মায়ের নাড়ি ছেড়া ধন তার সন্তান। জন্মের পর থেকেই সু-সন্তান হিসেবে গড়তে মা বাবার থাকে সকল চেষ্টা। বলা হয়, একজন চিহ্নিত খারাপ মানুষও চায় তার সন্তান ভালো মানুষ হোক।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজনৈতিকভাবে এবং ব্যক্তি জীবনে অনেকভাবে বিতর্কিত। সে আলোচনা-সমালোচনা পেরিয়ে এখন বেগম জিয়া কারারুদ্ধ। সাজাপ্রাপ্ত আসামী হয়ে পরিবার সন্তান থেকে দূরে। আর এ সাজার অন্তরালে যে কারণ তা হলো সন্তানদের অসততা ও অমানবিক আচরণ।
বেগম জিয়ার এ করুণ পরিণতির দায় অনেক মায়ের জন্য আগামী দিনের উদাহরণ। দুই ছেলের জননী তিনি। ছোট ছেলে কোকো দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়ে আশ্রয় নিয়েছিল মালয়েশিয়াতে। ১/১১ এর পর আর দেশে আসতে পারেনি মামলার কারণে। মারা গেছে মালয়েশিয়াতে। মায়ের কাছে ফিরে এসেছে লাশ হয়ে। কোকোর বউ-মেয়েরা এখনো আছে সেই প্রবাসে। বড় ছেলে তারেক যাবজ্জীবন দণ্ড প্রাপ্ত ফেরারি আসামী এখন। সেও তার পরিবার নিয়ে বিদেশে। কারণ দেশ ফিরলে তার ঠিকানা হবে কারাগারে। অর্থ লোভ আর ক্ষমতার দাম্ভিকতার এ করুণ পরিণতি ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে থাকবে।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর একজন সাধারণ গৃহবধূ হিসাবেই রাজনীতিতে আসে বেগম জিয়া। বিএনপির সে সময়ের নেতাদের সামনে বেগম জিয়া ছাড়া আর কোন পথ ছিল না। এরশাদের সামরিক শাসনের সে সময়টাতে পিতৃহারা দু’সন্তান নিয়ে বেগম জিয়া যা সুবিধা পেয়েছেন তা সকলের জানা। রাজনীতিতে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে আন্দোলন করেছে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে। ’৯০ দশকের গন আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা আর বিএনপি সভানেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সম্মিলিতভাবে দেশকে ফিরিয়ে দিয়েছিল গণতন্ত্র। তখন বলা হত সাধারণ রমণী হয়েও বেগম জিয়া রাজনীতিতে অনেকটাই দূর দুরর্শিতার প্রমাণ রেখেছে।
তারপর জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ শাসন করে। পারিবারিক প্রভাবের আগে বিএনপিতে যা টানাপোড়ন ছিল তা রাজনৈতিকভাবে। সেখানে তারেক জিয়ার তেমন প্রভাব ছিল না।
কিন্তু আপোষহীন হয়ে ও বেগম জিয়া যে কতটা সন্তানের ভালোবাসাতে অন্ধ ছিলেন তা ক্রমশ প্রকাশ পেতে থাকে ২০০১ সালে তারেক জিয়ার রাজনৈতিক উত্থানের মধ্য দিয়ে। ভাঙ্গা সুটকেস রেখে যাওয়া পিতার দু’সন্তানের অর্থলোভকে লাগাম দিতে পারেনি তাদের মা। হাওয়া ভবন হয় দেশের সকল বাণিজ্যের মূলকেন্দ্র। এর সাথে দলের অনেক সিনিয়র নেতাদের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ করতে তারেক জিয়া সংকোচবোধ করেনি। এমনও শোনা গেছে, অনেক বিষয়ে মা ছেলের বিবাদ ঘটেছে পরিবারের বাইরের লোকজনের সামনে।
কিন্তু রাজনীতির বাইরে গিয়ে মা হিসাবে বেগম জিয়া সে সময় পরাজিত হয়েছে সন্তানের কাছে। প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে শাসন করতে পারেনি বলে ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট জঘন্যতম গ্রেনেড হামলা করে শেষ করে দিতে চেয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সহ আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের। আর এ ঘটনা ক্ষমার অযোগ্য যেনেও ছেলেকে বাঁচাতে মা আশ্রয় নিয়েছে বে আইনিপন্থার। নিজের শাসন আমলে বিচার করেনি এ অপরাধের। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার নোংরা খেলার সাথে ছেলের অন্যায়ের কাছে মাথানত করতে গিয়ে অনাথ এতিমের টাকা মেরে খাওয়াতে সামিল হয়েছে বিএনপি’র আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। যার ফলশ্রুতিতে তিনি দুই মামলাতে ১৭ বছরের সাজা খাটছে।
এখানেই শেষ নয়, হাঁটুতে সমস্যার কারণে তিনি হাঁটা চলার কষ্ট করছেন অনেক আগে থেকেই। আর এখন হাঁটুর অসুস্থতার সাথে সাথে বৃদ্ধ বয়সে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে কারাগার থেকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। কিন্তু জীবনের নির্মমতা হলো, এমন অবস্থায় তার একমাত্র আপন সন্তান পাশে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই।
এমনকি উনার ছোট ছেলে কোকোর মৃত্যুতে থাকতে পারেনি বড় ছেলে তারেক। দুই ছেলের বেপরোয়া জীবনের হালখাতা অন্যায় আর ভুলে ভরা। অর্থলোভী খাম্বা তারেক থেকে ঘাতক, জঙ্গি মদদ দাতা তারেক হিসাবে পরিণীত হবার প্রাপ্তিটা কি হতে পারে তা একবারও ভাবেনি খালেদা জিয়ার সন্তান। কিন্তু সব কিছু পরিণামের শাস্তি ভোগ করেছেন দেশের দুবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। প্রকাশ্য অপরাধের আড়ালে সন্তানের প্রতি মাত্রারিক্ত মায়ার প্রশ্রয়ের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত এ বন্দী জীবন। নিয়তি তার হিসাব এমনি করে হয়ত মিলিয়ে দেয়। কিন্তু মানুষ তা বুঝতে পারে না।
রাজনীতির অংকের সমীকরণ আর আইনের মার প্যাঁচে অনেক কিছু ঘটে। তবে একজন মা আর সন্তানের যাপিত জীবন কোন রাজনীতি নয়। তাই ব্যক্তি খালেদা জিয়া তারেক আর প্রয়াত কোকোর মত সন্তান থেকে মাতৃপ্রেমের যে প্রতিদান পেলো তা আর কোন মায়ের জীবনে না আসে তেমনটাই প্রত্যাশা দেশ আর দেশের মানুষের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)