কোন কোন নাম আছে সূর্যের চেয়ে বেশি দেদীপ্যমান। তাদেরকে আপনি অপছন্দ করতে পারেন, ঘৃণাও করতে পারেন; কিন্তু অস্বীকার করতে পারেন না কোনভাবেই। কোন কোন মানুষ আছে যাদের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে আপনি একমত নাও হতে পারেন, তাদের দর্শন আপনি প্রত্যাখ্যানও করতে পারেন, কিন্তু মানুষের জন্য তাদের সংগ্রামটা আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। কিউবা বিপ্লবের নেতা সদ্যপ্রয়াত ফিদেল কাস্ত্রো এরকম একজন মানুষ। গত শতকে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী রাষ্ট্রনায়কদের একজন তিনি, শুধু একটি তথ্যেই তার প্রভাব সম্পর্কে বুঝা যায়: যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে থাকা সমাজতান্ত্রিক কিউবার এ নেতাকে হত্যার জন্য ৬৩৮ বার চেষ্টা চালানো হয়। এর সবগুলো ব্যর্থ বলেই ২০০৮ সালে ভাই রাউল কাস্ত্রোর উপর রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বভার তুলে দিয়ে আরো আট বছর একরকম নিভৃত জীবনেও রাষ্ট্রপরিচালনায় নেপথ্য ভূমিকা রেখে ৯০ বছর বয়সে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করতে পেরেছেন ফিদেল কাস্ত্রো। তার সাফল্য এখানে যে মহাপুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক পাশেই অবস্থান করে তিনি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও তিনি তার দেশে সমাজতন্ত্র রক্ষা করতে পেরেছেন; বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র এবং সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়লেও তিনি কিউবাকে সমাজতন্ত্রের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে দেননি। তার এ সাফল্যে শুধু ভগ্নাবশেষ সমাজতন্ত্রীদের উদ্বেলিত থাকার কথা। কিন্তু, তার মৃত্যু সারাবিশ্বেই যে আজ সবচেয়ে আলোচিত বিষয় এর সবচেয়ে বড় কারণ অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বদরবারে তিনি এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার মতো দেশগুলোর মানুষের আশা-আকাঙ্খার বাতিঘরে পরিণত হয়েছিলেন। বিপরীতে তার মৃত্যুর খবরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক জায়গায় নির্বাসিত কিউবানরা উৎসব করেছেন। তারা অবশ্য বলেছেন, তারা কারো মৃত্যুতে উৎসব করছেন না, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের স্বদেশ কিউবায় নতুন করে ‘স্বাধীনতা’র সম্ভাবনায় উৎসব করছেন। যদি সেই সম্ভাবনা অদূর বা দূর ভবিষ্যতে বাস্তবায়িতও হয় তাহলেও ফিদেল কাস্ত্রোর গুরুত্ব কোনভাবেই কমে যায় না; এর এক কারণ যে তিনি তার জীবদ্দশায় তার আদর্শের পতাকাকে শুধু যে সমুন্নতই রেখেছেন এমন নয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় বসে একটি রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রের প্রায়োগিক দিকও সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। অন্য কারণ, এবং এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ– দেশে দেশে সমাজতন্ত্রী বা পুঁজিবাদী চিন্তার মানুষও দিনশেষে ফিদেল কাস্ত্রোকে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বের নির্যাতিত মানুষের বড় কণ্ঠস্বর হিসেবে চিনতে পেরেছেন। ফিদেল যে এভাবে এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার সাধারণ মানুষের আন্তর্জাতিক নেতা হতে পেরেছিলেন তার কারণ তার সংগ্রাম। অনেকের কাছে তার মত-পথ ভুল হতে পারে, তার দর্শন একসময় নাও টিকতে পারে; কিন্তু সকলেই স্বীকার করবেন: ফিদেল যে কারণে তার সারাজীবন ব্যয় করেছেন সেটা মানুষের মহত্তম যে আদর্শ– মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম। ফিদেলকে জাতীয়তাবাদী বলবেন নাকি সমাজতন্ত্রী নাকি একনায়ক– সেটা নিয়ে ইতিহাস হয়তো একদিন উপসংহারে পৌঁছাবে, অথবা কখনোই পৌঁছাতে পারবে না; কিন্তু ইতিহাস তাকে এজন্য মনে রাখবে যে মানুষ, বিশেষ করে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর জন্যই ছিল তার আজীবনের সংগ্রাম।