টোকেন বা স্মারক চিহ্নে বাণিজ্য চলে আসছে ঐতিহাসিক আমল থেকে। স্মারক চিহ্নে হয়ে যায় কোটি টাকার বাণিজ্য। দেশের ভেতরেই যে শুধু এ ধরণের বাণিজ্য চলে তা নয়; দেশে দেশে এ ধরণের রেওয়াজ আছে। এ ধরণের লেনদেনের একটাই সুবিধা, কোড নম্বর সম্পর্কে সবাই অবগত নয়। ব্যাংকে যে ডিমান্ড ড্রাফট পাঠানো হতো, তার হিসাব বের করতে হতো কোড ব্যবহার করে। আর ডিজিটাল যুগে কোডিং এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে বিশ্বজয়ী সব প্রোগ্রাম। তবে চিরকুট ব্যবহার করে আবার ফেঁসে যাওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। অনেক সময় ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝে অস্বস্তি ও অবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় চিরকুট; ঘটে বিপত্তিও। তবে চিরকুটের অপব্যবহার রোধে সতর্ক হয়ে উঠেন, মার্কিন ধনকুবের মার্ক কিউবান। তৈরি করেন নতুন এক ধরণের অ্যাপ্লিকেশন। এটি হচ্ছে সাইবার ডাস্ট। বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশের ঝুঁকি রয়েছে। হ্যাকার এগুলো বের করে দিতে পারে। তবে সাইবার ডাস্ট এমন একটি অ্যাপ্লিকেশান যা এসব দুর্বলতা দূর করেছে। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী। এই অ্যাপসের মাধ্যমে বার্তা আদান প্রদান করা যায়, সার্ভার সংরক্ষণ করতে পারে না। বার্তাটি পড়ার অল্প পরেই, আপনা আপনি মুছে যাবে। আর ২৪ ঘন্টার মধ্যে না পড়লে নিরাকার হয়ে যায়। অ্যানড্রয়েড ফোনে এই বার্তার স্ক্রিন শট নেয়া যায় না। তবে আইফোনে এই বার্তার স্ক্রিণ শট নেয়া যায়, তবে স্ক্রিণ শট নিলে সাইবার ডাস্ট বার্তা প্রেরককে তা আবার জানিয়ে দেয়। এ থেকে কে বন্ধু চিনে নিতে পারবেন। মজার ব্যাপার হলো স্ক্রিণ শট বার্তা প্রেরকের আইডেন্টিকে ধারণ করতে পারে না। এটা পরানো দিনের চিরকুটের মত, পড়ার পড়ে ছিড়ে ফেলা। সাইবার ডাস্ট স্বয়ংক্রিয় ছিড়ে ফেলা ব্যবস্থা সম্বলিত। সাইবার ডাস্ট বৈধ অ্যাপ এবং নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম। তবে এটা অন্য অনেক অ্যাপের মতো ইউজার ফ্রেন্ডলি নয়। এর প্রাথমিক সেটিংস বেশ ঝামেলাযুক্ত।
মার্কিন বিনিয়োগকারী ও বাস্কেটবল টিম দ্য ডালাস মেভারিকসের সত্ত্বাধিকারী মার্ক কিউবানের মতে, যদি শেয়ার বাজারকে অনুসরণ না করেন তবে আপনি নাটকের কিছু অসাধারন দৃশ্য হারাবেন। তিনি নিজেও ধীরলয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের গতি প্রবাহ পর্যেবক্ষণ করেন। উদ্বুদ্ধ করেন তরুণদেরও। স্টার্ট আপ প্রতিষ্ঠান গড়ার অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন। তার মতে, ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজনই বিশ্ব সেরা স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠান। নতুন নতুন খাতে অ্যামাজনের বিনিয়োগ আগ্রহ আর প্রযুক্তি নিয়ে চালানো পরীক্ষার দিকে ইঙ্গিত করে তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন। আর এই মার্ক কিউবান মার্কিন মুল্লুকে জড়িয়ে পড়লেন ইনসাইড ট্রেডিং-এ। অভিযোগ জোরালো হলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্য পর্যালোচনা করে আদালত মার্ক কিউবানকে দোষী সাব্যস্ত করেনি।
