চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

সাউথ কোরিয়ার একজন হাবিল ভাই

কেউ অসুস্থ, কারো ভিসা জটিলতা বা প্রশাসনিক সমস্যায় ছুটে যান হাবিল ভাই। প্রবাসী কোন বাংলাদেশি চাকরি হারিয়েছেন, ভরসা হাবিল ভাই। কোন অনুষ্ঠানে খাবার পরিবেশন করতে হবে, হাবিল ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট আছে না! দেশ থেকে কেউ কোরিয়ায় গেছেন, বিমানবন্দরে ছুটে যান হাবিল ভাই। নিজে ড্রাইভ করে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া এবং ফেরার সময় ১৪০ কিমি গতিতে ড্রাইভ করে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেয়া; সবকিছুই যেন হাবিল ভাইয়ের কাছে খুব সহজ। এই মানুষকে এমন সহযোগিতা করেই তিনি আনন্দ পান।

এভাবেই সাউথ কোরিয়ায় সবার প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছেন একজন হাবিল উদ্দীন। শুধু বাংলাদেশিদের কাছে নয়, সাউথ কোরিয়ানদের কাছেও হাবিল উদ্দীন পরিচিত নাম। বয়স প্রায় ৪৬ বছর। এখনো দেখতে যেন টগবগে তরুণ।

হাবিল উদ্দীন বাংলাদেশী, কোরিয়ার নাগরিক। প্রায় ২৭ বছর ধরে কোরিয়ায় বাস করছেন তিনি। ভালোবেসে বিয়ে করেছেন কোরিয়ান মেয়েকে। তাঁর ঘরে এখন ফুটফুটে তিন সন্তান। দুই ছেলে এক মেয়ে। সন্তানদের পড়ালেখার জন্য স্ত্রী সহ রাখছেন কানাডায়। প্রথম ছেলে গ্রেড ইলাভেন, সেকেন্ড ছেলে গ্রেড সেভেন এবং মেয়ে গ্রেড সিক্সে পড়ছে। বড় ছেলে আবার কানাডার আলবার্টা টিমের অনুর্ধ্ব-১৫ প্রো আইস হকি প্লেয়ার। ছোট ছেলে ও মেয়ে পড়ালেখার পাশাপাশি ফিগার স্কাটিং প্র্যাকটিস করছে কানাডায়।

হাবিল উদ্দীন যখন কোরিয়ায় যান বাংলা ব্যতিত আর কোন ভাষা জানতেন না। তিনি এখন কোরিয়ান, ইংরেজি এবং হিন্দিতে পারদর্শি। কানাডা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন সহ অনেকগুলো দেশে সফর করে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। ইচ্ছে হলেই পাড়ি জমান কোন না কোন দেশে। দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে হাবিল উদ্দীন মনের খোরাক যোগান। সঞ্চয় করেছেন অগাধ অভিজ্ঞতা। অথচ বাংলাদেশে হাবিল উদ্দীন মাত্র এসএসসি পাশ করেছিলেন। সেটি নব্বইয়ের দশকের কথা।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথমে হংকংয়ে যান হাবিল উদ্দীন। তখন দেশে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। দেশের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ছিলো। হংকং থেকে জনৈক বড় ভাইয়ের পরামর্শে তিনি কোরিয়ায় চলে যান। ভাষা জানা নেই, পরিবেশ অপরিচিত, পথঘাট অচেনা। কিন্তু তিনি কোরিয়ায় এলেন। কোরিয়ায় এসে একটি সেন্ট্রাল মসজিদ উঠেন ১৮ বছরের বালক হাবিল উদ্দীন। রাজধানী সিউলের সেন্ট্রাল মসজিদের ইমাম হাবিল উদ্দীনকে জনৈক কোরিয়ান মুসলিমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যিনি একটি গেস্ট হাউজের মালিক। তার গেস্ট হাউজে শুরু করেন কাজ। টুকটাক বডি ল্যাংগুয়েজে কথা বলেন। সপ্তাহ খানিক পর তিনি হাবিল উদ্দীনকে পড়ালেখার সুযোগ দেন। কোরিয়ার সগাং ইউনিভার্সিটিতে কোরিয়ান ভাষায় ভর্তি করিয়ে দেন। ভাষা শেখা আর গেস্ট হাউজে কাজ একত্রে চলতে থাকে। এভাবে চলে প্রায় ৩ বছর।

