তিনি কোনো সাম্রাজ্যের সম্রাট নন। তবুও তিনি সম্রাট। হাজার থেকে লাখো মানুষের কাছে সম্রাট নামেই পরিচিত। তবে তার প্রকৃত নাম তাইজুল ইসলাম। আর্থিক অনটনে ৩৬ বছর আগে পুরনো বই বিক্রি করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ক্যাম্পাসে এসেছিলেন। তবে ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি, আজও চলছে সম্রাটের সেই অন্তহীন সংগ্রাম।
পুরনো বইয়ের দোকানি তাইজুল ইসলাম। ১৯৮৩ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের পুরনো প্রয়োজনীয় বইয়ের যোগান দিয়ে আসছেন। নিজে বই পড়েন এবং এলাকার শিশুদেরও পড়ান। তবে এক সময় তারও ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করে বড় চাকরি করার। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। কোনো রকম টেনেটুনে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। সপ্তম শ্রেণিতে যাওয়ার আগেই শুরু হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাই পড়ালেখা আর বেশি দূর গড়ায়নি তার। তারপরও দমে যাননি, এখনও আছে বইয়ের সাথে। পুরনো বই নিয়ে প্রতিনিয়তই চলে তার পড়াশোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটা বিভাগের বইয়ের নামই প্রায় তার মুখস্থ।
সকাল আটটা বাজলেই প্রতিদিনের মতো রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করেই চলে আসেন ক্যাম্পাসে। ভ্যানে করে পুরনো বই নিয়ে হাজির হন সময়মতো। একচালা ঘরে থরে থরে সাজিয়ে বিক্রি করছেন পুরনো বই। আবার দুপুর আড়াইটা বাজলেই বই গুছিয়ে তোলেন ভ্যানে। গন্তব্য নিজ বাড়ি। কোনো রকম একচালার ভিতরে বই গুছিয়ে বিক্রি করেন তিনি। এভাবেই ৩৬ বছর ধরে পুরনো বই বিক্রি করে আসছেন তাইজুল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইটি পুরনো বইয়ের দোকান আছে। এর মধ্যে সম্রাট সবচেয়ে পুরনো দোকানি। তিনি ১৯৮৩ সাল থেকে বই বিক্রি করে আসছেন। তার পাশে ঈমান খান নামে আরেকজন বই বিক্রেতা রয়েছেন। তিনিও ১৯৯০ সাল থেকে বই বিক্রি করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন দপ্তরের পাশে তাদের দু’জনের দোকান। সম্রাট আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেশন বাজারেও পুরনো বই বিক্রি করতেন। তবে বয়সের ভারে তা আর করা হয় না তার।
সম্রাটের বাড়ি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন স্টেশন বাজারের মেহেরচন্ডী এলাকায়। আর্থিক অনটনে পড়ালেখা না হওয়ায় এক সময় বড় বড় চাইনিজ হোটেল ও চায়ের দোকানে কাজ করেতেন। তবে নিজের পড়ালেখা করার সুযোগ না হলেও একমাত্র মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। বিশ্ববিদ্যায়ের জিওলজি অ্যান্ড মাইনিং বিভাগ থেকে তার মেয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন। সম্রাট দোকান করার পাশাপাশি বইও পড়েন এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিশুদের আরবি ও বাংলা পড়ান।
তার বইয়ের দোকানি হিসেবে পরিচিত হওয়ার পিছনেও রয়েছে একটা ইতিহাস। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি গল্প জুড়ে দেন। জানান, বেকার থাকা অবস্থায় সাহেব বাজারের একটি বইয়ের দোকানে বসে ছিলেন ঘণ্টাখানেক। সেখানে প্রচুর নতুন বই বিক্রি হতে দেখে নিজেই চিন্তা করলেন পুরনো বই সংগ্রহ করে বিক্রি করলে কেমন হবে? এই চিন্তা থেকেই বিভিন্ন দোকান থেকে পুরনো বই ও পত্রিকা সংগ্রহ করে আনতেন তিনি। পরে এগুলো নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্রাম্যমাণ পুরনো বইয়ের দোকান দিয়ে বসেন।
প্রথমদিকে টুকটাক দুই টাকা, পাঁচ, দশ টাকা বিক্রি হতো। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের প্রয়োজনীয় বই সংগ্রহ করে বড় আকারে দোকান নিয়ে বসেন। ওই সময় পুরনো বইগুলো দিয়ে অনেক শিক্ষার্থীরাও সহযোগিতা করেছিলো বলে জানান তিনি। এরপর প্রায় দশ বছর কেটে গেছে তার পুরনো বইয়ের ব্যবসাটা শিখতে। এখনও অনেক শিক্ষার্থী বই দেন তবে তাদের কাছ থেকে কিছু টাকা দিয়ে কিনতে হয়। আবার শিক্ষার্থীরাই তার কাছে থেকে বই কেনেন।
