ব্যাংক আমানতের সুদের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি হওয়ায় কারণে এর বিক্রি বাড়ছে। প্রতিদিন সঞ্চয়পত্র কিনতে গ্রাহকেরা ভিড় করছেন ব্যাংক, জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো ও ডাকঘরগুলোতে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৮ হাজার ২২৯ কোটি টাকার।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এ বছর রেকর্ড পরিমাণ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হবে। কারণ ব্যাংকে আমানত রাখলে তুলনামূলক আগের চেয়ে মুনাফা কম পাওয়া যায়। অন্যদিকে ব্যাংকে আমানতের সুদ হারের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি সুদ পাওয়া সঞ্চয়পত্রে।
তাই যারা এ ধরনের আয়ের উপর নির্ভরশীল তারা সবাই আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্র কিনছেন। তবে এতে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাবে। সেজন্য সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানোর পরামর্শ দেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমানতের চেয়ে অধিক হারে সঞ্চয়পত্রে মুনাফা যাওয়া। এছাড়া পেনশনভোগী ও স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য সঞ্চয়পত্র কেনার নিয়ম থাকলেও এখন তা কিনছেন বিত্তশালীরা। সেজন্য সঞ্চয়পত্রের বিক্রি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এমনকি এ বছর রেকর্ড পরিমাণে বিক্রি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়বে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, জুলাই মাসে সাধারণত বিক্রি বেশি হয়। তবে এবার একটু বেশি বিক্রি দেখা যাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো, আমানতের সুদ হার কমে যাওয়া সবাই সঞ্চয়পত্রে ঝুঁকছেন।
পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমানতের সুদ হার কমে যাওয়ায় মানুষ আমানত না রেখে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে আমানত কমছে। সেজন্য ঋণ বিতরণও কমেছে।
বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেল অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেহেতু আমানতে সুদ হার কমেছে, এখন সঞ্চয়পত্রেও সুদ হার কমাতে হবে। এতে মানুষ আমানতমুখী হবে।
তবে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সরকারের ‘নগদ ও ঋণ’ ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে সঞ্চয়পত্রের ওপর আয়কর রেয়াত সুবিধা প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বর্তমানে একজন ব্যক্তি আয়ের ২৫ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারেন সঞ্চয়পত্রে। মোট বিনিয়োগের ১৫ শতাংশ পর্যন্ত আয়কর রেয়াত সুবিধা দেয়া হয়। এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে একজন বিনিয়োগকারী মোট ৫ হাজার টাকা মুনাফা পেলে সেখান থেকে ১৫ শতাংশ আয়কর কেটে রাখা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের জুলাই শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে সুদ দিয়েছে গড়ে ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। এক্ষেত্রে সরকারি ব্যাংকগুলো সুদ দিয়েছে গড়ে ৪ দশমিক ২৬ শতাংশ।
কিন্তু ৫ বছর ও ৩ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রগুলো থেকে মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে ১১ থেকে সর্বোচ্ছ ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ পর্যন্ত। সেজন্য অনেকে ব্যাংক থেকে স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ভাঙিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্রসহ সব ধরনের জাতীয় সঞ্চয় স্কিমগুলোতে মোট জমা হওয়া ৮ হাজার ২২৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা থেকে মূল ও মুনাফা পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১৯৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা (এর মধ্যে মুনাফা বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১ হাজার ৮৯০ কোটি ৩২ লাখ টাকা)।
ফলে নিট ঋণ দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, যা গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই মাসে আসা নিট ঋণের চেয়ে সামান্য কিছুটা কম। গত বছরের জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্রে নিট ঋণ ছিল ৫ হাজার ৫৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
চলতি অর্থবছরে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১২ মাসে মোট ৭৮ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে মূল ও মুনাফা বাবদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। আর শুধু মুনাফা পরিশোধ করা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা।
এ হিসাবে অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ২ কোটি।