কোনো পক্ষে না দাঁড়িয়ে এটুকু অন্ততঃ বলা যায়, বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী উচ্চ আদালতের প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। রাষ্ট্রের সবচেয়ে সংবেদনশীল এই অঙ্গ এবং ভিত্তি নিয়ে কথা বলা অনুচিত কারণ রাষ্ট্রে এরকম প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে যাকে পছন্দ হোক বা না হোক রাখতে হবে সব বিতর্কের উর্ধে।
তবে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তার ব্যক্তিগত কারণকে কেন্দ্র করে যে প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন তার সমাধান করে সর্বোচ্চ আদালতকে সবসময়ের জন্য সমালোচনার বাইরে রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত পূরণ হতে পারে। সেটা শামসুদ্দিন চৌধুরীর জন্য আপাতঃ সমাধান হলেও বিচার বিভাগের জন্য হতে পারে স্থায়ী এক সমাধান।
প্রথমে দেখা যাক প্রসঙ্গের শুরু কিভাবে।
প্রধান বিচারপতির পক্ষে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে পাঠানো সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের চিঠি, বিচারপতি চৌধুরীর উত্তর, রেজিস্ট্রার জেনারেলের জবাব, বিচারপতি চৌধুরীর প্রতিউত্তর এবং সর্বশেষ রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধান বিচারপতির অভিসংশন চেয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর চিঠি বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়:
১. বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী আগামী ১ অক্টোবর অবসরে যাবেন। তার শেষ কর্মদিবস ১৭ সেপ্টেম্বর কারণ পরদিন থেকে অবকাশে যাবেন উচ্চ আদালত।
২. প্রধান বিচারপতিকে তার পেনশন কার্যক্রম বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসকে নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধ জানালে প্রধান বিচারপতির নির্দেশে রেজিষ্ট্রার জেনারেলের সইয়ে গত ২৫ আগস্ট তাকে অবহিত করা হয় যে, সকল পেন্ডিং রায় না লেখা পর্যন্ত তার পেনশন কার্যক্রম গ্রহণ করা যাবে না।
৩. উত্তরে গত ১ সেপ্টেম্বর দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, অতীতে অবসরে যাওয়া সকল বিচারপতি অবসরে যাওয়ার অনেক পরেও রায় লিখেছেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ অনেক বিচারপতির অনেক রায়ের কথা তিনি উল্লেখ করেন যেখানে এমনকি দুই বছর পরও পূর্ণাঙ্গ রায় এসেছে। তিনি বলেন, বর্তমান প্রধান বিচারপতির কাছেও অনেক রায় লেখা অপেক্ষমান আছে। তাই শুধুমাত্র একজনকে অবসরে যাওয়ার আগে রায় লিখতে বলা বৈষম্যমূলক বলে জানান তিনি।
৪. প্রধান বিচারপতি রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে গত ২ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরীকে তার পেনশন বিষয়ক কার্যক্রম শুরু করার কথা জানান এবং অবসরে যাওয়ার আগে যেসব মামলার রায় লেখা সম্ভব হবে না সেসব মামলার নথি সংশ্লিষ্ট দফতরে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ জানান। একইসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী হিসেবে মামলার রায় না লিখেই বিদেশে চলে যেতে পারেন মর্মে সংশয় প্রকাশ করেন।
৫. জবাবে গত ৮ সেপ্টেম্বর তিনি প্রধান বিচারপতিকে জানান, এর আগে অবসরে যাওয়া কোনো বিচারপতিকেই নথি ফেরত দেওয়ার জন্য কখনোই বলা হয়নি। ওইদিনই আপিল বিভাগের বেঞ্চ গঠন সংক্রান্ত যে তালিকা প্রকাশ হয় এবং তাতে দেখা যায় যে তার নাম বিচারিক কার্যক্রমে নেই।
৬. রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো চিঠিসহ প্রায় সবগুলো চিঠিতেই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী তার ওপর বিরাগের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। সঙ্গে বলেছেন, অনুরাগ এবং বিরাগের উর্ধ্বে থেকে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়।
পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায় শত শত শব্দের চিঠি, পাল্টা চিঠি, উত্তর, প্রতি উত্তরে একটি বিষয় স্পষ্ট: সেটা হলো অপেক্ষমান রায়।
বর্তমান বিতর্কের ফল যাই হোক, সর্বোচ্চ আদালতের অনেক মামলার রায় অপেক্ষমান থাকা নিয়ে শুধু সংশ্লিষ্ট বাদী-বিবাদীই নন; পুরো দেশেরই আগ্রহ, উৎসাহ এবং উৎকণ্ঠা থাকে। কিন্তু চূড়ান্ত রায় পেতে সময় লাগে মূলতঃ তিন কারণে:
১. পনেরো কোটি মানুষের দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেঞ্চের সংখ্যা অনেক কম থাকায় বিচার প্রক্রিয়াতেই দীর্ঘ সময় লাগে।
২. প্রয়োজনের তুলনায় বিচারক সংখ্যা অনেক কম থাকায় শুনানি শেষে মূল রায় পেতে সময় লাগে।
৩. একই কারণে ‘শর্ট অর্ডার’ হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ রায় লিখতেও বিচারকদের অনেক সময় প্রয়োজন হয়।
তবে মূল রায় হওয়ার পর পূর্ণাঙ্গ রায় দিতে কতো সময় লাগবে বা একজন বিচারক কতো সময় নেবেন তার কোনো সময়সীমা নেই। সেটা একদিনও হতে পারে, এক বছরও লাগতে পারে, এমনকি তারও অনেক বেশি।
মূলতঃ বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে কেন্দ্র করে যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে সেটা এই পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়ার সময়সীমা বিষয়ে। যদি পূর্ণাঙ্গ রায় দেওয়ার সময়সীমা থাকতো তাহলে প্রধান বিচারপতিকে রেজিস্ট্রার জেনারেলের মাধ্যমে কোনো বিচারপতির উদ্দেশে:
১. অবসরের আগে সব রায় লিখে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিতে হতো না।
২. কেউ রায় না লিখেই বিদেশে চলে যেতে পারে বলেও শংকা প্রকাশ করতে হতো না।
তাই অনেকেই মনে করেন, মূল রায়ের পর পূর্ণাঙ্গ রায়ের জন্য আপিল বিভাগ নিজেরাই একটা সময়সীমা ঠিক করে নিতে পারেন। রায়ের সময়সীমা নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গেছে, তাকে মাথায় রেখে সর্বোচ্চ আদালত কি এমন কোনো নির্দেশনায় যাবেন?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের
নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে
প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)