তবে মামলা চলাকালে কিউবান চিন্তিত হয়ে পড়েন, তার ব্যবসার নীতি নিয়ে। মূলত গোপনে তথ্য ব্যবহার করে শেয়ারের দর কমিয়ে আনার অভিযোগ ছিলো। মামলায় ডালাস ম্যাভেরিক্সের মালিকের কাছ থেকে সাড়ে সাত লাখ ট্রেডিং লোন এড়াতে তথ্য অন্তর্ভূক্ত করা হয়। শেয়ারের মূল্য কমে যাওয়ার আগে কিউবান তার অভ্যন্তরীণ তথ্য ব্যবহার করে, ইন্টারনেট সার্চ কোম্পানিতে ডাম্প করেন। সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন কিউবানকে অর্থ প্রদান এবং দেওয়ানি জরিমানা দিতে বলে। এসইসি বললো, কিউবান এবং মম্মা ডটকমের সিইও এর মধ্যে একটি ফোন কল ও ক্ষুদে বার্তা আদান প্রদান হয়েছে। আর এতে গোপন তথ্য ভাগ করে নিয়েছিলেন। কোম্পানির নতুন স্টক অফার পরিকল্পনা করার সময়, কিউবান ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। কারণ অফার তার শেয়ারের মূল্য হ্রাস করবে। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের প্রফেসর জেমস কোক্স, পূর্বাভাস দিয়েছিলেন যে এসইসি জয়লাভ করবে এবং কিউবানকে পথে বসতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এরপরই নতুন অ্যাপ্লিকেশন তৈরির কাজ হাতে নেয় কিউবান।
ইনসাইড ট্রেডিং নিয়ে সবদেশেই কমবেশি আতঙ্ক আছে। সংখ্যালঘু শেয়ারের মালিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় শিল্পোন্নত দেশগুলোতে সংরক্ষণমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। থাকে আইনী পদক্ষেপ। স্বার্থ সুরক্ষায় থাকে বিধিমালা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ পিছিয়ে। তবে সব দেশের আইনেই তালিকাভুক্ত কোম্পানির পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্তরা শেয়ার কেনাবেচার অধিকার পেয়ে থাকে। তবে তা সাধারণের মতো নয়। মূল্যসংবেদনশীল তথ্য পাওয়ার যৌক্তিক সময় আগে থেকে শেয়ার কেনাবেচার পরিকল্পনা জমা দিতে হয়। না দিলে তা ইনসাইড ট্রেডিং এ অভিযুক্ত। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তদন্ত করে দেখতে পারে, শেয়ার কেনার আগে সংশ্লিষ্টরা মূল্য সংবেদনশীল তথ্য কতটুকু আচ করতে পেরেছিলো। যদি তথ্য উপাত্ত জেনে করে থাকে, তাহলে ইনসাইডার শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
মার্কিন মুল্লুকে ইনসাইড ট্রেডিং সবসময় আলোচিত। আইনী সুরক্ষার জন্যে আদালতে গড়ায় অনেক মামলা। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের দায়ে হেজ-ফান্ড ব্যবস্থাপক রাজ রাজারত্নমকে ১১ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেয়। দেশটির ইতিহাসে ইনসাইড ট্রেডিংয়ের এটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা। দেশটির ম্যানহাটন ফেডারেল কোর্টের বিচারক গ্যালিওন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীলঙ্কার বংশোদ্ভূত রাজারত্নমকে ওই দণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি এক কোটি ডলার জরিমানাও করেছেন। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামির অপরাধ ও অপরাধের ক্ষেত্র বাণিজ্যিক জগতে ভাইরাস ছড়িয়েছে। এর নির্মূল প্রয়োজন।
বিশ্বজুড়ে বলা হয়, কোম্পানির অভ্যন্তরীণ তথ্য-উপাত্তে প্রবেশাধিকার না থাকায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিবেদন প্রকাশের আগ মুহূর্তেও সেগুলো জানেন না। আসলে কি এমনটাই ঘটে? না কোন কোন সময় কোম্পানি বিশেষে এসব মূল্যসংবেদনশীল তথ্য কারো কাছে ধরা দেয়। তথ্যের নেপথ্য কারিগররা খেলতে নামে। আর এতে ধরাশায়ী হয়ে পড়েন সাধারণ বিনিয়োগকারী। কীভাবে তা রুখতে হবে? সে নিয়ে চলছে গবেষণা। সব শেয়ারবাজারেই বড় অপরাধ ইনসাইড ট্রেডিং। অভ্যন্তরীণ তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ভাগ্য গড়েছেন অনেকে। এখানে উদ্যোক্তা,পরিচালক,কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেমন আছেন, তেমনি কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও ইনসাইডারদের দোসর। তাদের প্রত্যেকেই বিনিয়োগকারীদের ঠকায়। তবে আইনীভাবে নিজ কোম্পানির শেয়ার কেনা যায়। এজন্য ইনসাইডারদের নিজ কোম্পানিতে বিনিয়োগের একটি পরিকল্পনাপত্র জমা দিতে হয়। যেখানে বলা থাকে, এই সময়ের মধ্যে আমি এ পরিমাণ শেয়ার কিনব বা বিক্রি করব। হালে এখানেই ইনসাইডারদের রক্ষাকবচটা। তবে অপব্যবহার করে ইনসাইডারদের অসৎ উদ্দেশ্য পূরণের রাস্তা বন্ধ করা যায়নি।
হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক লরেন কোহেন তার গবেষণায় দেখান, শেয়ারবাজারে ইনসাইডারদের রুটিন লেনদেনের চেয়ে সুযোগসন্ধানী লেনদেনে রিটার্ন অনেক বেশি। তবে প্রায় সব কোম্পানির মূল্যসংবেদনশীল তথ্যই আগে থেকে গুজব আকারে বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে শেয়ারের দাম বাড়ানো কিংবা তথ্য গোপন করে বা ইনসাইড ট্রেডিংয়ের ক্ষেত্রে আইনগত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুঁজিবাজারে যারা এ ধরনের কাজ যারা করে, গুজব ছড়ায়- তাদের চিহ্নিত করা কঠিন। তবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
ধসের পর বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু সংস্কার আনা হলেও সুবিধাভোগী লেনদেন বা ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে কঠোর আইন না থাকায় আস্থার সংকট কাটেনি। কোম্পানির ভেতরের লোকেরাই পুঁজিবাজারের অনিয়ম সবচেয়ে বেশি করেন। কারণ তারা আগে থেকেই তথ্যগুলো জানেন। এই ইনসাইডারদের তথ্যের ভিত্তিতে শেয়ারবাজারে অনেক অনিয়ম হয়। এ বিষয়ে আইন থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বল; বর্তমান বিধি অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির বার্ষিক হিসাব শেষ হওয়ার দু’ মাস আগে থেকে শুরু করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে ওই হিসাব চূড়ান্তভাবে বিবেচিত, গৃহীত বা অনুমোদিত হওয়া পর্যন্ত উদ্যোক্তা, পরিচালক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী, নিরীক্ষক বা নিরীক্ষাকার্যে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, পরামর্শক বা আইন উপদেষ্টা, কিংবা বেনিফিশিয়াল ওনার সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ার ক্রয়, বিক্রয় কিংবা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তরের সুযোগ নেই। ইনসাইডার ট্রেডিং বন্ধে সর্বশেষ সংশোধিত এই বিধি জারি হয় ২০১০ সালের মার্চ মাসে। এরপর ওই বছরের ডিসেম্বর ও পরের বছর জানুয়ারিতে শেয়ারবাজারে নামে বড় ধস।
গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের প্রভাবিত করা, শেয়ারের দর অতিমূল্যায়িত দেখানো ও ইনসাইড ট্রেডিং ওই ধসের পেছনে বড় ভুমিকা রাখে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)