সন্ত্রাসের জনপদে জন্ম আমার, সংকোচ নেই বলতে। বাংলার উত্তর পশ্চিম অঞ্চলে জন্ম আর বেড়ে ওঠা আমার। যখন একটু একটু বুঝতে শিখলাম তখন আমাদের এলাকার অবস্থা টালমাটাল। চারু মজুমদারের খুব বাড় বাড়ন্তি তখন, বর্তমান বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্ত জুড়ে। বাংলাদেশের খুলনা থেকে নওগাঁ পর্যন্ত, তথাকথিত বিপ্লবের হল্কা লাগে নকশাল আন্দোলনের নামে। কেন কীভাবে লাগে তা একটু পিছন ফিরে দেখে নিই।
নকশাল আন্দোলন একটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের নাম। গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ একদল মানুষের ত্যাগের অমর গাঁথা হবার কথা। চিন্তা ও চেতনায় ছিল তা, সবশেষে নয়। অস্বীকার করার উপায় নেই। বিংশ শতাব্দীর সপ্তম দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি থেকে শুরু হয়ে এটি ধীরে ধীরে ছত্তীসগঢ় (তদানীন্তন মধ্যপ্রদেশ) এবং অন্ধ্র প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায়, ক্রমে এটি একটি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। বিভিন্ন লেখায় দেখা যায়, নকশাল বা নকশালবাদী বলতে উগ্র বামপন্থী দলগুলোকে নির্দেশ করা হয়ে থাকে।
এসব দলের জন্ম হয়েছিল চিন-সোভিয়েত(Sino-Soviet split) ভাঙনের সময়। মতাদর্শগত ভাবে এরা মাও সে তুং-এর পদাঙ্ক অনুসরণকারী। নকশাল আন্দোলন শুরু হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, যা বর্তমানে বাংলাদেশের সংগে লাগোয়া। ধীরে ধীরে তা ভারতের অনুন্নত অঞ্চলসমূহে যেমন:ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, ইত্যাদি রাজ্যের প্রান্তিক এলাকাগুলিতে প্রসারিত হয়ে পড়ে। ভারতের প্রায় ৪০% অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে “রেড করিডোর” অঞ্চলে প্রায় ৯২০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে তারা তাদের তৎপড়তা চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারতের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা “রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং” (“র”) এর হিসেব অনুযায়ী প্রায় ২০০০০ মাওবাদী সক্রিয় ভাবে এ কার্যক্রমে যুক্ত আছে। তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে শঙ্কিত হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ মাওবাদীদের কে ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিরুদ্ধে সর্বাপেক্ষা বৃহত্তর হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
সিপিআই (মাওবাদী) এবং আরও কিছু নকশালপন্থী দলকে ভারত সরকার সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করা শুরু করে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সরকার নকশাল নির্মূলে তাদের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। এতে উগ্রবামপন্থী আক্রান্ত অঞ্চল ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে, তাদের পলায়নের সব রাস্তা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
নকশাল শব্দটি এসেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোটগ্রাম ’’’নকশালবাড়ি’’’ থেকে।এখানে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র একাংশ ১৯৬৭ সালে তাদের নেতৃবৃন্দের বিরোধিতা করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)একটি পৃথক উগ্র বামপন্থী দল গঠন করেন। এ বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন চারু মজুমদার এবং কানু স্যানাল। এ বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ২৫ মে তারিখে। তখন নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষকদের উপর স্থানীয় ভূস্বামীরা ভাড়াটে গুন্ডার সাহায্যে অত্যাচার করছিল। এরপর এই সশস্ত্র হয়ে কৃষকরা ঐ ভূস্বামীদের সেখান থেকে উৎখাত করে।
এর ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে দেবেন সিকদার (পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি), নাসিম আলী (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, হাতিয়ার), অমল সেন (কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র), ডাঃ সাইফ-উদ-দাহার (কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ) কাজী জাফর আহমদ (কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি), সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি, পাবনার টিপু বিশ্বাস, আলাউদ্দিন, মতিন সাহেবদের বিভিন্ন দল উপদল চারু মজুমদারের মতাদর্শে কম বেশী সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম ও লালনের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করেছে শ্রেণীশত্রু খতমের নামে।
আর সব শেষে জাসদের গণবাহিনী যা সশস্ত্র বাহিনীর রূপে শ্রেণীশত্রু খতম করে বাংলাদেশে তাদের পছন্দের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু এদের কেউ সফল হননি বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোর কারণে, নিজেদের ভ্রান্তির কারণে। তাই এদের অধিকাংশই হতাশ হয়ে শেষে বিভিন্ন ডান রাজনৈতিক দলে (যাদেরকে তাঁরা খুব ঘৃণা করতেন) ভিড়ে ক্ষমতার মিষ্টি নোনতা স্বাদ নিয়েছেন। আর যারা পারেন নি তাদের অনেকেই ছোট ছোট উপদলে বিভক্ত হয়ে বাম রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়, ডাকাতির মত নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন, এখন আছেন, কেউ কেউ, মরছেন প্রতিনিয়ত।
কিন্তু যারা রাজনীতির নামে মানুষ হত্যা, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায়, ডাকাতিতে জড়িত, সন্ত্রাসী হিসেবে উত্থানের পরে তাঁদের গড় আয়ূ কিন্তু দশ (১০) বছরের বেশী নয় বলে অভিজ্ঞরা জানান। তারা বলেন, খুব কম সন্ত্রাসী আছে যারা একাধিক মানুষ খুন করার পরেও বেঁচে যায়, কিন্তু থাকে নানা সমস্যায়। তাঁরা আরো বলেন যে, খুনিরা সাধারণত বাঁচে না, নিজেরাও খুন হয় যেভাবে তাঁরা মানুষকে খুন করেছে, সেইভাবেই। আর ভাগ্যক্রমে (!)বেঁচে গেলেও সুস্থ্য অবস্থায় ভালো করে বাঁচে না।
আর দশ জনের মত স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। কিন্তু যাদের তাত্ত্বিক পরামর্শে এরা শুরুতে এই বাম বা যে কোন নামের সন্ত্রাসী আন্দোলনে নামেন, তাঁরা একসময় বুদ্ধিজীবী বনে যান। নানা মিডিয়ায় নানা বক্তব্য প্রচার করেন। বই লেখেন, প্রকাশনার সাথে জড়িত হয়ে নিজের ভুল জাস্টিফাই করতে পত্রিকায় কলাম লেখেন (আসলে শান্তি খুঁজে ফেরেন)। অনেক সময় দল পরিবর্তন করে বড় বুর্জোয়া দলের পালিত বুদ্ধিজীবী হন। অন্যদলে গেলেও মাঝে মাঝে এমন বক্তব্য দেন যাতে সন্ত্রাসীদের অপকর্মকে একটু হলেও আড়াল করা যায়।
এক অদ্ভূত মিল দেখি এই বাম আন্দোলনের সাথে আমাদের দেশের বর্তমান ইসলামী শাসন কায়েমে প্রত্যাশী সশস্ত্র আন্দোলনের। এখন নিরীহ, নিরাপরাধ মানুষ খুনে মত্ত তরুণ, যুবা আর তার নেতারা। একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, নানা মিডিয়ায় নানা বক্তব্য প্রচার করছেন। পত্রিকায় কলাম লিখছেন কেউ কেউ। এমন সব হাস্যকর বক্তব্য দিচ্ছেন যাতে ইসলামের নামে করা অপকর্মকে একটু হলেও আড়াল করা যায়। এমন মানুষ খুন ক’রে ক’রে মাত্র দশ বছর বেঁচে থাকার প্রশান্তি কোথায়?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)