একবার দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর চ্যানেল আইয়ের জয়েন্ট এডিটর প্রণব সাহা অনেকটাই দমে যান। হৃদযন্ত্র বেঁকে বসবে ভেবে মাথায় খুব বেশি চাপ নেবেন না স্থির করেন। তরলে অ্যালকোহল আর ধূমপানে তামাককে চিরতরে না বলে দেন। এতে অনেকটাই ছন্দপতন ঘটে যায়। পাল্টে যান প্রণব সাহা। সতীর্থরা একসময়ের তুখোড় বাউণ্ডুলের এমন জীবনবাদী হয়ে ওঠা দেখে গুলিয়ে ফেলেন অনেক কিছু। ভুল হচ্ছে কি কোথাও? প্রণব সাহা সংসারে মনোযোগী না হলেও সন্তানে মনোযোগী হন অনেকটাই। তার স্বপ্ন গিয়ে ঠেকে সন্তানের মধ্যে। উত্তরসূরির জন্য তাকে ভালো থাকতে হবে। অসুস্থ হওয়া চলবে না। চায়ে চিনির সুখ আর নেয়া যাবে না। সুমিষ্ট জীবনের সুখ হয়তো অন্যখানে। তাই জীবনকে পুরোপুরি ঢেলে দিলেন নিবিড় কর্মের আনন্দযজ্ঞে।
চ্যানেল আই এর শুরু। ৬২/এ সিদ্ধেশ্বরীর চারতলায় নতুন টেলিভিশনের সংবাদকক্ষে নতুন নতুন সংবাদকর্মীর সামনে প্রণব দা ক্লান্তিহীন এক সংবাদ ব্যবস্থাপক। যার কোনোকিছুতে না নেই। একহাতে ইন্টারন্যাশনাল নিউজ, আরেক হাতে সারাদেশ সবই সামলাচ্ছেন। রিপোর্টারদের স্ক্রিপ্টের ভাষার ডাল ছেঁটে সরলিকরণ করে দিচ্ছেন। আকস্মিক বড় ঘটনায় মাথাকে শীতল রেখে দশহাতে সব গুছিয়ে সংবাদ তৈরি করে তা পরিবেশনার টেবিলে পাঠানোর বিস্ময়কর যাদু প্রণব সাহা দিনের পর দিন দেখিয়ে চললেন।
সিদ্ধেশ্বরী থেকে ৪০ শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সরনী তেজগাঁওয়ে এসে চ্যানেল আই শুধু টেলিভিশন স্ক্রিনে নয়, অফিসের চাকচিক্য আর কর্মপরিবেশের সুবিধায় অনন্য হয়ে উঠলো। কর্মঘরও কর্মীদের নতুন স্বপ্নে উদ্ভাসিত করে, এটি বড় স্বাভাবিক। প্রণব সাহা সিদ্ধেশ্বরীর সীমিত কর্মপরিবেশ থেকে বিশাল সংবাদকক্ষের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় হিসেবে বসলেন, কিন্তু সংবাদকর্মীর যে নির্মোহ কর্মপাগল উপলব্ধি সেখান থেকে একচুলও সরলেন না। বয়স বাড়ছে, সময় পাল্টে যাচ্ছে, তরুণ রিপোর্টাররা সব চিন্তা-ভাবনা বিষয়বুদ্ধিতে গুছিয়ে উঠছেন, কিন্তু প্রণব সাহা একই রকম থাকছেন।
অফিসে যেদিন শেষ এসেছেন, সেদিনও এই একই রকম থাকার ব্যাপারটি পুরোপুরিই ছিল। নিয়ম মেনে দুই বেলা রুটি, চিনি ছাড়া চা আর শত রকমের নিষেধ মেনেও শরীরটা বেঁকে বসার পর জীবন থেকে ছুটি নেয়ার একটি খসড়া যেন মনের ভেতর তৈরি করে নেন প্রণব সাহা। বারবার হসপিটালে যেতে যেতে সুস্থতা, অসুস্থতা কিংবা একেবারে বিদায় নেবার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে তার কাছে যেন কোনো ফারাক ছিল না আর। আমার সঙ্গে অন্যরকম এক সম্পর্ক ছিল। মাঝে মাঝেই তিনি তার কক্ষে ডাকতেন। আমি নিজেও গিয়ে বসতাম। আবার ইন্টারকম ২০৬ এ ফোন দিয়েও কয়েক মিনিট প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় কথা