১৯৯৩ এর শেষের দিকে কোরিয়া থেকে যমুনা সেতু প্রজেক্টের কাজের অফার পেয়ে বাংলাদেশে আসেন হাবিল উদ্দীন। বাংলাদেশে যমুনা ব্রিজের হুন্দাই কোম্পানির প্রজেক্ট। এখানে ৫ বছর তিনি কাজ করেন। ৫ বছর আসা যাওয়ার মধ্যে থাকলেও প্রজেক্ট শেষ হলে আবারও কোরিয়ায় ফিরে যান। সেখানে ফিরে একটি হালাল শপ দেন। সেটি ১৯৯৮ সালে, নিজের প্রথম দোকান, তাজমহল হালাল শপ। এর আগে তিনি গেস্ট হাউজে কাজ করতেন সেখানে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাজমহল রেস্টুরেন্ট। সেসময় অনেক ভারতীয়, বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি লোকজন আসতো। তারা খাবারের জন্য ভীড় করতো। তাদের চাহিদার কথা ভেবেই গেস্ট হাউজের মালিককে বলে তাজমহল রেস্টুরেন্ট শুরু করেন হাবিল উদ্দীন। তিনি নিজে সার্বিক কাজ করে এগিয়ে দেন। তখন থেকে হাবিল উদ্দীনের মাথায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসার চিন্তা শুরু।

২০০০ সাল থেকে ইন্ডিয়ান খাবারের কনসালটেন্টিং শুরু করেন হাবিল উদ্দীন। বিভিন্ন কোম্পানির খাবারের কনসালন্টিং করেছেন তিনি। কোরিয়ান কোম্পানি এলজির পার্ট ‘আওয়ার হোম’ নামে একটি ফুড সেক্টরে কনসালন্টিং করেছেন। ইন্ডিয়া গেট রেস্টুরেন্টের ২০টি শাখার মধ্যে ৪টি এবং আগ্রা রেস্টুরেন্ট এর পার্টনার এবং কনসালন্টিং করেছেন। এভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান অনেক রেস্টুরেন্টের কনসালন্টিং করেছেন এবং এখনো করেন।
এভাবে ক্রমান্বয়ে তিনি গড়ে তোলেন নিজস্ব রেস্টুরেন্ট ব্যবসাও। নিজের ব্র্যান্ড ছিলো বোম্বে, থান, গেঞ্জিস এবং আলাদিন। এর মধ্যে গেঞ্জিস, আলাদিন আছে। এখন তার তিনটি ব্রাঞ্চ। আরেকটি চালু হবে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে।

সবগুলো রেস্টুরেন্টের নাম ইন্ডিয়ান হওয়ার যুক্তি দিলেন এভাবে “কোরিয়াতে বাংলাদেশ সেভাবে ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে পারেনি। আর ইন্ডিয়া নাম শুনলে সবাই আগ্রহী হয়। যার কারণে ইন্ডিয়ান নাম ব্যবহার করে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করা হয়। যদিও খাবারে থাকে বাঙালিয়ানার আবহ। সামনে বাংলাদেশের কোন বিখ্যাত স্থান বা ব্যক্তির নামে রেস্টুরেন্ট দেয়ার কথা ভাবছি। বাংলাদেশকে তুলে ধরাই লক্ষ্য“।

এভাবে একসময় চাকরি থেকে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেন হাবিল উদ্দীন। সেখান থেকে তিনি এখন কোরিয়া একজন সমাজকর্মী। বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন কোরিয়ার বর্তমান সভাপতি। কদিন আগে এই কমিটির দুবছর পূর্ণ করেছে। এই সংগঠনের দায়িত্ব নেয়ার পর হাবিল উদ্দীনের সুন্দর মনোভাব আরো সুন্দর হয়ে উঠে। সামাজিক কর্মে আরো বেশি মনোযোগ দেন। ক্রমে তার চিন্তার জগত বিস্তৃত হতে থাকে।


সামাজিক কাজে ঝুঁকে পড়ার কারণ বলছিলেন এভাবে, “আমি যখন প্রথম কোরিয়ায় আসি ভাষাগত সমস্যা পড়তাম খুব বেশি। ভাষাগত কারণে তিন মাস ভালোভাবে খেতে পারিনি। গেস্ট হাউজের মালিকের সাথে খেতে হতো কোরিয়ান খাবার। বের হলে মনের ভাষা প্রকাশ করতে পারতাম না। দূরে কোথাও গেলে ব্যাপক সমস্যায় পড়তাম। ব্যাংক কিংবা ডাক্তারের কাছে গেলে কোরিয়ানদের হেল্প নিতে হতো। তাতে পড়তো হতো নানা বিড়ম্বনায়। ভাষা না জানলে যা হয় আর কি। এখান থেকেই আমি কোরিয়ায় আগত বাঙালিদের সমস্যা বুঝতে পারি। দুয়েকজন ছাড়া ৯০ ভাগ মানুষেরই কষ্ট হয়। একারণে আমরা সহযোগিতায় এগিয়ে যাই। যেমন- কেউ মেডিকেলে যাবে ভাষাটা বুঝাতে পারছে না। তখন কোরিয়ান ভাষা জানে এমন কেউ হলে ভালো হয়। কোন চাকরির খোঁজে যাবে, মালিকের সাথে কথা বলতে পারছে না। তখন সহযোগিতা দরকার পড়ে। ভিসার সমস্যায় পড়ে, বিভিন্ন সেক্টরে আমরা সহযোগিতার চেষ্টা করি“।

