যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভে হামলা করতে গিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই’র হাতে গ্রেফতার হওয়া রিজওয়ানুল আহসান নাফিসের কথা মনে আছে? ‘আন্ডারকভার অপারেশন’ বা ‘স্টিং অপারেশন’ নামে পরিচিত ‘ছদ্মবেশী’ বা ‘ফাঁদ পাতা’র মতো প্রতারণামূলক পদ্ধতিতে এফবিআই তাকে গ্রেফতার করেছিলো। ফেডারেল রিজার্ভে হামলার জন্য তাকে ভূয়া বিস্ফোরক, মুঠোফোন ইত্যাদি ছিলো তাদেরই দেয়া। এর আগে আল-কায়েদার লোক সেজে তার সঙ্গে যাবতীয় তথ্য আদান-প্রদান ইত্যাদি কার্য সেরেছিলো এফবিআই।
এছাড়া তারা আমিনি আল খালিফি নামে মরক্কোর এক নাগরিককে ঠিক একই কায়দায় ওয়াশিংটন ডিসিতে গ্রেফতার করে। ২৯ বছর বয়সী ওই মুসলমান যুবককে তারা নকল আত্মঘাতী বিস্ফোরকসহ জামা (সুইসাইড ভেস্ট) ও অকেজো আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করেছিল। পরিকল্পনা ছিলো, ওই জামা পরে খালিফি নির্বিচারে গুলি চালিয়ে লোকজনকে হত্যা করবেন।
তার আগে ২০০৯ সালে নিউইয়র্কের রিভারডেল এলাকায় দুটি সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়) বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করার দায়ে চারজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান যুবককে গ্রেফতার করা হয়। তাদেরও হামলার পরিকল্পনায় সহযোগিতা করা, অর্থ ও নকল বিস্ফোরক জোগান দিয়েছিল এফবিআই।
এসব ঘটনার মামলায় একজন বিচারক এফবিআইয়ের এই কর্মপদ্ধতিকে ‘ক্রিয়েটিং টেরোরিজম’ বা সন্ত্রাসবাদ তৈরি করা হিসেবে বর্ণনা করে এর সমালোচনা করেছিলেন।
গুলশানের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায়ও আমরা দেখেছি, ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ নামের ওয়েবসাইট জিম্মি অবস্থায় রেস্তোরার ভেতরের নিহত ২০ জনের ছবি প্রকাশ করেছে। এখন প্রশ্নের বিষয় হলো- তারা এগুলো কীভাবে পেয়েছে? তারা বলছে – হামলাকারীরা আইএস এর কাছে সেই ছবি পাঠানোর পর আইএস এগুলো প্রকাশ করেছে, সেখান থেকে তারা তাদের সাইটে এগুলো প্রকাশ করেছে।
আর অপারেশন থান্ডারবোল্টের পরেও দেখা গেছে, ২০ জন জিম্মিকে সন্ত্রাসীরা খুন করেছে। এখান থেকে একটা বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, সরকার যতোই বলুক দেশে আইএস নাই, এই হামলা কিন্তু আইএস’ই করেছে!
শুরু থেকেই তথাকথিত আইএস এর নামে বাংলাদেশ বিরোধী আক্রমণের সব খবর প্রকাশ করছে ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’। যদিও এটা বাংলাদেশের সরকার কিংবা সাধারণ মানুষ কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। এখন আবারো বলছি- এমনও হতে পারে যে, ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ কর্তৃপক্ষই হয়তো এফবিআই’র মতো আইএস এর নামে ছদ্মরুপি কেউ, যারা আইএস এর নামে বাংলাদেশে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে মদদ দিচ্ছে। এফবিআই তাদের দেশে ‘স্টিং অপারেশন’ এর মাধ্যমে নকল আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরক দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হয়তো ধরে ফেলেন, কিন্তু অন্য দেশকে সাইজ করতে, বা আইএস এর সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে নিজেদের সেনা পাঠিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিতে তারা যে আসল আগ্নেয়াস্ত্র বা বিস্ফোরক তুলে দেন না তার নিশ্চয়তা কী?