বলতাম। অবাক হতাম, কোনো এক বিষয়ের গভীর জায়গা থেকে তিনি অতি সহজ আলোচনা শুরু করতেন। আমার জন্য ওই আলোচনায় হঠাৎ ঢুকে পড়া হতো কঠিন। তারপরও চালিয়ে যাওয়া যেত এই কারণে যে, তার কাছে প্রত্যেকেরই ছিল পুরোপুরি জড়তাহীন আর সাবলীল থাকার সুযোগ। প্রণব দার সঙ্গে যেকোনো আলোচনাই করা যায়- এই নিশ্চয়তা অামাদের অনেকেরই ছিল। বয়সের ব্যবধান যাই হোক, কারো কারো সঙ্গে তার সহজ বাতচিতে বিষয়, শব্দপ্রয়োগ কিংবা উচ্চকণ্ঠের কোনো সীমানা ছিল না। আড্ডা জমানোর কারিগর ছিলেন তিনি, সহনক্ষমতা এমনই ছিল যে, তার সহ্যসীমা পেরিয়ে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটতো না। মাঝে মাঝে মনে হতো অনেক বেশি কথা না বলে, শোর চিৎকার না করে, সত্য মিথ্যার চাপা না পিটিয়ে এমন আড্ডারু উপাধি দাদা কীভাবে পেলেন? আসলে দাদা ছিলেন দারুণ শ্রোতা আর ভাবলেশহীনভাবে আসল কথা বলার মানুষ। যে কথাটি আমরা হয়তো বলি টেবিল চাপড়ে, দাদা বলতেন একেবারে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায়।
টানা দুই বছর জীবন মৃত্যুর রশি টানাটানি চলেছে। কখনও রোদের ঝলকানির মতো শরীরটা পুরোপুরি সুস্থ মনে হয়েছে। কখনো আবার ছুটতে হয়েছে হসপিটালে। সকালে ঠিকঠাক মতো অফিসে ছিলেন, বিকেলেই শোনা গেছে প্রণব দা হসপিটালে। দুদিন বাদেই সব ঝুঁকিকে পানি করে দিয়ে আবার অফিসে। এভাবেই চলতে চলতে কয়েক মাস আগে কিডনি ডায়ালাসিস শুরু হওয়ার পর প্রণব দার মুখে নতুন তারুণ্যের হাসি ফুটে যায়। যদিও তার এই বেঁচে থাকাটা ছিল বেশ ব্যয়বহুল। মাসে নব্বই হাজার টাকা। এর বিনিময়ে তিনি জীবনের সহজ সমীকরণগুলো কষতে পারছিলেন। বেঁচে থাকার সৌন্দর্য উপলব্ধি করছিলেন। প্রয়াত বাবার কথা মনে এনে গর্বে বুক ভরছিল তার। মায়ের সামনে অবুঝ সন্তানের মতো দাঁড়িয়ে নিজের যত শিক্ষা পারদর্শিতাকে তুচ্ছ করে দেখার সুযোগ ঘটছিল। সত্যিই, এই সময়গুলো ছিল বড় বেশি দামী।
একদিন প্রণব দার কাছে বসে প্রথমবারের মতো শুনেছিলাম তার জীবনের গল্পের সামান্য অংশ। ‘বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের কর্মকর্তা। জমিদার বাবার সুশিক্ষিত স্মার্ট ও দাপুটে সন্তান। মানিকগঞ্জে তাদের অঢেল সহায় সম্পত্তি। ‘বাবা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মানিকগঞ্জ সদর থানা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি।’
স্কুল জীবন থেকেই প্রণব দার সম্পৃক্তি ছিল বাকশাল নেতৃত্বাধীন জাতীয় ছাত্রলীগের সঙ্গে। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দুইবার দেখা হয়। এসব গর্ব তিনি নীরবে উপলব্ধি করেছেন। কখনও কারো সামনে নিজের গুরুত্ব জাহিরের চেষ্টা করেননি। বরাবরই নিজেকে করে রাখেন অন্তর্মুখী। নিজের কাজের জায়গাকে সাবলীল রাখার জন্য কখনও নিজের স্বার্থে বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করেননি। কাজ করতে গিয়ে সময় মাপেন নি। কাজের জন্য পরিবারের সর্বোচ্চ ত্যাগ তিনি আদায় করে নিয়েছেন। পারিবারিকভাবে ব্রাহ্মণ; সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারী হলেও ধর্ম তাকে কখনো শ্রেনিবিদ্বেষ, হিংসা, আত্মঅংহকার ও জাতপাতের হীনমন্যতার মধ্যে ফেলতে পারেনি। সচেতন সজ্ঞানতা দিয়ে তিনি ধর্মের উদার ও মানবিক শিক্ষাটি লালন করেছেন। আর ভেতরে ভেতরে সবসময় হয়ে উঠেছেন উদারনৈতিক ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। বিবেচনাবোধ প্রখর হওয়ার পরও মানুষের মতকে একবাক্যে মেনে নেয়ার সহজ চর্চা তার সবসময় ছিল।
প্রনব সাহা ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন শাস্ত্রে মাস্টার্স করেন। ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর তিনি ছাত্রলীগ
ছেড়ে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন মতিউর রহমান সম্পাদিত সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার মাধ্যমে গণ মানুষের পক্ষে সচেতন রাজনৈতিক সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি ঘটে। মূলত তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরুটা এখানেই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরো সময়টিই সাপ্তাহিক একতার সঙ্গে যুক্ত থাকেন। বিশ্ববিদল্যায় জীবন শেষ করে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকেই বেছে নেয়ার মনস্থির করেন। তখনকার রুচিশীল, সাহসী ও বড় বিনিয়োগের সংবাদ প্রতিষ্ঠান বাংলার বাণীতে যোগ দেন সাব এডিটর হিসেবে। তুখোড়, করিৎকর্মা ও বৈষয়িক টানাপোড়েনহীন, মুক্ত স্বাধীন মানুষটির কাজের অভাব ছিল না। অভাব ছিলনা টাকারও। বাংলার বাণী-তে কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে যুক্ত হন সংবাদকক্ষের অতিথি সাব এডিটর হিসেবে। প্রতিদিন একশ টাকা বেতন। টগবগে তারুণ্য, রুচিশীল চিন্তা আর পকেট ভর্তি টাকা। তখন সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিটি সন্ধ্যা, প্রতিটি রাত হয়ে উঠতো জমজমাট। কর্মব্যস্ত দিন শেষে নিজেকে যেন নতুন করে ফরম্যাট করার অদ্ভুত সময়। তরল আগুন মেখে ঘরে ফেরার সময় প্রতিদিনই তার মনে হয়েছে ‘জীবন তুমি বড় সুন্দর’। বাংলার বাণী-তে প্রণব দা ছিলেন দীর্ঘ আঠারো বছর।
২০০১ সালে এলেন চ্যানেল আই-তে। নতুন টেলিভিশন। নতুন সংবাদ। শাহ আলমগীর, সাইফুল আমিন আর প্রনব সাহা এই তিন জায়ান্ট সাংবাদিককেই সংবাদকক্ষের নেতা বানালেন চ্যানেল আই এর পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ। তখন তিনিও দশহাতে টেলিভিশনের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সামলাচ্ছেন। প্রণব সাহা বরাবরই সংবাদ বিভাগের নীরব কর্মী। তার কাজের কোনো আওয়াজ পাওয়া যায় না। দিনের পর দিন রাতের পর রাত নিউজ এডিটিং, মিটিং, এডিট প্যানেলগুলোকে গড়ে নেয়া, হেড অব নিউজের নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে অণুসরণ করছেন। তখন তাদের সেই সময়টি অনেক দামী। এদেশে টেলিভিশন সাংবাদিকতা কেবলই একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছে। গড়ে উঠছে আপন কাঠামো নিয়ে। এর পেছনের নায়কদের একজন হয়ে রইলেন প্রণব সাহা।
ঘুরে ফিরে প্রণব সাহা এসে পড়েন তার ব্যক্তিচেতনা ও কর্মবহুল সময়ে। অদ্ভুত এক মানুষ ছিলেন তিনি। সংবাদকক্ষের পাহাড় সমান চাপে অন্যদের যখন চোখ বড় বড়, কণ্ঠ বাজখাঁই, প্রণব দা তখন সাবলীল। অধীনস্তরা দুয়েকটি রিপোর্ট করে দুনিয়া উদ্ধারের গর্ব, ব্যস্ততা শেষের চাঞ্চল্যে অস্থির, প্রণব দা তখন দশগুণ কাজ করে মাথার চাপকে অদৃশ্য করে হাসিমুখে দিব্যি চলছেন। একারণে অনেক সময় অনেকের রাগও ধরে যেত। যেন কোনোকিছুতেই প্রভাবিত হচ্ছেন না তিনি, মাতছেন না। তাহলে কি তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত? মোটেই নয়, বলা ভালো নির্মোহ। সংবাদের সত্য আর সাহসের ভেতর সবসময় জাগ্রত রাখতেন নিজেকে। কিন্তু গণমাধ্যমের শক্তি আর উজ্জ্বলতা কোনোদিন নিজের গায়ে লাগতে দেননি। পোশাদার সাংবাদিকের পৃথক এক ভাষা থাকে, পৃথক এক জোড়া চোখ থাকে; একই সঙ্গে মানুষকে মেপে নেয়ার আলাদা এক নিক্তি থাকে। এই কথা বারবার শুধু প্রণব দাকে দেখেই মনে হতো।
তিনি যে যুগে সাংবাদিকতাকে জীবনের নেশা আর পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন, সেসময় সাংবাদিক কখনো বৈষয়িক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন না। চিরকাল সাহসী আর স্বাধীন থাকার এক বাসনা নিয়েই মাড়াতে ইচ্ছে হতো এই পথ। প্রণব দাও তেমনটিই চেয়েছিলেন। একবিংশ শতক এসে সাংবাদিকতাও যখন চকচকে কর্পোরেট পেশা হয়ে উঠলো তখন হয়তো তারা ভাবছিলেন, সাংবাদিকতা বুঝি বিদায় নিল এইবার। হয়তো কিছুটা বিদায় নিয়েছে কিংবা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। প্রণব দা মাঝে মাঝেই বলতেন, সাংবাদিকতা কি আর আছে? আজকালকার তরুণরা তো সাংবাদিকতা করে না, চাকরি করে। অপরাধ নিয়ে তার মুখের দিকে তাকাতাম। ভাবতাম, প্রণব দা আপনাদের সাংবাদিকতার সূচনা সময়টি টিকে থাকলে, অনেক কিছুই বাণিজ্যের দৌড়ে ভেসে যেত না। তবে হ্যাঁ, আপনাদের চিন্তা আর কাজের ভেতর দিয়ে সেই সময়ের মহত্ব অনেকটাই টিকে আছে। তার মানে আপনারা আছেন বলে, এখনও সাংবাদিকতা দাঁড়িয়ে আছে।
