একজন দারিদ্র্যপীড়িত ভূমিপুত্র মরে পড়ে আছেন খোলা প্রান্তরে। মরদেহটি ময়নাতদন্তের পর ঢেকে রাখারও প্রয়োজন মনে করেনি পুলিশ কর্তৃপক্ষ। মাঠে ফেলে দিয়ে চলে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, মরদেহটি খোলা পড়ে আছে। একটা স্থানীয় সাঁওতাল পুরুষ পাওয়া যাচ্ছে না, যিনি সৎকার করবেন। পুলিশের ভয়ে পুরো গ্রাম পুরুষশূন্য। লাশের সামনে নারীরা আহাজারি করছেন। কিন্তু তাদের অসহায় কান্নার রোল কারও কানে বাজছে না! বাজবে কীভাবে? ওরা যে সামান্য সাঁওতাল! ওরা তো দেশের মানুষ নয়, বড় জোর সংখ্যালঘু! ওদের ব্যথায় কান্না করার মতো লোক কোথায়? পুলিশ-প্রশাসন-সরকার তো সংখ্যাগুরুর শাসক। আর এদেশের মধ্যবিত্তরা আপাতত ব্যস্ত হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে! মার্কিন নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন হেরে গেছেন। এখন সেখানকার সংলঘুদের কী হবে, বহুত্ববাদী সমাজের কী হবে-সেই দুশ্চিন্তায় সবার ঘুম হারাম!
আমেরিকা নিয়ে আমাদের মাতামাতির শেষ নেই। কিন্তু দেশের মধ্যে সংঘটিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিপীড়িত হওয়ার খবর, ‘বহুত্ববাদ’ ও মানবতাকে পদদলিত করার খবর আমাদের চোখে পড়ে না। গত ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জের সাঁওতাল-অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামে যে নারকীয় ঘটনা ঘটে গেল তার খবর আমরা কজন রেখেছি? সেখানে রাষ্ট্রীয় পুলিশ ও স্থানীয় মাস্তান বাহিনী সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর উপর হামলা চালায়। বিনা উস্কানিতে নিরস্ত্র সাঁওতালদের উপর গুলি বর্ষণ করে। এতে অনেকে হতাহত হন। আহতদের মধ্যে শ্যামল হেম্ব্রম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। পরবর্তীকালে ৮ই নভেম্বর পুলিশ আরও একটি লাশ (মঙ্গল মার্ডি) সুগারমিলের পার্শ্ববর্তী গ্রামে ফেলে রেখে যায়।
মূলত জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরেই এই রক্তক্ষয়ী হামলার ঘটনা ঘটেছে। পাকিস্তান আমলে এই অঞ্চলের প্রায় ২৮,০০ একর জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছিল। সেখানে আখের খামার তৈরির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন ও পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয় ১৯৬২ সালের ৭ জুলাই। চুক্তির ৪ নং শর্তে বলা হয়েছে, ‘যে উদ্দেশ্যে এ জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাছাড়া অন্য কোনও কাজে এ সম্পত্তি ব্যবহার করা যাবে না। যে উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে হলে আগে প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করতে হবে, যেন সরকার জমি মুক্ত করে ফেরত দিতে পারে।’
২০০৪ সালে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে লোকসানে থাকা রংপুর চিনিকলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ২০০৬ সালে মিলটি আবার চালু হলেও সেখানে আখ চাষের পাশাপাশি অন্য ফসল আবাদের জন্য স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে ইজারা দেয় চিনিকল কর্তৃপক্ষ। এতে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ তোলেন স্থানীয় বাঙালি ও সাঁওতালরা। পরে জমির মালিকানা দাবি করে আন্দোলনে নামেন তারা। গত জুনে ওই জমিতে ঘর তৈরি করে বসবাস শুরু করেন।
সুগার মিলটি চালু না থাকার কারণে স্থানীয় এমপি ও মিলের ম্যানেজার অবৈধভাবে বর্গা দিয়ে ভোগদখল করতে থাকেন। কিন্তু স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিরা চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ফেরত দাবি করলে মিলের ম্যানেজার ও স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই গত ৬ নভেম্বরের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ। মূলত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্যদের গায়ের জোরে উচ্ছেদ করতেই পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালানো হয়।
ওই গ্রামে শুধু হামলাই হয়নি, ২০০৬ সাল থেকে গড়ে ওঠা প্রায় আড়াই হাজার ঘর পুড়িয়েও দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, এই হামলায় পুলিশ ও সুগার মিলের ম্যানেজার আব্দুল আউয়ালের সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বুলবুল ও তার মাস্তান বাহিনী মিলের শ্রমিকদের নাম ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে নিরস্ত্র মানুষগুলোর উপর হামলা চালিয়ে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এলাকার সন্ত্রাসী ও পুলিশি পাহারায় সাঁওতালদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার ভিডিও থাকার পরও পুলিশ বলছে, পুলিশের উপস্থিতিতে কিছু হয়নি, অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়েছে (সূত্র-বাংলাট্রিবিউন)।
গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক বলেছেন, সেখানে কোনো অভিযান চালানো হয়নি। তাই যদি না হয়, তাহলে গুলি চালাল কে? কয়েকজন মানুষের মৃত্যুর ঘটনাই বা ঘটল কীভাবে? যেখানে আদিবাসীরা বসতি স্থাপন করেছেন, সেখানে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, লুটপাটের মতো ঘটনা কীভাবে ঘটল, সে প্রশ্নের জবাব কে দেবে? এটাও তো দিবালোকের মতো স্বচ্ছ যে, দেশের প্রচলিত আইন মেনে ওখানকার ‘অভিযান’ পরিচালনা করা হয়নি। এছাড়া অভিযানে ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম ছাড়া পুলিশ গুলি চালাতে পারে না। কিন্তু সেখানে কয়েক রাউন্ড গুলি চালানো হলে দু’জন ব্যক্তি নিহত হন। এ সময় আহত হয়েছেন আরও বেশ কয়েকজন। এই ঘটনা কীভবে ঘটল? কার নির্দেশে ঘটল? পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় এমপি এই ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।
নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার সময়ও দেখো গেছে, প্রশাসন বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেছে। গোবিন্দগঞ্জেও একই চিত্র। ন্যায়ের পক্ষে না দাঁড়িয়ে প্রশাসন সব সময় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় দুর্বৃত্তদের পক্ষ নিয়ে দুর্বলদের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালন করছে। এর জন্য কী তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হবে না?
