প্রতিটি সাংবাদিকের আঘাতে আমি ব্যথা পাই। অন্তর পুড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে নানা অজুহাতে সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। রক্তাক্ত করা হয়েছে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে। অথচ কোন মহল থেকেই তেমন জোরালো কোন প্রতিবাদ আমরা দেখতে পাইনি।
সাংবাদিকদের অধিকার আদায়, মর্যাদা রক্ষার নামে প্রতিষ্ঠিত প্রায় সবগুলো সাংবাদিক সংগঠন। বিটওয়ারী সংগঠন তো আছেই, সেই সাথে আছে রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং প্রেসক্লাব।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তো বটেই সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত করছেন খোদ মিডিয়া হাউজগুলোও। অনেক প্রতিষ্ঠানে যখন তখন কর্মী ছাঁটাই, বিলম্বিত বেতন প্রদান, বকেয়া বেতন না দিয়েই চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। কখনো দলীয় তকমা দিয়ে, কখনো চাঁদাবাজ তকমা দিয়ে বারবার লাঞ্ছিত করা হচ্ছে সাংবাদিকদের। এসব ঘটনায় সহজে অনুমেয় যে সাংবাদিকরা তাদের কাঙ্খিত মর্যাদা পাচ্ছেন না। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে কয়েকটি বিষয় তার মধ্যে চাঁদাবাজি, ব্লাকমেইলিং, দলীয় পক্ষপাতিত্ব উল্লেখযোগ্য।
আমি মনে করি, সাংবাদিকদের ঐক্য নেই বলেই এমনটি অহরহ ঘটছে। একতাই বল’ গল্পের মতো প্রত্যেকজন আলাদা আলাদা চিন্তা করার কারণে এই সুযোগটি নিচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং খোদ অনেক মিডিয়া মালিকও। এদের বিরুদ্ধে যারাই মাথা তুলছে সেই সব মাথাকে গুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
সাংবাদিকতা তার স্বকীয়তা হারাতে বসেছে। এখন পুঁজিবাদের লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত হয়েছে সংবাদ কর্মীরা। যদি পুঁজিপতিদের কথা না শোনেন তাহলে মুহূর্তেই চাকরি নেই। এবারের জাতীয় নির্বাচনে লাঠিয়াল বাহিনী হওয়ার চরম প্রমাণ দিয়েছে বহুল প্রচারিত একটি দৈনিক ও একটি ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম।
অন্যদিকে সাংবাদিক নিয়োগে নীতিমালা না থাকায় এসএসসি পাশ থেকে শুরু করে যে কেউই এখন সাংবাদিক হতে পারেন। ফলে সাংবাদিকের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এবং নেতাদের আপোষকামী স্বভাব নিয়েও।
আমরা দেখছি সাংবাদিক সংগঠনগুলোতে ঐক্য নেই। সাংবাদিকদের উপর আঘাত আসছে অথচ নেতারা চুপ! সংগঠনগুলোতে যেসব সাংবাদিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের নীরবতার কারণে সাধারণ সাংবাদিকদের বেশি বেশি লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছেন সাধারণ সাংবাদিকেরা। বিশেষ করে তরুণ সাংবাদিকরা, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিপোর্টিং করেন তারা।
আরো বিপদে পড়ে নিবন্ধনহীন অনলাইনে কাজ করা সাংবাদিকেরা। কখনো কখনো পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানও তাদের অস্বীকার করেন। তখন সাংবাদিকরা হয়ে পড়েন না ঘরকা, না ঘাটকা।
অথচ সাংবাদিকতা একটি মহৎ পেশা। জাতির বিবেক, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। দেশের উন্নয়নে গঠনমূলক সমালোচনাই সাংবাদিকের প্রথম ও প্রধান কাজ। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যায়, অনাচার, অসঙ্গতির চিত্র যেমন তুলে আনেন সাংবাদিকেরা, তেমনি অপার সম্ভাবনা আর সাহসিকতার গল্পও লেখেন তারাই। কখনও বেদনার কাব্য গাঁথেন, কখনা রচনা করেন মিলনের মহাকাব্য।
সাংবাদিকদের কর্মঘণ্টার বাধাঁধরা নিয়ম নেই। কাগজে কলমে লিখিত থাকলেও একজন প্রকৃত সাংবাদিককে তটস্থ থাকতে হয় ২৪ ঘণ্টাই। সংবাদ এবং সাংবাদিকতাকে ঘিরেই চিন্তামগ্ন থাকতে হয়। একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য, সঠিক তথ্য সংগ্রহের জন্য কখনো কখনো অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘদিন।
এছাড়া, সামাজিক রীতি-রেওয়াজে অংশ নেয়াও অনেক সময় কঠিন হয় সাংবাদিকদের জন্য। ঈদ-পূজা-পার্বণেও সময় দিতে হয় গণমাধ্যমকর্মীদের। তাদের এই ত্যাগ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। জলে-জঙ্গলে বেড়াতে হয় কেবল একটি সংবাদ সংগ্রহের জন্য। কখনো খেয়ে, কখনো না খেয়ে অপেক্ষা করতে হয় একটি সংবাদের জন্য।
এই যে এতো এতো কষ্টের মধ্য দিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেন সংবাদকর্মীরা তার সব সংবাদ কি প্রকাশিত হয়? হয় না। অনেক প্রতিবেদন কখনোই ছাপা হয় না, কখনো পুঁজিবাদের চাপে, কখনো আবার বিজ্ঞাপনদাতাদের হুমকিতে।
