চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

শেখ হাসিনা মানুষ হিসেবে কেমন?

প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং ছেড়ে শিক্ষকতায় এসেছি বলে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই প্রায়শঃ আমাকে “বেকুব” বলে সম্বোধন করেন। বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় এইরকম ‘সত্য’ সম্বোধন খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। যে সমাজে বিনয়ের চেয়ে দম্ভের, জ্ঞানের চেয়ে বাড়ি-গাড়ি আর সততার চেয়ে চালাকির দাম বেশী, সেখানে এমন মূল্যায়নই স্বাভাবিক।

‘ক্ষমতা’র ‘কেন্দ্র’ ছেড়ে আমি অনেক কিছু হারিয়েছি সত্য, আবার যা পেতে শুরু করেছি, তার মূল্যও কোন অংশে কম নয়। যা হারিয়েছি, তার মূল বক্তব্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’কে নিয়ে। আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার ধারে-কাছে থেকে তাঁকে তথ্যসেবা দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে কাছে থেকে দেখার বা শোনার দুঃখ আমার অনেকখানি প্রশমিত হয়েছে তাঁর কন্যাকে সাংবাদিকীয় সেবা দেয়ার সুযোগ পেয়ে।

সেই ‘অমূল্য’ সুযোগ আমি হারিয়েছি হেলায় নয়, স্বেচ্ছায় এবং স্বজ্ঞানে। সেই দারুণ, কিন্তু ব্যস্ত সময়ের কিছু ঘটনা, অভিজ্ঞতা আমি মানুষকে জানাতে চাই। এই জানার কিংবা অভিজ্ঞতার সাথে রাষ্ট্র-সরকার-রাজনীতির সম্পর্ক বা মূল্যায়ন অন্তত আজকের আলোচনায় মুখ্য নয়। একজন প্রধানমন্ত্রী এখানে মুখ্য নন। ব্যক্তি এখানে প্রধান, ব্যক্তি এখানে আধার। আবার সেই ব্যক্তিই এখানে জাতীয় কিংবা বৈশ্বিক।   

আওয়ামী লীগ করেন, এমনকি বিএনপি সাপোর্ট করেন, এমন অনেকে আমাকে প্রশ্ন করতেন, এখনো করেন-“শেখ হাসিনা মানুষ হিসেবে কেমন? আমি কোন সূচনায় না গিয়ে বলেছি, এখনো বলি -‘উনি একজন সহজ ও ভালো মানুষ এবং নতুন বাংলাদেশের নেতা’। বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় চারনেতার হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি শেখ হাসিনা’ই আমাদের যোগ্যতম নেতা। এ আমার অন্ধ বিশ্বাস নয়। দেশের অর্থনীতি, মানুষের জীবনমান বিচার করে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত।

প্রধানমন্ত্রী কিংবা আওয়ামীলীগ সভানেত্রী কিংবা বঙ্গবন্ধুর সন্তান হিসেবে তাঁর মূল্যায়ন যেমন সহজ নয়, আবার ব্যক্তি শেখ হাসিনার মূল্যায়নও সহজ নয়। এই কঠিন কাজটি করার ঝুঁকি আমি নিতে পারি, কারণ আমি তাঁকে দেখেছি, তাঁর সাথে দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় গিয়েছি, তাঁর কথা শুনে, নির্দেশ শুনে কাজ করে সকলের প্রশংসা অর্জন না করে থাকি, নিন্দা বা গাল মন্দ অর্জন করিনি, সেটা বলতে পারি।