এটা খুবই দুঃখজনক যে, যাদের বলা হয় ‘ভূমিপুত্র’, তাদেরই আজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে হত্যা করা হচ্ছে। জীবনকে বিপন্ন করে তোলা হচ্ছে। কোথায় রাষ্ট্র, কোথায় প্রশাসন? আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, তিনি জনগণের সেবা করতে চান। অন্যায় করে কেউ রেহাই পাবে না। কিন্তু কোথায় প্রধানমন্ত্রীর এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন? সাঁওতালদের গুলি করে মেরে, তাদের উচ্ছেদ করে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে, হামলা-মামলা করে, তাদের অনাহারের মুখে ঠেলে দিয়েছে যারা, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? ২৫০০ আদিবাসী সাঁওতাল পরিবারের আশ্রয়ের ব্যবস্থা না করে শক্তি প্রয়োগ করে তাদের উচ্ছেদ করাটা কোন ধরনের ‘ন্যায়ের শাসন’?
ভাবতে অবাক লাগে, যারা যুগে যুগে ভূমির রক্ষায় বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে, আজ তাদেরই ভিটেয় ঘুঘু চড়ানোর দায়িত্ব আমরা পালন করছি। ব্রিটিশ বিরোধী তেভাগার লড়াইয়ে তারাই ফসল রক্ষা করতেই স্লোগান তুলেছিলেন, ‘জান দেব, তবু ধান দেব না’। অত্যাচারী শাসক ও তাদের দোসর জমিদারের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিলো, সেই ভূ-রক্ষক আদিবাসী সাঁওতালদেরই আজ আমরা ভূমিহীন করতে চলেছি! এই কী কোনো মানবিক সমাজের দৃষ্টান্ত?
আদিবাসীদের কাছে ভূমিই জীবন ও অস্তিত্বের প্রতীক। আদিবাসীরা চিরকাল ভূমি, বন ও প্রকৃতিকে জীবনের অংশ হিসেবে দেখেছেন, কোনোদিন বেচাকেনার বিষয় হিসেবে দেখেননি। এ কারণে আদিবাসীরা নিজস্ব ভূমিকে দলিলভুক্ত করেননি। কারণ ভূমি বা মাটি হলো মায়ের মতো। তাই মা’কে কি কেনাবেচা করা যায়? এটি হলো আদিবাসী ওয়ার্ল্ডভিউ। এখানেই আদিবাসীদের ভূমি মালিকানার সংস্কৃতির সঙ্গে আধুনিক আইনি ব্যবস্থার সংঘাত। ফলে আদিবাসীরা তাদের জীবনের মূল অবলম্বন ভূমি হারিয়েছেন। প্রভাবশালী ভূমিগ্রাসী চক্র আদিবাসীদের জমিজমা কেড়ে নিয়েছে। জাল দলিল দেখিয়ে, হুমকি দিয়ে, আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে সর্বস্বান্ত করেছে আদিবাসীদের। আর দশের সরকার, যাদের রক্ষা করার কথা আদিবাসীদের অধিকার, তারা সব সময় শক্তিমানদের সহায়তা করেছে প্রত্যক্ষ, অথবা পরোক্ষভাবে।
যারা প্রজন্ম-প্রজন্মান্তর ধরে কর্মঠ, শক্তিশালী, উদ্দাম, সেই সাঁওতাল সম্প্রদায়ও আজ আমাদের লোভের কাছে, দম্ভের কাছে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরের কাছে কত অসহায়! আমাদের কারো কাজই যেন অপরের চোখের জলের কারণ না হয়-দেশের মানুষের কাছে, সরকারের কাছে আমরা এই বিবেকবোধটুকুও কি আশা করতে পারি না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)