কোন কোন নামধারী গণমাধ্যম নতুন ট্রেন্ড চালু করেছে। আইডি কার্ড বাণিজ্য। তারা একটি গ্যারেজে কিংবা ছোট একটি রুমে শুরু করেছে লাইসেন্সবিহীন গণমাধ্যম পরিচালনার কাজ। জেলায়-উপজেলায় লোক নিয়োগ দিচ্ছেন অর্থের বিনিময়ে, এছাড়া সংগঠনের মানবসেবার ব্যানারেও সেইসব প্রতিনিধির কাছ থেকে নিচ্ছেন সহায়তা (চাঁদা অর্থে)। এসব কারণেই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন প্রকৃত সাংবাদিকেরা।
আবার কোন কোন কথিত গণমাধ্যম সংবাদ সংগ্রহই করছে ব্লাকমেইল করার জন্য-এমন উক্তিকেও অস্বীকার করার উপায় নেই। বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত অভিভাবক সাংবাদিকদের দ্বারা যৌন নিপীড়ণ, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারী সংবাদকর্মীরা-এমন অভিযোগও প্রায় নিয়মিতই শুনতে হয়। শুনতে অভিভাবকতুল্য সাংবাদিকদের অশ্লীল খিস্তিখেউরও।
সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমে একসাথে ১৮ কর্মী ছাঁটাই একটি বড় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। সেই গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন সোচ্চার এবং প্রতিবাদে আন্দোলনে নামলে মালিক তাদের সাথে একটি সমঝোতা চুক্তি করেন। সেই চুক্তি ভঙ্গ করে সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার মালিকপক্ষ।
এর কারণ হিসেবে শোনা যায়, সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের সাথে মালিকপক্ষের গোপন আঁতাত। শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, সাংবাদিক নেতাদের বিরুদ্ধে রেটকার্ড বাণিজ্য, চাকরি পাইয়ে দেয়া কিংবা চাকরিতে সুবিধা প্রদানের নাম করে নারী কেলেংকারী, প্লট বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে কল্যাণফান্ডের টাকা প্রদানসহ বহু অভিযোগ ইদানিংকালে বেশি শোনা যায়। যা সত্তর কিংবা আশির দশকে শোনা যায়নি।
সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে পচন ধরেছে- এটা এখন বলাই বাহুল্য। মেধাবী এবং প্রকৃত সাংবাদিকদের নেতৃত্বদানে অনীহাকে আমার উপযুক্ত কারণ মনে হয়। নেতার সবচেয়ে বড় গুণ হবে ব্যক্তিস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে সামষ্টিক স্বার্থের জন্য কাজ করা। সাংবাকিতার উতকর্ষ সাধন, ব্যপ্তি বাড়ানো, মেধাবীদের সম্মান, যেখানে অন্যায়-অনিয়ম-অনাচার সেখানে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা। পুঁজিবাদের অনৈতিক-অবৈধ আব্দারকে তুড়ি মেরে ছুড়ে ফেলতে বাধ্য করা। এজন্য একতাবদ্ধতা কোনো বিকল্প নেই।
সাংবাদিকতায় দলীয় কোন পরিচয় থাকা মোটেই উচিত নয়। ব্যক্তি এবং পেশাগত দুটি ভিন্ন বিষয়কে পৃথক পৃথকভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ থাকবেই-তা যেন কোনভাবেই পেশাকে প্রভাবিত না করে সেদিকে খেয়াল রাখাও সাংবাদিকতার একটি মূলনীতি।
সেই সাথে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, যেসব গণমাধ্যমের মালিক তার প্রতিষ্ঠান চালাতে পারছেন না অজুহাত দেখিয়ে কর্মচারী ছাঁটাইয়ে ব্যস্ত, তাদের উপর নজরদারি বাড়ানো। প্রয়োজনে তাদের লাইসেন্স জব্দ করা এখন সময়ের দাবি। অনলাইন টিভি এবং নিউজ পোর্টালগুলোকে দ্রুত নিবন্ধনের আওতায় আনাও জরুরী। সেই সাথে প্রয়োজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ইউটিউব চ্যানেলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো।
বেতনে অনিয়ম এবং নিয়োগে অনিয়মও দুর করা জরুরী। সাংবাদিক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিবন্ধনের নীতি চালু করা যেতে পারে। প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ কিংবা প্রেস কাউন্সিল এ নিবন্ধনের কাজটি করতে পারে। যেভাবে ডাক্তার এবং আইনজীবীদের নিবন্ধিত হতে হয়, ওই একই নিয়ম সাংবাদিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। শিক্ষাগত যোগ্যতা সেন্টারে কমপক্ষে স্নাতক, জেলা-উপজেলার ক্ষেত্রে একটু শিথিল করে এইচএসসি পাশ করা যেতে পারে। তাহলে একটা বেসিক কাঠামো পাবে সাংবাদিকতা।
আর এসব চাহিদা পূরণে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। ঐক্যবদ্ধ হলেই কেবল এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব। একতাবদ্ধ সাংবাদিক সমাজকে কোন শ্রেণি-পেশার মানুষের পক্ষে আঘাত করা অসম্ভব। তাহলেই পেশার মর্যাদা রক্ষা হবে। এজন্য প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব, ত্যাগী নেতার। যিনি নিজের খেয়ে বোনের মোষ তাড়াবেন পেশার বৃহত্তর স্বার্থে। সাংবাদিকতা তার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে পাক, মর্যাদা ফিরে পাক পেশাজীবীরা। সকল লাঞ্ছনা-বঞ্চনার অবসান ঘটুক, দিক নির্দেশক এবং জাতির সত্যিকার বিবেক হয়ে উঠুক সাংবাদিকরা। আমি সেদিন এবং সেই নেতার অপেক্ষায়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)