মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী যে পাকিস্তানের দোসর হিসেবে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী তার আরো এক জলজ্যান্ত প্রমাণ সাকার ফাঁসি কার্যকর না করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানিয়ে পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের চেয়ারম্যান ইমরান খান নিয়াজীর লেখা চিঠি।
সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান সেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজীর ভাতিজা, যিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
সাকাকে ফাঁসিতে না ঝুলাতে গত ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি পাঠিয়েছিলেন ইমরান খান।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাকা চৌধুরী তার পুরো রাজনৈতিক জীবনে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার পর, বিচার চলাকালীন এমনকি ফাঁসির আগেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য কম চেষ্টা করেননি। তবে তার সব চেষ্টাই আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ফাঁসির বিরুদ্ধে বারবার তীব্র নিন্দা ও শোক প্রকাশ, সাকার বিচারের সময় ভুয়া সাক্ষী দিয়ে তার পক্ষে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা, সবকিছুই সবসময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে তাদের বিপক্ষেই গেছে বলে ওই পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।
তারা বলছেন, পাকিস্তান তাদের বন্ধু বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টা করতে গিয়ে প্রতিবারই নতুন করে প্রমাণ করেছে সাকা-মুজাহিদরা সত্যিই যুদ্ধাপরাধী, যা আরেকবার বেরিয়ে এলো সরাসরি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাকার জন্য খোদ নিয়াজী ভাতিজার সাফাইয়ে।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’র চেয়ারম্যান হিসেবে লেখা ওই চিঠিতে ইমরান বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে তার দেশের এই বন্ধুকে বাঁচাতে চেয়েছেন। সাকাকে ফাঁসি না দেওয়ার পক্ষে তার দেওয়া সাফাই ছিলো ফাঁসি কার্যকর হলে আঞ্চলিক সম্প্রীতি নষ্ট হবে
চিঠিতে ইমরান খান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যুদ্ধাপরাধী নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখিয়ে লিখেছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা ছাড়া কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব না। সাকাকে ফাঁসি দিলে তা এই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি, সম্প্রীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে না বলে সতর্ক করেন তিনি।
ইমরানের চিঠিতে জাতিসংঘ যখন অজুহাত
ইমরান বলেন, যে কোনো সশস্ত্র সংঘাত শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মিটমাট করে নেওয়ার গুরুত্বের কথা জাতিসংঘের নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা আছে। জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে এ নীতিমালা মেনে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ এই দু’দেশকেই এ ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন থাকতে হবে।
ইসলাম, মহানবী (স.) ও ম্যান্ডেলার উদাহরণ টেনে সাকাকে ক্ষমার আহ্বান
ইমরান খান বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষই ইসলামের অনুসারী। মহানবী (স.) মক্কা জয়ের পর ইসলামের শত্রুদের সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
নেলসন ম্যান্ডেলার উদাহরণ টেনে ইমরান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সাউথ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলার গৃহীত পলিসি অব অ্যাপিসমেন্ট থেকেই বোঝা যায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষর সঙ্গে আপোস ও মিটমাটকে তিনি কতোটা গুরুত্ব দিতেন। বাংলাদেশেরও এ কারণে সাকাকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত।
সাকার যুদ্ধাপরাধী হওয়া অসম্ভব
চিঠিতে ইমরান খান গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন, সাকা চৌধুরী যে মুক্তিযুদ্ধের সময় পড়াশোনার জন্য পাকিস্তানের লাহোরে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলেন, পাকিস্তানে তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ে আসীন বহু সম্মানিত ব্যক্তিত্ব এর সাক্ষী। সুতরাং সাকার পক্ষে তখন যুদ্ধাপরাধে জড়িত হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না।
চিঠিতে সবশেষে আবারো ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি মওকুফ করে দেওয়ার আবেদন জানিয়ে বলেন, এটি শুধু এই অঞ্চলের বৃহৎ স্বার্থই নয়, বিশ্ব শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যও সহায়ক হবে।
ইমরান খান যেসব সাক্ষী-প্রমাণের কথা চিঠিতে বলেছেন তা বিচারকাজ চলার সময়ই বহুবার মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও বন্ধুকে বাঁচাতে নিরুপায় হয়েই ইমরান খান পুরনো সাফাই আবার গাইলেন বলে পর্যবেক্ষকরা মরে করছেন।
তারা বলেন, যুদ্ধাপরাধীরা যতোই বলুক তারা যুদ্ধাপরাধ করেনি, পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের এমন কোনো সম্পর্ক নেই, তাদের এবং পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডগুলোই বারবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তারা যুদ্ধাপরাধী এবং পাকিস্তান যে আঞ্চলিক সম্প্রীতির কথা বলে তারা নিজেরাই তাতে বিশ্বাস করে না। তারা এখনো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে, সাকা-মুজাহিদদের পক্ষে। এজন্যই তাদের নতুন প্রজন্ম একাত্তরকে চেনে না, আর পাকিস্তান বন্ধু বলতে চেনে বাংলাদেশের শত্রুদের।