সম্রাট বলেন, শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই বই কেনেন না, পাশাপাশি শিক্ষকরাও পুরনো বই কেনেন। আমি দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন’শ শিক্ষক আছেন যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থেকে শিক্ষক হয়েছেন। তারাই আমার কাছে থেকে বেশি বই কেনেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, একচালা ছাউনির দোকানটিতে নানা ধরনের পুরনো বই রয়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন উপন্যাস, গল্প, কবিতা, মনীষীদের জীবনী, ধর্মীয় গ্রন্থ, বিভিন্ন একাডেমিক বই। এছাড়াও বিসিএস পরীক্ষার জন্য বিশেষ ধরনের বই। যেমন- বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, রসায়ন, সাধারণ জ্ঞানের বই সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। তবে বেশির ভাগ বই বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা বিভাগের। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি বই আছে। যার বেশির ভাগ বইয়ের দাম ৪০ টাকা, ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত।
তবে ইচ্ছে করে সম্রাট এই পেশায় আসেননি। তারাও ইচ্ছা ছিল বড় কিছু করার। করতে চেয়ে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-খাটো কোনো চাকরি; তাও মেলেনি।
এ ক্ষোভও আছে তার। সেটা গোপন না করেই তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পিওন, গার্ড, মালির চাকরির জন্য অন্তত পক্ষে ১০ বার ইন্টারভিউ দিয়েছি। ইন্টারভিউয়ে পাশও করেছি কিন্তু আমাকে চাকরিতে নেয়নি। চাকরি না হওয়ায় অনেকদিন বেকার ছিলাম। তার পর এখানে পুরনো বইয়ের দোকান নিয়ে বসেছি।’
তার অভিযোগ, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৩৬ বছর ধরেই বই বিক্রি করছি। এই ৩৬ বছরে অন্তত ২৫ বার প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছি দোকান করার অনুমতি জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলেছে পুরনো বইয়ের দোকান দিলে পরিবেশ নষ্ট হবে। তখন তারা অনুমতি দেয়নি। এজন্য অন্য কোনো বইয়ের দোকান বসতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। কেননা অস্থায়ী দোকান যেকোনো সময় তুলে দিতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ’
পুরনো বই কিনতে আসা এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘তুলনামূলকভাবে আমাদের এখানে বইয়ের দোকান কম। অধিকাংশ বই কিনতে যেতে হয় শহরের বইয়ের দোকানগুলোতে। ক্যাম্পাসে চায়ের দোকান, সিগারেটের দোকান এমনকি কাপড়ের দোকানের ছড়াছড়ি। কিন্তু একটা ভাল বইয়ের দোকান বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় না। তবে পুরনো বইয়ের দোকানটা থাকায় আমরা অল্প টাকায় প্রয়োজনীয় বইগুলো কিনতে পারি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার রানা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক বইয়ের দোকান নেই বললেই চলে। যার জন্য শিক্ষার্থীরা তেমন বই পড়েন না। যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে ভ্রাম্যমাণ বইয়ের দোকান থাকতো; তাহলেও শিক্ষার্থীরা বই না কিনলেও একবার খুলে দেখতেন। আবার দোকানগুলো ভ্রাম্যমাণ হলে সমস্যায়ও পড়তে হয়। তার কারণ রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ের মধ্যে বাইরে বইয়ের দোকান দেওয়া সম্ভবও নয়। একটা ঘরের মধ্যে যদি এমন বইয়ের দোকানগুলো করার ব্যবস্থা করতো তাহলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং দোকানিরাও সুবিধা পেতেন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এবং প্রশাসনের এগিয়ে আসা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।’
তারপরও এমন জ্ঞান পিপাসু মানুষ থাকায় আজও জ্ঞানের ফেরিওয়ালার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের ভালবাসার টানে ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পুরনো বই নিয়ে হাজির হচ্ছেন ক্যাম্পাসে। এ যেন অন্য এক ভালবাসার টান। অন্যকে শিক্ষিত করার আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সম্মানের সাথে। নিজে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে না পারলেও শিক্ষার্থীদের জন্য ৩৬ বছর ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন এই পুরনো বইয়ের দোকানি সম্রাট।