বছর দুয়েক আগে ল্যাব এইডে প্রণব দার জীবন বড় সঙ্গীন হয়ে উঠলো। ডাক্তার বুঝিয়ে দিলেন তাদের তেমন আর হাত নেই। প্রণব দাকে হারানোর প্রস্তুতি যেন নিয়ে ফেললাম আমরা। বৌদির টানা মাস খানেকের ঘুমহীন অশ্রুসজল পান্ডুর মুখাবয়ব দেখে খুব খারাপ লাগতো। হঠাৎই একদিন প্রণবদা বিনা নোটিশে অফিসে এসে হাজির। গায়ে সাদাটে শাল, মুখে হাসি; বেশ ধীর স্থির। অনেকেই ভীড় জমালো দাদাকে দেখে। সেলফি তোলার হিড়িক পড়লো। কেউ কেউ বুঝতেই দিলাম না তার অসুস্থতার খবর জানি। তিনি অফিসে নিয়মিত হলেন। আমরা তাকে বিশ্রামে থাকার কথা বলতাম, তিনি বলতেন, আরো কিছুদিন কাজ করতে চাই। অন্তত দুই বছর।
দাদা বলতেন, কোনো এক ছুটির দিন সারাদিনের জন্য বাসায় চলে আসেন। গত বারো বছর ধরে বলছেন। বছর খানেক আগে এক সন্ধ্যায় যেতে পেরেছিলাম। সেদিন শ্রেষ্ঠ উপহার মনে হয়েছিল কাকিমার (দাদার মা) সঙ্গে পরিচিত হতে পারাটা। বুঝলাম, হাস্যোজ্জ্বল, লাজুক কাকিমার উপস্থিতিই দাদার সবচেয়ে বড় সুশ্রুষা। দাদা আলমারি থেকে বের করে আনলেন তাদের দাম্পত্য জীবনের শুরুর দিককার একটি ছবি। বললেন, সময় করে একদিন আসেন। অনেক গল্প করা যাবে। আমি বরাবরেই মতোই বলেছি, আসবো। এই ‘সময় করে একদিন আসেন’ যেন দাদার সঙ্গে দেখা হলে এক ‘কমন’ কথায় পরিণত হলো। আমি বলি, আসবো দাদা আসবো। মাস দেড়েক আগে আবার প্রণব দা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় চলে গেলেন। খবর পেয়ে খুব সকালে বসের (চ্যানেল আই এর পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ) সঙ্গে হসপিটালে গেলাম। ডাক্তারদের অনুরোধ করে বস আইসিইউ পর্যন্ত গেলেন। কলকব্জা লাগানো দেহে ঘুমন্ত প্রণব দা, নিঃশ্বাস চলছে জোরে জোরে। খুবই অনিশ্চয়তা নিয়ে ফিরলাম। বৌদির সেই নির্ঘুম ক্লান্ত মুখখানা দেখে আবারো খারাপ লাগলো।
৫ জুন বিকেলে হঠাৎ এক রিং। প্রণব দা ফোন করেছেন। ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে মাথাটা যেন একবার ঝাড়া দিয়ে নিলাম। ঠিক দেখছি তো। দুনিয়ার কৌতুহল নিয়ে ফোন ধরলাম। দাদা, কেমন আছেন? দাদা বললেন, ‘বাসায় আছি। একসময় আসেন।’ স্রেফ এটুকুই। এবার আর ঝরঝরে সুস্থ মানুষের মতো নয়, দাদার কণ্ঠ অনেকটাই জড়ানো। বোঝা গেল, জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার ডাক্তারি চাপে জর্জরিত দাদা। বললাম, দাদা ভালো থাকেন। আসবো, অবশ্যই আসবো। ফোন ছেড়ে, অনেকক্ষণ নীরব হয়েই থাকতে হলো।
৭ তারিখ সকাল ছয়টায় দাদা চলে গেলেন সব ব্যস্ততা, তাগিদ, বেঁচে থাকার ইচ্ছে আর জীবনকে ভালোবাসার সব সূত্রগুলো সঙ্গে নিয়ে। খবর পেয়ে ছুটে গেলাম প্রণব দার সেগুনবাগিচার বাসায়, যেখানে একদিন সময় করে যাওয়ার কথা ছিল। মনে হচ্ছিল, দুই বছর আগেই দাদা চলে যাওয়ার এক শিডিউল সাজিয়ে রেখেছিলেন মাথায়। কোন এক দূরভাষে সে তথ্য নিশ্চিত হয়েই জানিয়েছিলেন আমাদের। জীবন-মৃত্যু নিয়ে তার শেষোক্ত কাজটিও যেন অন্য এক ‘সাংবাদিকতা’। এ তো আধ্যাত্মিক ব্যাপার। প্রণব দা, আপনার গভীর উপলব্ধি, বিশ্বাস আর চেতনার দরজায় হয়তো কড়াই নাড়তে পারিনি আমরা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)