ্দেক। মুশফিককে সঙ্গ দেয়ার সঙ্গে নিজেও চালিয়ে খেলার চেষ্টা করেন। ২৪ বল খেলে চারটি চারের ৩৫ রান করে গুলবাদিনের বলে বোল্ড হন। আর দলের স্কোর দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ২৬২ রান। সেটাই হল জয়ের জন্য যথেষ্ট।

আফগানদের হয়ে মুজিব-উর রহমানের তিন উইকেটে সঙ্গে গুলবাদিন দুটি উইকেট নেন। এছাড়া একটি উইকেট নেন জাদরান ও নবি।