ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায় এবং এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ নিয়ে জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা রায়ের অসঙ্গতি তুলে ধরার পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির সাম্প্রতিক সময়ে দেয়া কিছু বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
এর আগে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ ধারায় আলোচনার জন্য নোটিশ দেন জাসদ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মইন উদ্দিন খান বাদল।
নোটিশে তিনি বলেন: অভিমত এই যে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় বাতিল এবং রায়ে জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতির দেওয়া অসাংবিধানিক, আপত্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক পর্যবেক্ষণ বাতিল করার জন্য যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।
প্রস্তাবকালে মইন উদ্দিন খান বাদল বলেন: প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার পর্যাবেক্ষণে অনেক অপ্রাসঙ্গিক ও অবাঞ্ছিত বিষয়ে পাশাপাশি, জাতীয় সংসদ সদস্যদের অপরিপক্ক আখ্যায়িত করেছেন। এ বিষয়টি এমনভাবে এসেছে এ নিয়ে আলোচনা-গুঞ্জন চলছে, তা সমীচীন নয়। আমরা বিশ্বাস করি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চাদর, তা সৃষ্টি হয়েছে সংসদ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সমন্বয়ে। যাতে সংবাদপত্র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
“আপনার কাছে ৭২’র থেকে ৭৭’র সংবিধান অধিকতর গ্রহণ যোগ্য মনে হলো! যার জন্মই মার্শাল-ল’র গর্ভে। আপনি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলছে- আপনাকে মনে করিয়ে দিতে চাই; এই সংসদেরই অনেক পার্লামেন্টেরিয়ান বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য গলাফাটিয়েছে। আপনি বিভিন্ন সময় অসংলগ্ন বক্তব্য দিচ্ছেন। কেননা, আপনি আপনারই স্ব-বিরোধীতা করেছে। আগে বলছেন, সেনা শাসন অবৈধ। আবার আপনিই বলছেন, ৭৭’র সেনা গর্ভে জন্ম নেওয়া কনস্ট্রিটিউশন ৭২’র থেকে অধিকতর ট্রান্সপারেন্ট!”
বাদল বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি অনেকেই যখন ব্যক্তি ও সংগঠনের জন্য নির্ধারিত লক্ষণ রেখা অতিক্রম করেন তখন সমাজ ও রাষ্ট্রে সংকট অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এই সংসদ ব্যাপক আলোচনার নিরিখে বর্তমান অবস্থার অবসান চায়। যাতে করে অশুভ ও গণবিরোধী শক্তি ঘোলাজলে মাছ শিকারের প্রচেষ্টা গুলিয়ে যায়।
এরপর আলোচনার জন্য ফ্লোর পান বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহম্মেদ। তিনি তার বক্তব্যে বলেন: আমি বিস্মিত হই, এই দেশে এই আদালতে আওয়ামী লীগের কোনো বন্ধু পাওয়া গেল না! আমরা এই জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ষোড়শ সংশোধনী পাস করেছিলাম। যার লক্ষ্য ছিল ৭২-এর সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে ফিরিয়ে আনা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়েছে, যে রায়ের আগে তারা আদালতের বন্ধু (এমিকাস কিউরি) হিসেবে কয়েকজনকে নিযুক্ত করেছে। জাতির কাছে প্রশ্ন রাখি আদালতের বন্ধু এরা কারা?’
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছে আপিল বিভাগ। এর ফলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত হয়। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রতিস্থাপিত করেছিল জাতীয় সংসদ। ওই সংবিধানের ৯৬ ধারা অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত কারণে বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারতো সংসদ।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘কোনো বড় দেশেই জুডিশিয়াল কাউন্সিল নেই। আজকে আমার অবাক লাগে এটি এখানে চালু করা হয়েছে। ১৯৫৬ এর সংবিধানে আছে সংসদ বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। আর ৭৭ এর সামরিক সরকারের প্রচলন করা আইনটি প্রধান বিচারপতির ভালো লেগে গেল।’
সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। এর ফলে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ন্যস্ত হয়। ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রতিস্থাপিত করেছিল জাতীয় সংসদ। ওই সংবিধানের ৯৬ ধারা অনুযায়ী নৈতিক স্খলনজনিত কারণে বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারতো সংসদ।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাশ করা হয়। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ন্যস্ত করে আনা সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন।
ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এরপর হাইকোর্টের দেয়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। গত ৮ মে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের উপর শুনানি শুরু হয়।
গত ৩ জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করে রায় ঘোষণা করেন। আপিল খারিজের ওই রায়ের ফলে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ই বহাল থাকে।
সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ১ অগাস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায় প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত রায় অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের সুপারিশ করার ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতেই ফিরে।
এছাড়া রায়ের পর্যবেক্ষণে, গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে।