ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে ২৭ জন তরুণকে ‘সমকামী’ সন্দেহে আটক করেছে র্যাব -১০। এরা প্রত্যেকেই ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী। তারা স্থানীয় ছায়ানীড় কমিউনিটি সেন্টারে সমবেত হলে র্যা ব তাদের আটক করে।
বাংলাদেশে একযোগে ‘সমকামী’ পরিচয়ে এই বিপুল সংখ্যক তরুণের আটকের ঘটনা সম্ভবত প্রথম। কথিত এই সমকামীদের এখন কী হবে-তা নিয়ে চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। অনেকে তাদের ‘ব্যাভিচারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। আবার কেউ কেউ তাদের ছেড়ে দেওয়ার কথাও বলছেন।
সমকামিতা নিয়ে আমাদের সমাজে রয়েছে ভয়ানক রক্ষণশীলতা। বেশিরভাগ মানুষই সমকামিতাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ অন্যায়-অধর্ম হিসেবে দেখেন। যদিও বিজ্ঞানীরা সমকামিতাকে মানুষের একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন (সমকামিতা হলো-একই লিঙ্গের প্রতি কামবোধ, সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ। সমাজচিন্তকদের মতে, সমকামিতাকে কেবল কামবোধ দিয়ে মাপা ঠিক নয়। কারণ ‘সম্পর্ক’ কেবল ‘কাম’দিয়ে হয় না, এর পেছনে থাকে আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা, প্রেম, ভালোলাগা। কাজেই সমকামীদের ‘সমকামী’না বলে ‘সমপ্রেমী’বললে তা হয় যথার্থ)। মানুষ সমকামী হন শারীরিক-মানসিক গঠনজনিত কারণে, স্বভাবগত ভাবে নয়। তাদের মতে, জিনগত, হরমোনগত এবং পরিবেশগত কারণসমূহের এক জটিল আন্তঃক্রিয়ার ফলে এটি ঘটে থাকে এবং এর পেছনে মানুষের সচেতন পছন্দের কোনো ভূমিকা নেই। বিজ্ঞানীদের মতে, সমকামিতা মানব যৌনতার একটি সাধারণ ও প্রাকৃতিক প্রকরণ এবং অন্য কোনো প্রভাবকের অস্তিত্ব ছাড়া এটি কোনো নেতিবাচক মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না।
আমাদের সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মবিশ্বাস ও আইনে সমকামিতাকে সমর্থন করা হয় না। বিশ্বের অনেক দেশই সমকামিতাকে বৈধতা দিলেও বাংলাদেশে এটি অপরাধ। বাংলাদেশের আইন সমকামিতাকে এখনো প্রকৃতি বিরুদ্ধ মনে করে এবং এর শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা মোতাবেক সমকামিতা ও পায়ুমৈথুন শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ, যার শাস্তি দশ বছর থেকে শুরু করে আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে জরিমানাও হতে পারে।
উল্লিখিত বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। হেলায়-ফেলায় ২৭জন তরুণের জীবন যেন বিপন্ন না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ হতে হবে। বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখা এবং খোলা-মেলা আলোচনা করা দরকার।
সমকামিতা বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ ‘অর্ডার অব নেচার’বা প্রকৃতির নিয়ম-এর পক্ষে। সাধারণ মত হচ্ছে, বিপরীত লিঙ্গের প্রাণীর মধ্যে যৌন আকর্ষণই প্রকৃতির ‘নিয়ম’। তার বাইরে আর কোনও আকর্ষণ প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। যদিও প্রকৃতিতে সমলিঙ্গের সদস্যদের মধ্যে যৌনতা বিরল নয়। বোনোবো, ডলফিন, পেঙ্গুইন, ব্যাঙ, সাপ, কেঁচো, ভেড়া এবং বহু পোকার জগতে সমকামিতা রীতিমতো স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। নিয়মবিরুদ্ধ নয় বটে, তবে সমকামিতা কিন্তু বড় একটা ধাঁধা। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে আসতে হবে প্রকৃতি প্রসঙ্গে। প্রকৃতিতে মূল কথা টিকে থাকা। সারভাইভাল। প্রাণী অমর নয়, নশ্বর। প্রকৃতিতে অমরত্বের বন্দোবস্ত বংশবৃদ্ধিতে। তাই বংশবৃদ্ধি সবার কাম্য। সমকামিতা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়ায় ঠিক এখানে। সমলিঙ্গের জীবের মধ্যে যৌন আকর্ষণ সন্তান উৎপাদনের সহায়ক নয়। তাহলে অবশ্য সমকামী আচরণ প্রকৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা যায়নি। কেন? বড় প্রশ্ন।
এ এক এমনই বড় প্রহেলিকা যে, তার সামনে চার্লস রবার্ট ডারউইন সাহেবও অসহায়। বিজ্ঞানে এক মহাবিপ্লবের নায়ক নিকোলাস কোপারনিকাস। গ্রহ-তারার নতুন অনুশাসনসম্পর্কিত ধারণা তার অবদান। তবু সে বিপ্লবের প্রভাব ছিল সীমিত। যেন তা কেবল জড় বস্তুর জন্য। জীবজগতের রহস্য ব্যাখ্যায় তা অচল। যেন লতা-পাতা গাছ-পালা পশু-পাখির রাজ্যে বিজ্ঞানের কথা বলার কোনও অধিকার নেই। সেখানে খবরদারি করতে পারবে কেবল ধর্মবিশ্বাস। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটান ডারউইন। দেখিয়ে দেন জীবজগতের হাল-হকিকতের ব্যাখ্যাও দিতে পারে বিজ্ঞান। দিতে পারে বিবর্তনবাদের আলোকে। যার মূল কথা বংশবৃদ্ধি। এমন ভাবে, যাতে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে টিকে থাকা যায়। যে-সব বংশধর পরিবেশের উপযোগী নয়, তারা পৃথিবীর বুকে নিশ্চিহ্ন হতে বাধ্য। এ হেন ডারউইনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা দিতে পারে না সমকামিতার। পরিবেশের অনুপযোগী বংশধর আর বংশবৃদ্ধির অনুপযোগী প্রবৃত্তি তো প্রায় একই ব্যাপার। তা হলে বিবর্তনের চাপে তো জীবজগতে সমকামিতা উধাও হওয়ার কথা। কিন্তু তা তো বেঁচেবর্তে আছে দিব্যি!
জীবজন্তুর সমাজে সমকামিতা সম্পর্কে ডারউইন কোনও মন্তব্য করেছিলেন কি না তা জানা নেই। তবে, সেক্স বা যৌনতা প্রসঙ্গে তিনি অকপটে বিজ্ঞানের ব্যর্থতা স্বীকার করেছিলেন। প্রজননের মূলে দুই বিপরীত লিঙ্গের মিশ্রণ। সন্তান উৎপাদনে স্ত্রী এবং পুরুষ দুই প্রজাতির প্রয়োজন। ১৮৬২ সালে ডারউইন লিখেছিলেন, ‘যৌনতার কারণ সম্পর্কে আমরা চূড়ান্ত কিচ্ছুটি জানি না। নতুন জীবের জন্মের জন্য কেন দুই লিঙ্গের মিশ্রণ দরকার? পুরো বিষয়টা এখনও অন্ধকারে ঢাকা।’ডারউইনের ওই মন্তব্যের পর দেড়শো বছর কেটেছে। ওই অন্ধকার আজও কাটেনি। হোয়াই সেক্স?
‘হোয়াই সেক্স’ এ প্রশ্নের উত্তরে ধর্মবাদীদের একমাত্র উত্তর ঈশ্বর। আদম আর ইভ-এর মতো বিপরীত লিঙ্গের জীব ঈশ্বরের সৃষ্টি। যেহেতু তার ইচ্ছা ওদের সন্তান আসার মূলে ভূমিকা থাকে কারও একার নয়, দুজনের; তাই বংশধর সৃষ্টির জন্য দরকার বাবা ও মা-র। ধর্মবাদীরা বিশ্বাস করেন পৃথিবীতে মানুষ অন্য জীবের বিবর্তনে আসেনি, বরং এসেছে ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে। সমকামিতা ধর্মবাদীদের চোখে নিন্দনীয়, কারণ ওটা নাকি জীবের ঘৃণ্য বিকার। কেন? ওতে ঈশ্বরের অভিপ্রায় (সন্তান উৎপাদন) সিদ্ধ হয় না।
আসলে সমকামিতা সমর্থন বা বিরোধিতার বিষয় নয়, এটা শেষ বিচারে মানবাধিকারেরই প্রশ্ন। এমন একটি প্রশ্নে আমরা শরিয়তি মতাদর্শ নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেলে তাতে স্পষ্ট হবে যে সামাজিক প্রগতির প্রশ্নে আমরা অনগ্রসর, পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল, মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার নিগড়েই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছি।
মনে রাখা দরকার যে, সমাজে নানা পরিচয়ের, প্রবণতার মানুষ আছে। আছে সম-যৌন প্রবণতা সম্পন্ন মানুষ। এই ভিন্ন যৌন পরিচয় নিয়ে সমাজে বেড়ে উঠা মানুষদের যন্ত্রণার কোনো শেষ নেই। নিজেদের কথাকে নিজেদের মধ্যে আটকে না রেখে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে যন্ত্রণা উপশমের একটা পথ থাকে। জীবনযন্ত্রণা কারো একার নয়, কোনও একটা মানবগোষ্ঠী একাই জীবনযন্ত্রণায় ভুগছে বাকি সবাই ভালো আছে-তা তো হতে পারে না। সমাজে যদি একের দুঃখে অন্যজন সমব্যথী না হয় তাহলে তো আর মানুষের সমাজ কেন? একের যন্ত্রণা অন্যজন যন্ত্রণা দিয়ে বোঝে বলেই তো আমাদের এই পৃথিবী এত সুন্দর।
ভিন্ন যৌন অনুভূতি একান্তভাবে নিজের মধ্যে জন্ম নেয়। এই বোধ যাদের মধ্যে জন্ম নেয় তারা সমাজে ভীষণ একা। তারা কাউকে এটা বলতে পারে না। অভিভাবকদের বললেও তেমন কোনো লাভ হয় না। অভিভাবকরা তাকে ছেলে কিংবা মেয়ে বানানোর চেষ্টা করেন। এজন্য জোর-জবদস্তি পর্যন্ত করেন। অনেকের জীবনে এটা বিয়ের পর প্রকাশ হয়ে যায়। যারা ভিন্ন যৌন পরিচয় ধারণ করে তাদের একাকিত্বের যন্ত্রণায় কেউ সহায় হয় না।
পুরুষতন্ত্র সমাজ-সংসারের একটা ছক এঁকে দিয়েছে। একেই আমরা প্রাকৃতিক বা ধর্মীয় বিধান হিসেবে মেনে নিয়েছি। এর বাইরে জগৎ হতে পারে, হওয়া সম্ভব-এটা ভাবতে সমাজ, সমাজের প্রথাবদ্ধ মানুষেরা নারাজ। এই বিশ্বাস ভাঙ্গতে গেলে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়।
বহুজনকে নিয়েই আমাদের সমাজ। সমাজের প্রত্যেকে যেন নিজের মত বাঁচতে পারে, নিজের পছন্দ অনুযায়ী চলতে পারে সেটাই আজকের যুগের মানবাধিকারের মূল কথা। বাইরের ঠিক সব সময় ঠিক নয়। ভেতরের বা সত্তার বিকাশই আসল কথা। সত্তাকে উপলব্ধি করতে হয়। তবে তাকে চিনতে পারা যায়। আমাদের সমাজে পিতৃতন্ত্রের খাঁচায় সবাইকে ফিট করতে চাওয়া হয়। কেউ ফিট না করলে তাকে বাধ্য করা হয়। যে ফিট করছে না তাকে কি আমরা ছুঁড়ে ফেলে দেব?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)