স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি ও মহল ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালি দেশের যেকোনো সুখবরে যেমন নিজের উদ্দাম, উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসাকে দমিয়ে রাখতে পারে না, তেমনি দেশের যেকোনো খারাপ খবরেও তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল আইসিসি ট্রফি জিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে যখন নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যখন বাংলাদেশ ও বাঙালি বিশ্বের দরবারে নতুন করে আরেকবার নিজেদের শক্তি মত্তার কথা জানান দিয়েছে, তখনও আমরা নিজেদের ধরে রাখতে পারিনি। রং খেলা, আনন্দ মিছিল করা, এলাকায়, পাড়া-মহল্লায় ছোট-ছোট গ্রুপ করে-করে হরেক রকম পার্টির আনন্দ আয়োজনগুলো-বাঙালির ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
স্বাধীন বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে আমরা পা রেখেছি। বাংলাদেশের বয়স ঊনপঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। নানা রকম রাজনীতি ও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির মাঝেও বাংলাদেশ তার নিজস্ব ‘সক্ষমতা’ আর ‘আত্মমর্যাদা’ সৃষ্টি করেছে, বল উন্নত মম শির-করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, বিশ্বকে বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য করেছে-এই সফলতা আমাদের বাঙালির জন্য সত্যিই গৌরবের, অহংকারের, গর্বের।
এ দেশের বাঙালি নানান মত ও পথের ঊর্ধ্বে উঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের মন্ত্রমুগ্ধের ভাষণ-ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রক্ত দিয়েছে। যার যা কিছু ছিল, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করেছে। বর্বর পাকিস্তানীদের অসহ্য নির্যাতন সহ্য করে সম্মান-সম্ভ্রম বিনাশ করেছে। সেই ত্রিশ লাখ শহীদ হওয়া জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান আর দুই লাখেরও বেশি নারী মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিরা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে সকল ষড়যন্ত্র, মিথ্যাচার-অপপ্রচার মোকাবেলা করে সক্ষমতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
নিরব-নিভৃতে বাঙালির জীবন মান উন্নত আর বাংলাদেশের আত্মমর্যাদা ফিরিয়ে আনার একান্ত চিত্তে কাজ করে চলেছেন এক মহিয়সী নারী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এক অন্যন্য উচ্চাতায় পৌঁছেছে।
আর যে খবরটিতে বাংলাদেশ একেবারেই নিরব ছিল, সেটি ভারতই আমাদের প্রথম জানিয়েছে। জিডিপি’র পরিস্যখ্যানে ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে-খবরটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হলেও মূলত ভারতই আমাদের বেশি করে জানিয়েছে। এই খবরে ভারতের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, জনপ্রিয় ইউটিউবার, সাংবাদিক, গবেষক, অর্থনীতিবিদের সাথে যুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদও।
আবার ভারতের গণমাধ্যমও বসে ছিল না। গত ১৫ অক্টোবর ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় নিবন্ধের শিরোনাম, ‘ভারত, পূর্ব দিকে তাকাও: বাংলাদেশ ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের (ভারতের) জন্যও শিক্ষণীয়।’ আবার (১৪ অক্টোবর) আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের শিরোনাম ছিল-‘পড়ছে ভারত! মাথাপিছু উৎপাদনে ‘অচ্ছে দিন’ যাচ্ছে বাংলাদেশে।’
অন্যদিকে, দি প্রিন্ট-এর প্রধান সম্পাদক খ্যাতিমান সাংবাদিক শেখর গুপ্ত ১৫ অক্টোবর এক অনুষ্ঠানে বলেছেন- “আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’-এর চলতি অর্থ বছরের প্রতিবেদন ভারতের অর্থনীতির অ্যাকিলিস হিল বা সবচেয়ে দুর্বল স্থান চিহ্নিত করে দিয়েছে। এ সংস্থার আয়না ভারতের জন্য বড়ই নিষ্ঠুর!’’ অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান ইকোনমিস্ট অধ্যাপক কৌশিক বসু এই অবস্থায় ভারতকে ‘শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি’ চালু করার আহ্বানও করেছেন।
খবরটি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত তার ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক’ নামক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে ১০ দশমিক ৩ শতাংশ।
আর এ খবরে বাংলাদেশ নিরবতা পালন করলেও ভারত যথেষ্ট সরব। ভারতের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আর জনপ্রিয় ইউটিউবারগণ রীতিমত তাদের বিশ্লেষণধর্মী মতামত তুলে ধরেছে, ভিডিও ভাইরাল করেছে যা তথ্য-উপাত্ত আর যুক্তি তর্ক দিয়ে। তবে ইউটিউবারদের বিশ্লেষণগুলো অনেকের নজর কেড়েছে। অসাধারণ উপস্থাপন, তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিতর্ক-বিশ্লেষণ আমাদের মুগ্ধ করেছে।
ভারতের জনপ্রিয় অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, জনপ্রিয় ইউটিউবার, সাংবাদিক, গবেষক, অর্থনীতিবিদরা তাদের বিশ্লেষণে বোঝাতে চেয়েছেন যে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে-পঞ্চাশ বছর পর এমন সুখের ঢেকুর আর আত্মঅহমিকা দেখানো বন্ধ করে বরং মোদি সরকার শেখ হাসিনার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তারা বলার চেষ্টা করেছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি হচ্ছে, ধর্ষণ হচ্ছে, গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নানা কথা শোনা যায়, তারপরেও শেখ হাসিনা কী করে মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবেও দেশের অর্থনীতিকে সঠিক পর্যায়ে রেখেছেন এবং কী ধরণের নেতৃত্বের কৌশলে আজ ভারতকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে-এগুলো শেখারও পরমার্শ দিয়েছে।
