‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবস শর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রার্থনা’ কবিতার এই লাইনগুলো এই সময় মনে হয় আর সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করা সম্ভব না। ভয়শূন্য চিত্ত নিয়ে মাথা উঁচু করে মুক্তমত প্রচার করার আগে আমাদের দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। কারণ এই সময় নিজের মত প্রকাশ করাটা মোটেই নিরাপদ মনে হচ্ছে না। যেভাবে একের পর এক লেখক, ব্লগার ও প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যার মহোৎসব চলছে তাতে করে আমাদের দেশকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারের এক নরক কারাগার করে তুলেছে।
যারা হত্যা করছে তাদের শুধু চাপাতি চালানোর ক্ষমতাটাই আছে, যুক্তি দিয়ে কোনো মত প্রতিষ্ঠা করার মুরোদ নেই। ‘আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত নাও হতে পারি কিন্তু তোমার মত প্রকাশের জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত’ ভলতেয়ারের এই কথা বোঝার মত ক্ষমতা বা বুদ্ধি কোনটাই নেই হত্যাকারী সেই নরপশুদের।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত লাল-সবুজের দেশটা যেন হঠাৎ করেই খুব অপরিচিত হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে। নিজের স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য একদিকে চাপাতিওলাদের ভয়ে নিরাপত্তাহীনতা অন্যদিকে মধ্যযুগীয় ৫৭ ধারা দিয়ে নির্যাতন, বাংলাদেশ নামক দেশটি যেন এক অপরিচিত ব-দ্বীপ আমাদের কাছে। যারা নিজেদের স্বার্থে এই ৫৭ ধারা তৈরী করেছে তাদের মনে রাখা উচিত নিজেদের
স্বার্থেও কখনো দানবকে পুষতে হয় না। এক সময় সেই দানবই গ্রাস করবে সব কিছু।
নাস্তিকতার দোহাই দিয়ে যে হত্যা চলে আসছে এর পিছনে দায়ী কে? কাকে দোষ দেয়া যায়? এমন প্রশ্নের উত্তর এক বাক্যে দেয়া সম্ভব না। আমাদের সামগ্রিক নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করলে রাজনৈতিক ব্যর্থতাও কম না। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের জন্ম শত্রু কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণে দিশেহারা হয়ে জামাত-বিএনপি সেই গণজাগরণকে নানা ভাবে বিতর্কিত করতে থাকে।
সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে সেই বছরের ফেব্রুয়ারি তৃতীয় সপ্তাহে খালেদা জিয়া ঘোষণা করলেন শাহাবাগে যারা ফাঁসি ফাঁসি করছে তারা সবাই নাস্তিক। খালেদার এই কথা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেয় তারই অনুগত বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী, তাদের মতাদর্শের পত্রিকা ও জামাত বিএনপির মদদে সেই সময় গড়ে উঠে ইসলামী উগ্র মতবাদের দল হেফাজতে ইসলাম। এই ত্রয়ী দিয়েই বিএনপি নেত্রী দেশে এক অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। যাদের ব্লগ সম্পর্কে কোন ধারনা নেই তারাও ব্লগার সর্ম্পকে বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে থাকলেন। ব্লগে লিখলেই সে নাস্তিক এই রকম একটি প্রচারণা বেশ ভালোভাবেই গায়েবলীয় প্রচার তত্ত্বে অধিক প্রচারনায় প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিএনপি-জামাত জোট ও তার মিত্ররা।
সমস্ত লোক লজ্জার মাথা খেয়ে বিএনপি একাত্তরে বাংলাদেশ জন্মের বিরোধীতা করা দল জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে অশ্লীল সহবাস দেশকে পাকিস্তানী মতাদর্শের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মাঠেও নেমেছে। তাই একের পর এক হত্যা করা হচ্ছে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অসাম্প্রদায়িক একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে সেই সব তুরুণদেরকে।
দেশে যখন দুই বিদেশী নাগরিককে হত্যা করা হলো তার কোনো কূল কিনারা করতে ব্যর্থ হয় আমাদের পুলিশ বাহিনী। গত ফেব্রেুয়ারি থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত ৫ জন লেখক, ব্লগার, প্রকাশককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রায় প্রতিটা হত্যাকাণ্ডই যে একই গোষ্ঠীর কাজ তা তাদের হত্যার ধরন দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু কোন হত্যাকাণ্ডেরই কোনো কূলকিনারা করতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের আইন-শৃংঙ্খলা বাহিনী।
প্রতিটি ঘটনাতেই বিএনপি-আওয়ামী লীগ তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে ব্যস্ত। আর এর ফাঁকে পার পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা। বিএনপি দেখাতে চাচ্ছে দেশের আইন-শৃংঙ্খলা কত খারাপ। অন্যদিকে সরকারের মন্ত্রী ও দলের নেতা-নেত্রীরা সব দোষ বেগম খালেদা জিয়ার ঘাড়ে চাপিয়ে দায় মুক্তির চাচ্ছে যেন। খালেদা জিয়া লন্ডনে বসে যদি এতকিছু করার ক্ষমতা রাখে তবে সরকার দেশে বসে এর প্রতিকার করতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে কেন? এই প্রশ্ন জনগণ ইতিমধ্যে তুলতে শুরু করেছে। তাই পরস্পরের প্রতি দোষারোপের রাজনীতি বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়ার কাজেই বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত সরকারের।
বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যখন একটা প্রজন্মকেই নাস্তিক আখ্যা দিলেন তখনই তার অনুসরী কিছু বুদ্ধিজীবী (!) তা প্রমাণে উঠেপড়ে লাগলেন। হিটলারের প্রচার মন্ত্রী গোয়েবলসের মতো করে তারা প্রচার করতে থাকলেন। তারা জানতেন একটি মিথ্যা বার বার প্রচার করলে তা মানুষ বিশ্বাস করবে। মানুষ তা বিশ্বাসও করেছে। বাংলাদেশের বিশাল একটি জনগোষ্ঠী এখন বিশ্বাসও করে যে, ব্লগার মানেই নাস্তিক।
এখানেই খাদেলা জিয়ার স্বার্থকতা। বার বার মিথ্যা প্রচার করেও তিনি তাকে সত্য বানিয়েছেন। এই কাজ করতে যেয়ে তিনি সোসাল মিডিয়াকে ভালোমতই ব্যবহার করেছেন। এর স্বীকৃতি খালেদা জিয়া ২ নভেম্বর লন্ডনে একটি সমাবেশেও স্বীকার করেছেন। তিনি তার দলের নেতা-কর্মীদের বলেছেন বেশি বেশি করে সোস্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় হতে।
আর আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তিযুদ্ধের লোকদের ব্যর্থতা এই যে, আমরা তা প্রতিরোধ করতে পারিনি। তাই যখন ২০১৩ সালে সাঈদির রায়ের পরে জামায়াত-হেফাজতিরা প্রচার করলো চাঁদে সাঈদীকে দেখা যাচ্ছে তখন সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাও হলের ছাদে সাঈদীকে দেখতে উঠে। (মুহসীন হলের এই ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী না হলে বুঝতাম না। সাঈদীর নূরানী চেহারা মোবারক (!) দেখার জন্য সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছাত্র যেতে পারে তা কল্পনাও করিনি কোনদিন।) বিএনপি-জামায়াতের পোষা বুদ্ধিজীবীরা তাদের এজেন্ডা ঠিকই বাস্তবায়ন করেছে বা করতে পেরেছে।
বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ এবং অকার্যকর করার দাঁড়প্রান্তে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী বা সুশীল সমাজের যে দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তা পালন করতে অনেকাংশেই ব্যর্থ হচ্ছে আমাদের ন-পুংশক বুদ্ধিজীবীরা। তারা নিজের স্বার্থেও বাইরে গিয়ে জাতীয় বা সমাজের স্বার্থে কিছুই করতে পারছে না। তারা তাদের মাথা যেন কোন কিছুর কাছে বিক্রী করে দিয়েছে। সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতাহীন সুশীল সমাজ তাই এখন একটা গালির নাম।
কঠোর হাতে জঙ্গিবাদ দমন না করতে পারলে বাংলাদেশের সব অর্জনই ব্যর্থ হয়ে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ইতিবাচক দেশের যে তালিকায় উঠে এসেছে তা এই দেশের মানুষের নিরলস পরিশ্রমের ফলে গড়ে উঠা কর্মচাঞ্চল্য দিয়ে।
সামাজিক-অর্থনৈতিক সব সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য বিষ্ময়কর। নারী শিক্ষা, মাতৃ-মৃত্যুহার কমানো, নারীর ক্ষমতায়ন, তারণ্যের এগিয়ে চলা সব দিক দিয়ে বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০০০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক যে এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তা পূরণেও বাংলাদেশের সাফস্য শতভাগ। এমনকি সময়ের অনেক আগেই তা পূরণ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে সাসটেইনেবল ডেভলোপমেন্ট গোল নির্ধারণ করা হয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে। সেখানেও বাংলাদেশ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবে এমনটা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়।
কিন্তু সাধের সব প্রগতি ও অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়বে যদি বাংলাদেশ এই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখতে না পারে। সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে। একেবারে সবটুকু চলে যাওয়ার আগেই এই অশুভ শক্তির লাগাম টেনে না ধরলে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাকের মত করুন পরিণতি বরণ করবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও বাংলাদেশ নষ্টদেও অধিকারে চলে যাক এমনটা নিশ্চয় আমরা চাই না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)