বাংলাদেশী স্টুডেন্টের জন্য আপনি কি ভূমিকা রাখেন এমন প্রশ্নে হাবিল উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশি স্টুডেন্টরা যোগাযোগের সমস্যায় বেশি পড়ে। আমরা তাদের উৎসাহ দিয়ে থাকি। আমরা দেখি বিশ্বের দেশগুলো শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে গেছে। কোরিয়াও সে রকম। কোরিয়াতেও আমাদের মতো সমস্যা ছিলো। কিন্তু তারা পরিকল্পিত শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে গেছে। আমরা চাই যে, আমাদের দেশের শিক্ষার হার আরো বেশি বৃদ্ধি পাক। সে জন্য আমরা প্রমোট করি যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এখানে আসুক, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করুক। তার জন্য আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের খোঁজ-খবর দিয়ে থাকি। আমাদের কমিউনিটির পেজে স্কলারশিপের সংবাদ দেওয়ার চেষ্টা করি। আবার বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ইন কোরিয়ার সাথে আমরা সবসময় যোগাযোগ রাখি, সহযোগিতার চেষ্ঠা করি।

কোরিয়ায় বাংলাদেশকে আর কিভাবে তুলে ধরছেন এমন প্রশ্নে হাবিল উদ্দীন জানালেন, “আসলে আমি অন্য অনেক প্রবাসীর মত বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে রিপ্রেজন্ট করার চেষ্টা করি। দেশের সুনাম রক্ষার জন্য কাজ। কোরিয়ায় যারা বাংলাদেশি কর্মী আছে তাদেরকে সবসময় গাইডলাইন দিয়ে থাকি। আমরা এভাবে আমাদের দেশকে তুলে ধরছি। কোরিয়ানরা তো বাংলাদেশকে ফরেন ওয়ার্কার দিয়ে চিনে। কিন্তু এখানে আমাদের দেশ থেকে এসে পিএইচডি করছেন, মাস্টার্স, অনার্স করছেন অনেকে। ১ হাজার স্টুডেন্টস আছেন। তারা শিক্ষা নিচ্ছেন, গবেষণা করছেন। আমরা এদিক দিয়েও এগিয়ে যাচ্ছি।

বাংলাদেশ কোরিয়ার কাছ থেকে কি শিখতে পারে তার উত্তর দিলেন হাবিল উদ্দীন। জানালেন, এখানে যারা ওয়ার্কপারমিট নিয়ে আসেন, তারা অবশ্যই এখানকার প্রযুক্তিগত জ্ঞান শিখে নিবে। এটা বাংলাদেশের জন্য খুবই উপকারে আসবে। কোরিয়া ২০-৩০ বছর আগে গার্মেন্টেসে এক নাম্বার ছিলো। আমরা এখন গার্মেন্টসে দ্বিতীয় পজিশনে আছি। কোরিয়ায় এখন গার্মেন্টস সেক্টর নেই। তারা প্রযুক্তিগত পণ্য উৎপাদনে বিশ্বে খ্যাতি পেয়েছে। বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক সাইড, সফটওয়্যার, বিভিন্ন মোটর প্রোডাক্টে তারা এগিয়ে আছে। সেক্ষেত্রে আমরা আশা করি, এখানে যারা টেকনিক্যাল সাইটে আছেন, তারা আমাদের দেশে কাজে লাগাবেন। যারা গবেষক আছেন। তারা উন্নত গবেষণা করছেন। তারাও দেশে গিয়ে গবেষণায় কাজে লাগাবেন।

হাবিল উদ্দীন কোরিয়ায় তার ২৭ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলাদেশিদের জন্য মেসেজ দিলেন। বললেন, কোরিয়ায় যারা বসবাস করেন, সবার প্রতি আহ্বান করবো যে, আমাদের দেশের সুনাম রক্ষা করে কাজ করার জন্য। তারা যেন যার যার স্থান থেকে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করেন। যারা বিভিন্ন প্রযুক্তি কারখানায় কাজ করছেন, তারা যেন তা শিখে দেশে গিয়ে কাজে লাগান। স্টুডেন্টদের বলবো, তারা অবশ্যই ডিগ্রি নিয়ে দেশে যাবেন এবং যারা গবেষণা করছেন তারা দেশে গিয়ে গবেষণায় ভূমিকা রাখবেন। বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে গিয়ে অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। সরকারকেও যারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এবং দেশে যাওয়ার চিন্তা করছেন তাঁদেরকে সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। আহ্বান করবো, সরকার যেন কোরিয়ার সাথে সুসম্পর্ক তৈরী করে এখানে বেশি বেশি স্টুডেন্ট এবং কর্মী পাঠানোর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে।