শ্যামল কান্তিকে আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। নারায়ণগঞ্জের যে স্কুলশিক্ষককে কান ধরে উঠবস করানো হয়েছিল। খোদ সংসদ সদস্য যে কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অভিযোগ, কথিত ধর্ম অবমাননা। গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের মামলা দেয়া হয়েছিল। সেই মামলায় তিনি জেলও খেটেছেন। বিচারকের দয়া হয়েছে। জামিনে বেরিয়েছেন। কিন্তু মামলার ঘানি টানছেন এখনও।
আমরা তবুও শ্যামল কান্তিকে ভোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সেটি আর সম্ভব হলো না। কারণ আমাদের সামনে আরও একজন শ্যামল কান্তি হাজির। তার নাম আবু হানিফ। বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার একটি মাদ্রাসার শিক্ষক। শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস, দুই কানে সজোরে থাপ্পড়ের যে যন্ত্রণা, আবু হানিফের যন্ত্রণাটা বোধ হয় আরও তীব্র। এবার তার মাথায় মল ঢেলে দেয়া হয়েছে। ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলেন। পথরোধ করে স্থানীয় প্রভাবশালী কয়েকজন তার মাথা থেকে টুপি খুলে, মল ঢেলে দেয়। এই নির্মম ঘটনার পরে আমাদের শ্যামল কান্তির কথা মনে পড়ে।
১৮ মে কথা হয় তার সঙ্গে। জানালেন, এখনও কানে তীব্র যন্ত্রণা হয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই শিক্ষক এখনও কথা বলতে গিয়ে জড়িয়ে যান। ঠিকভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না। সামান্য স্কুলশিক্ষক। কতই বা বেতন! কিন্তু সেই টাকা চলে যাচ্ছে মামলার খরচ চালাতে। মিথ্যা মামলায় জেলও খেটেছেন। কতদিন এই ঘানি টানতে হবে জানা নেই তার। তার সাথে কথা হয় বাকেরগঞ্জের মাদ্রাসা শিক্ষককে নাজেহালের ঘটনা নিয়ে। শ্যামল কান্তি মনে করেন, মফস্বলে স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু লোক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটিতে আসতে চায়। এখানে তাদের অনেক স্বার্থ থাকে। অনেক অযোগ্য আর অশিক্ষিত লোকও পরিচালনা কমিটির প্রভাবশালী সদস্য হয়ে যান। কিন্তু যখন কোনো মেরুদণ্ডওয়ালা শিক্ষক তাদের অন্যায় কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান, তখন তাদের রোষানলে পড়তে হয়। তিনি (শ্যামল কান্তি) নিজে সেই রোষানলের যেমন শিকার, বাকেরগঞ্জের আবু হানিফ সেই একই নাটকের ভিন্ন মঞ্চায়ন। পার্থক্য শুধু স্থানে।
গণমাধ্যমের খবর বলছে, বরিশালের বাকেরগঞ্জে কাঁঠালিয়া ইসলামিয়া দারুচ্ছুন্নাৎ দাখিল মাদ্রাসার জমি দখলে বাধা দেওয়ায় এবং ব্যবস্থাপনা কমিটিতে স্থান না পাওয়ার জেরে প্রকাশ্যে ওই মাদ্রাসার সুপার আবু হানিফের মাথায় মল ঢেলে দেয়া হয়। এ ঘটনার ধারণ করা ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়া হলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। ১৪ জনের নামে থানায় মামলা করেন ভুক্তভোগী। এরপর পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। যদিও মূল অভিযুক্ত এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযুক্তদের বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের সমর্থক বলে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে।
এমন পাশবিক ঘটনা হত্যার চেয়ে কম গুরুতর নয়। হত্যা করলে মানুষটিকে আর অপমানের জ্বালা বয়ে বেড়াতে হতো না। একজন শিক্ষক এবং একই সঙ্গে তিনি স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার পরে তিনি কী করে শত শত মানুষকে পেছনে রেখে নামাজ পড়াবেন? তিনি কী করে মুখ দেখান সমাজে? যে গভীর বেদনার ক্ষত তার মুখে এঁকে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা, প্রচলিত আইনে তার কী এমন বিচার হবে? কেননা তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়নি। শ্যামল কান্তির মতো তার কানে সজোরে থাপ্পড় মারা হয়নি। প্রচলিত আইনে এই অপরাধের কি বিচার হবে? অপমানের কি সাজা হয়?
নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি এবং বাকেরগঞ্জের আবু হানিফের ঘটনায় পুলিশ প্রশাসন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন। শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করানোর ছবি ফেসবুকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভাইরাল হয়। নিজের কান ধরে সেই ছবি ফেসবুকে দিয়ে প্রতিবাদ জানান অসংখ্য তরুণ। সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। সরকারের মন্ত্রীরাও নড়েচড়ে বসেন। কিন্তু কী হয়েছে? শ্যামল কান্তিকে স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল। খোদ উচ্চ আদালত আর শিক্ষামন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সে যাত্রা স্বপদে বহাল হন শ্যামল কান্তি। কিন্তু মিথ্যা মামলায় জেলে যেতে হয়। শ্যামল কান্তির এই পরিণতির পেছনে সরাসরি ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। ফলে স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনও তার পক্ষে ছিল না। বরং পুলিশ প্রথমে যে তদন্ত রিপোর্ট দেয়, সেখানে বলা হয়, শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করানোর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অথচ সেই চরম অপমানের ভিডিও সারা দেশের মানুষ দেখেছে।
তবে বাকেরগঞ্জে মাদ্রাসা শিক্ষক আবু হানিফের ঘটনায় শ্যামল কান্তির মতো এতটা তোলপাড় হয়নি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। কেন? বোধ হয় এই ঘটনার পেছনে জড়িতরা নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্যের মতো ক্ষমতাবান নন এবং আবু হানিফকে লাঞ্ছিত করার ঘটনাটি পুলিশ-প্রশাসন ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেনি। বরং ফেসবুক ও গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া আসার পরে পুলিশ অন্তত তিনজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছে। সম্ভবত এসব কারণে আবু হানিফের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া শ্যামল কান্তির তুলনায় কম।
তবে প্রতিক্রিয়া যাই হোক, শিক্ষকদের অপমান করার যে প্রবণতা বা যে উদাহরণগুলো সৃষ্টি হচ্ছে, আগামী প্রজন্মের জন্য তা ভয়াবহ। এমনিতেই শিক্ষকরা, বিশেষ করে বেসরকারি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষকদের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। সারা জীবনই টানাটানির সংসার। তার উপরে যদি তাদের সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের হাতে এমন হেনস্থা হতে হয়, মিথ্যা মামলায় জেল খাটতে হয়, বছরের পর বছর মামলার ঘানি টানতে হয়, সামান্য বেতনের পয়সা বাঁচিয়ে চিকিৎসার খরচ জোগাতে হয়, তা শুধু ওই শিক্ষকের জন্যই নয়, বরং পুরো জাতি ও রাষ্ট্রের জন্যই অপমানজনক। এখানে একজন শ্যামল কান্তি বা একজন আবু হানিফের নয়, বরং মাথা হেঁট হয় আমাদের সবার।
এই শিক্ষকরাই এমপিওভুক্তির দাবিতে রাজধানীতে মিছিল করতে এসে পুলিশে পেপার স্প্রে (মরিচের গুঁড়া) খান; টিয়ারশেল, লাঠিচার্জ, দৌড়ানি। অথচ শিক্ষকদের আমরা বলি জাতি গঠনের কারিগর। যে পুলিশ সদস্য তার চোখে পেপার স্প্রে মারলেন, সেই পুলিশ সদস্য তো কারো না কারো ছাত্রই ছিলেন।
সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের যে হারে বেতন ও আর্থিক সুবিধা বাড়ে, শিক্ষকদের বেতন সেই তুলনায় কি বেড়েছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা বাদ দিলে, বাকি লাখ লাখ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা কী রকম মানবেতর জীবন-যাপন করেন, সেই খবর অনেকেই রাখেন না।
পিরোজপুরের একজন স্কুলশিক্ষকের গল্প জানি। ইলিশ মাছ খাওয়ার বায়না ধরেছিল অবুঝ সন্তান। কিন্তু মাস্টার মশাই যা বেতন পান, তা দিয়ে ইলিশ মাছ কেনা যায় না। বাড়তি আয়ের জন্য বাড়িতে তারা হোগলা পাতা দিয়ে পাটি বানাতেন। বিকেলে পাটি নিয়ে গিয়েছিলেন বাজারে। কিন্তু বিক্রি বিক্রি হয়নি। ফলে ইলিশ মাছ না কিনেই বাড়িতে ফেরেন শিক্ষকপিতা। অবুঝ শিশুর কান্না থামে না। দুঃখে, কষ্টে, অসহায়ত্বের কাছ হার মেনে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন ওই শিক্ষক।
এমন দুঃখকষ্টে থাকা মানুষগুলোকে যখন কথিত ধর্ম অবমাননা বা কমিটিতে ঢুকতে না দেয়ার জেরে প্রভাবশালীরা কান ধরে উঠবস করায়, মাথায় মল ঢেলে দেয়, সেই সংবাদগুলো পড়ে আমরা লজ্জিত হই। একজন শিক্ষকের সন্তানের হিসেবে আমার মনে হয়, আমার বাবাকেই বোধ হয় কান ধরে উঠবস করানো হলো। আমার বাবার মাথায়ই বোধ হয় তারা মল ঢেলে দিলো। শ্যামল কান্তি বা আবু হানিফের চেহারায় আমি কেন জানি শুধু আমার বাবার মুখ দেখি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)