২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রতিটি মুহূর্তের আমি সাক্ষী। শেখ হাসিনার সাথে প্রায় পুরো বাংলাদেশ আমি ঘুরেছি। কখনো উচ্ছল নদীর পাড়ে, কখনো কোন শতবর্ষী পাঠশালার মাঠে জনসভা হয়েছে। সুবহে সাদিকের প্রশান্তি নিয়ে শুরু হত সেই শুভযাত্রা, শেষ হত সন্ধ্যার ক্লান্তিতে। কিন্তু প্রশান্তি কিংবা ক্লান্তি আমার কাছে চমক নিয়ে হাজির হত না। আমি ইঙ্গিত পেতাম আগামীর। মানুষের সেকি উচ্ছ্বাস! সেকি প্রত্যাশার ঝলক! কঠিন, চতুর চেহারার দলীয় নেতা-কর্মী শুধু নয়; সমাবেশস্থল, আশপাশ, খালের পাড়, রাজপথ, অলিগলিতে প্রবাহিত হত সাধারণ মানুষের স্রোত। মসজিদের ইমাম, মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, বেকার, বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বাবার কাঁধে বসে থাকা কোনমতে হাঁটতে শেখা ছোট শিশু, তরুণ স্বামীর হাত ধরে আসা সস্তা লাল শাড়ির বউ-কী ছিল না সেই মানবসাগর সমগ্রে! তাঁদের সরব কিংবা নীরব উপস্থিতি ইশারা দিত ক্ষমতাসীন আগামীর।

সেই ইশারার সত্যরূপ দেখলাম ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে। আওয়ামীলীগ জিতে গেল। যেই সেই জেতা নয়। বিপুল, বিশাল ব্যবধানে বিজয়। তাও আবার যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত-সংশ্লিষ্ট জোটকে পরাজিত করে! যেন আরেক ১৬ ই ডিসেম্বর। বয়সের জন্য ৭১ এ থাকা আমার হাতে ছিল না। কিন্তু ২৯ ডিসেম্বরের বিজয়লগ্ন আমার যুবক চোখের সামনেই মহাকালে প্রবেশ করেছে।

শেখ হাসিনা সরকার ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরাও যে নিষ্ক্রিয় ছিলেন না, তার প্রমাণ তারা রাখলেন ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায়। অথচ ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখের ব্যস্ত সকালেই শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি, রাজনৈতিক সঙ্গীদের নিয়ে পিলখানায় গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের স্মার্ট সীমান্তরক্ষীদের দৃষ্টিনন্দন, বীরোচিত কুচকাওয়াজ দেখে রাজকীয় খানাপিনা করে আমরা যখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর অনুসরণ করে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন কেউ কি ভেবেছিল কী কঠিন আঘাত আসছে আর কিছুক্ষণ পরেই! রাজদরবারে ডিউটি করার সুবাদে সেই সময়কার ভয়ঙ্কর সামরিক-বেসামরিক-রাজনৈতিক চাপের কিছুটা আমিও শেয়ার করেছিলাম। যমুনার ভেতরে-বাইরে, ক্যান্টনমেন্টগুলোতে, সংলগ্ন জনপদে কী পরিমাণ উত্তেজনা, ঝুঁকি ও  স্নায়ু চাপ ছিল প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া আর কেউ এর অনুভূতি বা স্মৃতি বর্ণনা করতে পারবে না। এ যেন স্বপ্নের ঠিক উল্টো পিঠেই দুঃস্বপ্নের চোখরাঙ্গানি। সেই ভয়ঙ্কর কঠিন সময় শেখ হাসিনা দেশকে একটি দীর্ঘস্থায়ী, রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের কবল থেকে বাঁচিয়ে অগ্রযাত্রার শুরু করেছিলেন। সেই অগ্রযাত্রায় আমার কিংবা অনেকের অংশীদারিত্ব একেবারেই সামান্যতম, কিন্তু প্রত্যক্ষ।

শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ তখন কানাডায়, শারীরিক সঙ্কট এবং সম্ভাবনায় চিকিৎসাধীন। আবার অন্যদিকে কানাডার সরকারের বিশেষ আমন্ত্রণ। এই দুই মিলে সরকারি সফরে প্রধানমন্ত্রী কানাডা যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হল। বিমানে ভ্রমণ, তাও আবার কানাডা’র মত দেশে যাওয়ার সম্ভাবনায় আমার কিংবা আরও অনেকের তখন গায়ে জ্বর আসার মত অবস্থা। সংশ্লিষ্ট দফতর যখন পাসপোর্ট চাইল, সেদিন যেন জীবনে প্রথম বসন্ত এল। পাসপোর্টে ভিসা লাগল। সকাল-বিকেল ভিসার হলদে সুন্দর মসৃণ পাতা ছুঁয়ে দেখা। এর মধ্যে একদিন শুনলাম শেখ হাসিনার স্বামী মরহুম ওয়াজেদ মিয়া স্যার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