এছাড়া আইএস এর বরাতে সাইট ইন্টেলিজেন্সে প্রকাশিত ছবির সঙ্গে মিলে যাওয়া ফেসবুক আইডিগুলোর প্রোফাইল ঘাঁটলে দেখা যায়, এরা সবাই ‘উচ্চ শিক্ষিত’ ও তথাকথিত ধনী পরিবারের সন্তান। এদের প্রায় প্রত্যেকের আইডিতে সবশেষ স্ট্যাটাস ছিলো এ বছরের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারির দিকের। কয়েকজন খেলাধুলা ভালোবাসতো, ছিলো ফুটবল খেলা ও ট্রফি জেতার সেই ছবিও। একজন তো বলিউডের এক নায়িকার হাত ধরতে পেরে ছিলো আনন্দে আত্মহারা।
কিন্তু এই ছেলেদের প্রোফাইল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৫ সালের শেষের দিকে এসে কেমন যেন বদলে গেছে ছেলেগুলো। অপারেশন থান্ডারবোল্টে নিহত ‘নিব্রাস ইসলাম’ নামের একজনের আইডিতে দেখা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গুলশান-২ এর হোটেল ওয়েস্টিনসহ বেশ কয়েকটি নামী-দামী রেষ্টুরেন্টে ‘বন্ধু, স্বজনের ছবিসহ’ চেকইন দিয়েছে। এমনও হতে পারে, তখন থেকেই এ হামলার পরিকল্পনা, আর এজন্যই গুলশান-২ এর বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে যাওয়া।
ফেসবুকের সঙ্গে সরকারের একটা আপোষরফা হয়েছে যে, সরকার চাইলে তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন মানুষের আইডি’র যাবতীয় তথ্য দেবে। এর আগেও তারা তথ্য দিয়েছে। তাই এতো বড় একটা সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশ সরকার যদি সত্যিকার অর্থে ধর্মের নামে করা সন্ত্রাসের শেকড় উপড়ে ফেলতে চায়, তবে অপারেশন থান্ডারবোল্টে নিহত এই সন্ত্রাসীদের আইডিগুলোর লগইন অ্যাকসেস চাইতে পারে। আমার বিশ্বাস, ফেসবুকে তাদের মেসেজ অপশন দেখতে পারলে কারা তাদেরকে এই পথে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে, কারা এই হামলার মূল হোতা, ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ হলি আর্টিসান রেস্তোরার ভেতরের বিভৎস ছবি কোথায় পেলো, আইএসের নামে এদেশকে কারা অস্থিতিশীল করে দখল করতে চায় ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে। এছাড়া ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স’ যদি এর সঙ্গে জড়িত না হয়, তবে সেটাও প্রমাণিত হয়ে যাবে।
অবশ্য এর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ও ব্রুকলিন থেকে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ব্যবহৃত হচ্ছে এমন সন্দেহে ড্রাগ ডিলারের দুটি আইফোনের লক খোলার জন্য অ্যাপলকে অনুরোধ করেছিল মার্কিন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এফবিআই। অনেক কাঠ, খড় পুড়িয়ে তারা আইফোনের লক খুলেছিলো।
সবশেষ কথা হলো- ২০ থেকে ২৫ বছরের যে যুবকদের এখন জীবনকে ভালোবাসার সময়, মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য তৈরি হওয়ার সময়, সেই যুবকরা কেনো অন্যের ফাঁদে পড়ে মানুষ খুনের নেশায় বুঁদ হচ্ছে, সেটা এখন দায়িত্বশীলদের নতুন করে ভাবতে হবে। এই ফাঁদে অন্তত: বাংলাদেশের আর কোনো যুবক যাতে পা না দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে, নিজের পরিবারকে, আমাদের সবাইকে।
নিজের ছেলে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, পড়ালেখা বা অন্য কোনো কারণে বিদেশে যাওয়ার পর তার কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দেয়া ইত্যাদি বিষয় পরিবারকেই নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয়ে তথ্য পেলে তবেই তাকে নজরদারিতে রেখে, কিংবা যথাযোগ্য কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আর না হয় সেতো শেষ হবেই, সঙ্গে পরিবার, আর এই রাষ্ট্রকে নরক যন্ত্রণায় বিষিয়ে দিয়ে যাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)