আরেক পুরনো খবর-পাকিস্তান সরকারকে সেদেশের সাংবাদিক, গবেষক, অর্থনীতিবিদরাও বলেছিলেন, ‘আগামী ১০ বছরে ‘বাংলাদেশ’ করে দেখাও’।
আসলে, আমরা যাঁরা মুক্তিকামী স্বাধীনতার জনগণ, বাংলাদেশ নিয়ে কোথাও কোনো ভালো খবর শুনলে আমাদের আবেগ-ভালোবাসা ধরে রাখা ও নিয়ন্ত্রণ করা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে। এখনো সেই দূর থেকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’-জাতীয় সংগীত কানে ভেসে আসলে আমরা একদিকে যেমন আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই, অন্যদিকে আরো উদ্যোমী হয়ে পড়ি, আত্মবিশ্বাস নিয়ে কর্মপন্থার স্বপ্ন বুনি। কারণ, আমাদের অর্জনগুলো ঐতিহাসিক, ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাসও গণশ্রম বা পারিশ্রমিক মনোবলের বৃত্তিতে সৃষ্ট। বাঙালির সংস্কৃতিও মাটি-মানুষের।
যেমন, ২০১২ সালের জুলাই মাসের ১০ তারিখে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের নিশ্চয়তা দিয়ে ২০২০ সালে বিজয়ের মাসের এই ১০ তারিখেই বেলা ১২টা ২ মিনিটে সেতুর মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির সাথে ‘জোড়া’ ‘তালি’ দিয়েই স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যমান-বাঙালি জাতির জন্য আরেক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ঘটনা।
তাই বাঙালির আবেগ-ভালোবাসাও বেঁধে রাখা দায়, সরব হয়ে উঠি। কারণ, ‘জোড়াতালি’ দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হচ্ছে, উঠবেন না, রিস্ক আছে-এই ধরণের বিভ্রান্তকরণ পরিস্থিতি সৃষ্টির সাথে যুক্ত করা হয় দুর্নীতির ‘গালগপ্প’। আবার সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যায়ন করার আগ পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়াতে নানামুখী অপপ্রচার যেমন, ছোট বাচ্চাদের তাজা রক্ত লাগবে, এক মাত্র সন্তানের (এক মা’র সন্তান) মাথা লাগবে, পদ্মা সেতু এই চায়, ওই চায়-এর মতন জঘন্য রূপে ছড়ানো গুজব একশ্রেণীর সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল, বিভ্রান্ত করেছে। আর ২০১৭ সালে কানাডার আদালত দুর্নীতির চেষ্টার অভিযোগকে ‘গালগপ্প’ বলে উড়িয়ে দেয়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কী ধরণের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছেন, কী জঘন্য ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক মন্তব্য সহ্য করেছেন-আশাকরি এটিও ভুলে যাবার কথা নয়।
কিন্তু যার আছে সততার উদ্যোম, আত্মপ্রত্যয়ের অঙ্গীকার-শেখ হাসিনাকে কখনো দাবায়ে রাখা সম্ভব?
যে দেশ ও জনগণের জীবন মান উন্নত করতে জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা মিথ্যাচার-অপপ্রচার রোধ করে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন, যিনি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মোকাবেলা করেছেন, তাঁকে দুর্নীতির গালগপ্প দিয়ে বিতর্কিত করতে পারবেন না, পারেননি। কারণ, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক শিক্ষক বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ হাসিনার শরীরে বহমান হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির রক্ত, যাকে পাকিস্তানের কারাগারের পাশেই কবর খুঁড়ে হত্যার চূড়ান্ত নীল নকশা প্রণয়ন করেও বাঙালি ও বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি-শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত আর রাজনৈতিক দিক্ষায় আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে ২৪ বার মৃত্যুর চূড়ান্ত সীমারেখা অতিক্রম করে শেখ হাসিানও বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছেন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে বাংলাদেশের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন।
তাই আমাদের উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও এক অন্যন্যতায় নিয়ে গেছে। বিশেষ করে, পদ্মাসেতুর সর্বশেষ, অর্থাৎ ৪১তম স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষগুলোর আবেগ-ভালোবাসা আর আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বর্ণনাগুলো ফেসবুকে ভাইরাল করেছেন। জন্মাবধি যাদের অবিশ্বাস-সন্দেহ ছিলো যে, পদ্মার বুকে কখনো পদ্মা সেতু হবে, হতে পারে এর বাস্তবায়ন দেখে অনেক বন্ধু রীতিমত কেঁদে ফেলেছেন। ফোন করে অভিনন্দন, ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমরা যে পারি, আমাদের যে আত্মমর্যাদা আছে-এটি শেখ হাসিনাই বুঝিয়েছেন, প্রমাণ করেছেন।
এ বাঙালির নিজস্ব মত ও পথ আছে, থাকবে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও আলাদা-আলদা। ভালো কাজের প্রশংসা আর খারাপ কাজের সমালোচনাও বিদ্যমান। কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থে স্বাধীনতাকামী বাঙালি বরাবরই এক ও অভিন্ন। শুধু প্রয়োজন সুস্থধারার রাজনীতি যেখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা থাকবে। যেখানে রাজনীতির নামে হবে না মিথ্যাচার, অপপ্রচার, গুজব আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির মত জঘন্য জাতি-প্রজন্মকে বিভ্রান্তকর কর্মকাণ্ড। সাম্যের স্লোগান গানে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি-বাংলাদেশ পুরো বিশ্বের মডেল হবে-এই রাজনীতি অত্যন্ত প্রয়োজন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)