স্বামীর বিপদে সন্তান-সান্নিধ্য, গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফর বাদ দিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। কানাডা সফর বাতিল হয়ে গেল।  কয়েকদিন আগেই দেশকে বাঁচালেন গৃহযুদ্ধ থেকে; এবার স্ত্রী হিসেবে স্বামীকে বাঁচানোর লড়াই। দেশ বাঁচানোর কাজে সফল হলেন, কিন্তু ওয়াজেদ মিয়া সাহেব’কে আল্লাহতাআলা আর পৃথিবীতে রাখলেন না। উনি চলে গেলেন স্রষ্টার কাছে। ৭৫’র ১৫ই আগস্ট বাবা-মা-ভাইদের হারিয়েছেন; নতুন বাংলাদেশে স্বামীও চলে গেলেন পরকালে।

আমরা কী ভেবেছি, কতখানি কষ্ট, হাহাকার, একাকীত্ব থাকতে পারে একজন শেখ হাসিনার মনে! কিন্তু ব্যক্তি শেখ হাসিনা তো সাধারণ কেউ নন যে অসহায়ত্ব, একাকীত্ব কিংবা ভোগ বিলাসে বিলুপ্ত হয়ে যাবেন! দেশ গড়ার কাজে হাত দিলেন এই নারী। একদিকে পশ্চিমা শক্তিগুলোর, অন্যদিকে দেশীয় রাজনৈতিক এবং ‘সুশীল’ বিরোধীদের সম্মিলিত অসহযোগিতা ও ষড়যন্ত্র। যে ওয়াদা করে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে সরকারে এনেছিলেন, সেই ওয়াদাপূরণের প্রয়াস শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের আইনি বিচারের কাজ সম্পন্ন হল। ৭১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের নিমিত্তে ট্রাইব্যুনাল গঠন হল। শুরু হল বিচার কাজ। সেই কাজে পুরো জাতি আজ সাফল্যসুখ ভোগ করছে। ব্যক্তি শেখ হাসিনা না থাকলে লোভীদের সমাজে এই কঠিন কাজ কখনোই হত কিনা আমার সন্দেহ আছে।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, জ্বালানী খাত, রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে নানা বিতর্ক আছে সত্যি। কিন্তু প্রত্যক্ষ উন্নয়নের সাক্ষ্য পক্ষ-বিপক্ষের সকলেরই দেয়া উচিত। কৃষকদের জন্য ভর্তুকি বাড়ালেন, প্রতিরক্ষা খাতে আধুনিকায়ন চলমান আছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে প্রতিনিয়ত, নিত্য নতুন অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। হরতালের মত উন্নয়ন-বিরোধী রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি বন্ধ করতে সক্ষম হলেন। বিশ্বাস হয়না যে, বাংলাদেশে এখন আর কোন হরতাল পালিত হয় না। ২০১৩-২০১৪ সালের রাজনৈতিক অরাজকতা থেকেও দেশকে মুক্ত করলেন।

দেশি-বিদেশি শীর্ষ গণমাধ্যমের অসহযোগিতা, মার্কিন-নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদীদের হুঙ্কার সব কিছুকে কি শক্ত হাতেই না সামলে চলেছেন এই নারী! বাংলাদেশে যারা নিজেদের কমরেড বলে পরিচয় দিয়ে বেড়ান তারা স্বীকার করুন আর না করুন, শেখ হাসিনার চেয়ে বড় কমরেড আর কেউ নিজেদের দাবি করলে আমি অন্তত একমত হব না। পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংক  কত  চেষ্টাই না করল। সরকারকে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কাছে মাথানত করাতে পারলনা। পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, সত্য বাস্তব। আমি লিখতে বসেছিলাম, ব্যক্তি শেখ হাসিনা কে নিয়ে, অনেক কথা বলে ফেললাম রাষ্ট্র, বিশ্ব নিয়ে। আসলে ব্যক্তি শেখ হাসিনাই তো বিশ্ব পরিমণ্ডলে ইতিবাচক বাংলাদেশের বড় এম্বাসেডর।

২০০৯ সালের সম্ভবত এপ্রিল মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গেলেন আমাদের নবীজী হজরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর দেশ জাজিরাতুল আরবে গেলেন। সৌদি বাদশার কাছ থেকে শ্রমিকদের আকামা ব্যবস্থা পুনঃপ্রচলনের অঙ্গীকার আদায় করলেন। পবিত্র কাবা শরীফ তাওয়াফ করার সময় একটি ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরাপার্সন একই সাথে তাওয়াফ এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছেন। উলটো হাঁটছেন তিনি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী উনাকে বললেন, “এই তুমি কী করছ? ক্যামেরা রাখ। ঠিকমত তাওয়াফ কর”। একজন “সামান্য” ক্যামেরাপার্সনের অসামান্য কষ্ট একজন প্রধানমন্ত্রীর নজর এড়ায়নি। স্রষ্টার এবাদত করতে গিয়ে তাঁর বান্দার কষ্ট এড়িয়ে গেলে স্রষ্টা খুশি হবেন না। এই মানবিকতা কি আমাদের ভেতর আছে?

আরেক সফরে ২০০৯ সালের শেষ দিকে আমরা গেলাম সুইজারল্যান্ডের জেনেভা সফরে। একটি মিউজিয়াম পরিদর্শনে গিয়ে শেখ হাসিনাকে একটু পাথুরে রাস্তায় হাঁটতে হয়েছিল। উনি আমাদের সবাইকে বললেন, সাবধানে হাঁটতে, পড়ে গিয়ে ব্যথা যেন না পাই! ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে গেলাম একবার এই বছরেই ডিসেম্বর মাসে। সে কী তীব্র শীত! অবিরাম তুষারপাত, মনে হত যেন ২৪ ঘণ্টাই এখানে রাত। কনফারেন্স অব দ্যা পার্টিস (কপ)’১৫ নামে খ্যাত সেই জলবায়ু সম্মেলন ছিল বাংলাদেশের অধিকার আদায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সেই সময় প্রধানমন্ত্রীকে আমার ‘যন্ত্র-মানব’ বলে বলে মনে হয়েছিল। যে ৫/৬ দিন আমরা কোপেনহেগেনে ছিলাম, এই বাংলাদেশী নারীকে দেখেছি দিনে ২/৩ ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়েছেন। বাকি পুরো সময়টা মিটিং এর পর মিটিং করে গেছেন। সে কি অমানুষিক পরিশ্রম। বিদেশ সফরে টাকা বাঁচাতে উনি কখনো বিশেষ বিমান ব্যবহার করেন না। সাধারণ ফ্লাইটেই উনি যাতায়াত করেন। আবার বিমানে বাংলাদেশী সাধারণ যাত্রী পেলে তাঁদের সাথে কথা বলা, হাত মেলানো উনার নিত্য অভ্যাস। আবার উনি আমুদেও কম নন।

একবার গেলাম সাউথ কোরিয়াতে। ২০১০ সালের মে মাসে। একটি আঞ্চলিক সম্মেলনে গিয়েছিলেন তিনি। এই সুযোগে উনি একসময়ের দূষিত পানির নদী ‘হান’ দেখতে যান। ফেরি যখন মাঝ নদীতে উনি বললেন, গান গাইতে পারে কে? আমি পালিয়ে পেছনে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু অনেকেই গাইলেন। উনিও গলা মেলালেন, “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি!”  হান নদীর বুকে ভেসে তিনি আমাদের দুঃখিনী বুড়িগঙ্গাকে বাঁচানোর পরিকল্পনা ব্যক্ত করেছিলেন।

বিতর্কিত বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। জাতিসংঘের ৬৫তম সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে যোগ দিতে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেলেন নিউইয়র্কে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার এক ডিনার প্রোগ্রামে বিশ্বের বাঘা বাঘা সব লিডার। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও সেখানে দাওয়াত পেয়ে গেছেন। সঙ্গী খুব কম। আমাদের সেখানে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। পরের দিন আমার সাংবাদিকতার ওস্তাদ শামীম আহমদ (বর্তমানে ওয়াশিংটনে প্রেস মিনিস্টার) এক স্টোরি করলেন। ইংরেজি শিরোনামটা আমার হুবহু মনে নেই। কিন্তু বাংলা করলে দাঁড়াবে, ‘শেখ হাসিনার গ্লাসে পানি ঢেলে দিলেন বারাক ওবামা’। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাঁর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে গিয়ে বারাক ওবামা সেদিন শেখ হাসিনার গ্লাসে নিজে এসে পানি ঢেলে দিয়েছিলেন! তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কয়েস সকালের নাস্তায় শামীম ভাই’র কাছে সেই ঘটনার গল্প করেছিলেন। আর তিনি অসাধারণ দক্ষতায় ঘটনাটি নিয়ে স্টোরি করে একইসঙ্গে নিজের এবং আমাদের অফিস ইউএনবির জাত চিনিয়েছিলেন।

ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি ঘটনা দিয়ে আজকের লেখা শেষ করব। শেখ হাসিনা ২০১১ সালের জানুয়ারিতে সরকারী সফরে গেছেন লন্ডনে। সেখানে সরকারি নানা কাজের ফাঁকে আমরা একদিন সবাই গেলাম অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক প্রোগ্রামে। সেখানে অধ্যয়নরত এশিয়ান ছাত্রছাত্রীদের আমন্ত্রণে তিনি বক্তৃতা করবেন এবং তাদের নানা প্রশ্নের জবাব দেবেন। অক্সফোর্ডে কারা পড়তে যায় সেটা আর নাইবা বললাম। উনি অলিখিত ভাষণ দিলেন। ভারত, শ্রীলঙ্কা, জাপানসহ নানা দেশের ছেলে-মেয়েরা তাঁকে সহজ, কঠিন নানা প্রশ্ন করলেন। উনি সাবলীল ভঙ্গিমায়, স্পষ্ট ইংরেজিতে কথা বলে গেলেন। উনি এক/দুই লাইন বলেন, আর মহাজ্ঞানীদের পুরো সমাবেশ হাততালি দিয়ে উঠেন।

রমিজা খাতুনের কথা আপনাদের মনে আছে? এক ভিক্ষুক নারী, যার স্বামী শেখ হাসিনার বাড়ি ঘর নেই বলে তাঁর নামে এক টুকরো জমি কিনে দিয়ে গিয়েছেন। আমাদের মধ্যে কয়জন আছে যারা জীবনে একবার একজন ভিক্ষুককে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন? জড়িয়ে ধরে কাঁদা দূরের কথা, ভিক্ষুককে ছুঁয়ে দেখার সাহস, ঔদার্যও প্রায় কারোরই নাই। আমি নিজে দেখেছি, শেখ হাসিনা কয়েকবার সেই ভিক্ষুক নারীকে জড়িয়ে ধরেছেন। কেঁদেছেন। শেখ হাসিনা আজ ৭০ বছরে পা দিলেন। আর কত দিবেন তিনি আমাদের! সবাই যদি উনার কাজ ভাগ করতে নিতে পারেন, তাহলে এই বৃদ্ধ বয়সে উনি একটু বিশ্রাম পাবেন, উনার আয়ু বাড়বে, বাংলাদেশও তাঁর সেবা পাবেন। কিন্তু উনার মত আন্তরিকতা, সততা, দূরদর্শিতা নিয়ে, শ্রম দিয়ে কাজ করতে পারবেন কজন? চলুন সবাই অসততা, লোভের রাস্তা ছেড়ে আত্মত্যাগ করতে শিখি। ভোগ, বিলাস কম করি। একা ভালো থাকা, ভালো খাওয়ার মধ্যে প্রকৃত আনন্দ নেই, প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে এটাই হোক আওয়ামের শিক্ষা।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)